সিন নীদে ঐতিহাসিক প্যারেডের মধ্য দিয়ে প্যারিস অলিম্পিকের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলো। শতবছর পর প্রথমবারের মতো প্যারিসে অলিম্পিকের আয়োজন ফিরে আসার আনন্দকে কোনদিক থেকেই কমতি রাখতে চায়নি স্থানীয় আয়োজক কমিটি। আধুনিক যুগের ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ অনেকাংশেই প্যারিসের বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে।
প্যারিসের সিন নদীতে জাতীয় পতাকা নিয়ে অংশগ্রহণকারী সব কটি দেশের অ্যাথলেটদের মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হয়। অলিম্পিকের নিয়মানুযায়ী মার্চপাস্টে অলিম্পিকের জন্মভূমি গ্রীস থাকে সবার শুরুতে, সবার শেষে থাকে আয়োজক দেশ। অর্থাৎ মার্চপাস্টে সবার শেষে এসেছে ফ্রান্স। অলিম্পিকের পতাকা নিয়ে মার্চপাস্ট করেছে শরণার্থী দল।
২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের পর থেকে এখন পর্যন্ত পদক তালিকায় শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মার্চপাস্টে পতাকা বহন করেছেন বাস্কেটবল আইবন লিব্রন জেমস ও টেনিস তারকা কোকো গফ। ৮৫টি নৌকায় চড়ে বিশে^র ২০৬টি দেশের দশ হাজারের ক্রীড়াবিদ ও কর্মকর্তা ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সিন নদী প্রদক্ষিন করেছে।
জনপ্রিয় রক তারকা সেলিন ডিওনের গানের পাশাপাশি লেডি গাগার শো উদ্বোধনী আয়োজনকে সমৃদ্ধ করেছে। ফরাসি সংষ্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস বিভিন্নভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি ঐতিহাসিক অনেক কিছুই বিশ্বের সামনে নিয়ে আসতে কার্পণ্য করেনি আয়োজক কমিটি।
অলিম্পিকের অন্যতম আকর্ষণ মশাল প্রজ¦লনেও ছিল নতুনত্ব। প্যারিসের রাতের আকাশে বিশাল হট-এয়ার বেলুন আগুন ধরিয়ে আকাশে উড়ানো হয়েছে। অলিম্পিকের শেষদিন পর্যন্ত প্যারিসের আকাশে এই বেলুনেই অলিম্পিকের মশাল জ¦লবে।
অলিম্পিক গেমসের লিঙ্গ সমতার বার্তা হিসেবে ফ্রেঞ্চ ট্র্যাক কিংবদন্তী মেরি-হোসে পেরেক ও তিনবারের অলিম্পিক জুডো চ্যাম্পিয়ন টেডি রিনার একসাথে অলিম্পিকের মশাল প্রজ্বলন করেন। তার আগে ফরাসি ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান মশাল নিয়ে ১৪ বারের ফ্রেঞ্চ ওপেন বিজয়ী রাফায়েল নাদালের হাতে তুলে দেন।
বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য্যরে অন্যতম একটি স্থাপনা হলো আইফেল টাওয়ার। প্যারিস শহরের মূল কেন্দ্রে অবস্থিত এই আইফেল টাওয়ারে অবিশ্বাস্য আলোর ঝলকানি চার ঘণ্টার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারা বিশ্বকে আরও একবার বিস্মিত করেছে। আইফেল টাওয়ারে অলিম্পিকের পাঁচটি রিং ঝুলানো ছিল।
বৃষ্টিস্নাত পরিস্থিতিতে পুরো সিন নদীর ধার ঘেসে প্রায় তিন লাখ উৎসুক মানুষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সাড়ম্বরে বরণ করে নিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল ভেন্যুর বাইরে আয়োজিত হয়েছে। আয়োজনে নতুনত্ব আনতেই এই ধারণা অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই হাতে নিয়েছিল আয়োজকরা।
চারদিকে খোলামেলা নদীকে ঘিড়ে এত বড় আয়োজনে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছিল। তবে সবদিক থেকেই সফল এই আয়োজন ইতিমধ্যেই অলিম্পিকের ইতিহাসে অন্যতম বড় ও স্বার্থক হিসেবে বিশ্ব গণমাধ্যমের হেডলাইনে পরিণত হয়েছে।
যদিও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে সকাল থেকেই ছিল শঙ্কা। অনুষ্ঠান শুরু হবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্যারিসের দ্রুতগতির রেল নেটওয়ার্ক। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েন লাখ লাখ মানুষ। তবে এ হামলায় সবার প্রতি ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী গাব্রিয়েল আত্তাল দ্রুত হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করার কথাও বলেছেন।
প্যারিসের ঐতিহাসিক ভবন গ্র্যান্ড প্যালেসের ছাদে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেছেন ২০২৩ ভয়েস অব ওভারসিজ টেরিটরিজ জয়ী গায়িকা অ্যাক্সেলে সেইন্ট-সিরেল।
আইফেল টাওয়ারের প্রথম লেভেলে উঠে সেলিন ডিওন তার পারফরমেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিরল রোগে আক্রান্ত হবার পর এই প্রথম জনসমুক্ষে কোন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করলেন জনপ্রিয় এই পপ তারকা।
প্যারিস গেমসের আয়োজক কমিটির প্রধান টনি এস্টানগে বলেছেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যতটা সম্ভব সীমা টেনে ধরার চেস্টা করা হয়েছে। অলিম্পিকের মত সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজনের শুরু থেকেই ফ্রান্সের যে উচ্চাকাঙ্খা ছিল তা প্রমান করার চেষ্টাই এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়েছে।
মালি বংশোদ্ভূত ফরাসি সংগীতশিল্পী আয়া নাকামুরা পারফর্ম করেছেন। ফ্রান্সের রিপাবলিকান গার্ডের ৬০ জন সুরকার ও সামরিক বাহিনীর ৩৬ জন গায়কের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন তিনি। বিশ্বে ফরাসি ভাষার শিল্পীদের মধ্যে নাকামুরাকে সবচেয়ে বেশি স্ট্রিম করা হয়।
পুরো অনুষ্ঠানকে ঘিড়ে প্রায় ৪৫ হাজার পুলিশ ও প্যারামিলিটারি অফিসার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। তাদের সাথে আরো ছিল ১০ হাজার সৈনিক ও ২২ হাজার প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড। কার্যত সিন নদীকে ঘিড়ে আকাশ সীমানা থেকে শুরু করে পুরো এলাকাটি লক ডাউন করে দেয়া হয়। কোন ধরনের বড় দুর্ঘটনা ছাড়াই শেষ পর্যন্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়া সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।