২০০৯ সাল থেকে কি-বোর্ড চেপে আসছি। অ্যাপল থেকে শুরু করে ডেল, এ ফোর টেক কিংবা লজিটেক; কতো কী-বোর্ডেই তো লিখলাম। অফিসের মতো অনেক কি-বোর্ডই বদলালো! কিন্তু গল্পটা আজও বদলালো না। এখনও সেই একই গল্প, হৃদয় ভাঙার গল্প।
প্রথমে ব্যাটিং করে ভারত ১৭৫ তোলার পর পথটা কঠিন মনে হচ্ছিল। কিন্তু ওদের বোলিং লাইন আপ আর শেষ দুই ম্যাচে বাংলাদেশের লড়াইয়ের মানসিকতা সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। লিটন আর সৌম্যর দ্রুত বিদায়ে সেই স্বপ্ন অবশ্য দ্রুতই বিবর্ণ হয়ে ওঠে। আবার রঙ ফিরিয়ে আনতেও বেশি সময় নেননি নাঈম শেখ ও মোহাম্মদ মিঠুন। তবু শেষটা সেই আগের মতোই, আক্ষেপে মোড়ানো-চরম হতাশার।
প্রথম টি-২০ জয়ের পর প্রশংসায় ভেসেছিল বাংলাদেশ। দলের অবস্থা বিবেচনায় ওই লড়াই প্রশংসারই দাবিদার ছিল। যে প্রশংসা পেয়েছিল দল, সেটা ছিল দলীয় প্রচেষ্টার পুরস্কার। ফুল টিম ওয়ার্কের কারণে ম্যাচ জিতেছিল চরম অস্থিরতা নিয়ে ভারত সফরে যাওয়া বাংলাদেশ।
সেই টিম ওয়ার্কের অনুপস্থিতিতেই সিরিজ খোয়ালেন মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকরা। টিম ওয়ার্কের কিছুই দেখা গেল না বাংলাদেশ দলে। কেমন ছিল টিম ওয়ার্ক, সেটা বুঝতে পুরো ম্যাচ দেখার দরকার নেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্কোরকার্ডে চোখ রাখলেই চলছে।
দু’জন ব্যাটসম্যান কেবল দুই অঙ্কের রান করেছেন। মাত্র ৩টি টি-২০ খেলা নাঈমের ৮১ ও মিঠুনের ২৭। যোগ করলে হয় ১০৮ রান। বাংলাদেশ রান করেছে ১৪৪। অর্থাৎ, বাকি ৮ ব্যাটসম্যান মিলে করেছেন ৩৬ রান। এর মধ্যে তিনজন গোল্ডেন ডাক। এসব নিয়ে ১৭৫ রান তাড়া করা যায় কীভাবে?
দলীয় খেলা বলে কখনও কখনও এমন অবস্থায়ও ম্যাচ জেতা যায়। একজনই ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারেন। টি-২০ ক্রিকেটে সেই সম্ভাবনা আরও বেশি। নাঈম হতে পারতেন সেই নায়ক (তাকে নিয়ে এখনই এমন স্বপ্ন বোনা যে বাড়াবাড়ি, সেটাও মাথায় ছিল)। যদিও শুরুতে সেটা মনে হয়নি। কারণ প্রথম কয়েক ওভার নাঈম স্ট্রাগল করেছেন। রান নিতেই রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে।
একটু করে সময় গেছে, নাঈম হয়ে উঠেছেন কান্ডারি। দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে হিমশিম খাওয়া ম্যাচেই অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার গল্পও লিখেছেন তরুণ এ বাঁহাতি। কিছুক্ষণ পর মনে হয়েছে, অভিজ্ঞ কোনো টি-২০ ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং শো চলছে। তিন ম্যাচের অভিজ্ঞতা দিয়েই বল বাছাইয়ে পারদর্শীতা দেখানো নাঈম অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করেছেন। ভারতীয় বোলারদের রীতিমতো নাচিয়েছেন তিনি।
হাতে অনেক বেশি শট না থাকলেও সেই দুর্বলতা কাটিয়ে নাঈম দেখিয়েছেন, আলোর পথে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়। যদিও দিনশেষে তার নামটি পরাজিতদের দলে। এ জন্য নিশ্চয়ই বাংলাদেশের বাকি সদস্যরা আক্ষেপে পুড়েছেন। কারণ, তরুণ একজন যোদ্ধার সব লড়াই জলে গেছে বাকিদের কারণে। এমন ম্যাচও যে হারা যায়, বাংলাদেশই সেটা বারবার করে দেখায়!
বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সিরিজ জেতার লক্ষ্য নিয়ে ভারত যায়নি। কিন্তু প্রথম ম্যাচ জেতার পর পাল্টে গিয়েছিল দৃশ্যপট। রোহিত-ধাওয়ানদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাংলাদেশ বলে রেখেছিল, সিরিজ জিততেই মাঠে নামবো। ১৭৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমেও সেই পথে ছিল দল। কিন্তু অদ্ভুত রকমের বাজে ক্রিকেট খেলে সেই সুযোগ হতাছাড়া করেছে বাংলাদেশ। শেষ টি-২০ হার সত্যিই মেনে নেওয়া কঠিন।
বেশ কয়েকটি জায়গা নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে। শফিউল এবং আল আমিন- দুজনই তাদের কাজটা ভালোভাবে করেছেন। একইভাবে সৌম্যও দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু যার দিকে পুরো দল তাকিয়ে থাকে, সেই মোস্তাফিজ বড়ই অচেনা হয়ে গেছেন। অপ্রয়োজনীয় সব শর্ট বল করে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের রান তোলার পথ সহজ করেছেন তিনি। দেখে মনে হয়েছে উইকেটের ধরনই বোঝেননি তিনি। তার বোলিংয়ে ছিল না পরিকল্পনার ছাপও।
আফিফের ওভারটি এক্সেপশনাল। শ্রেয়াশ আইয়ারের তোপে পড়ে যেতে হয়েছে তাকে। বিপ্লবও এদিন চেনা পথে ছিলেন না। এর পেছনে হয়তো কাজ করেছে তার ক্যাচ মিস। আইয়ারের ক্যাচ মিস করে বোলিংয়ে এসে সেরাটা দিতে পারেননি তরুণ এ লেগি।
এখানে ফিল্ড পজিশনের ব্যাপারটিও চলে আসে। পয়েন্টে দাঁড়ানোর মতো ফিল্ডার কি বাংলাদেশ দলে নেই? থাকলে বিপ্লবকে কেন এমন পজিশনে ফিল্ডিং করানো হলো? ওই ক্যাচ মিসের পরই দেখা গেল গালি দিয়ে একটি চার। আর গালিতে তখন ফিল্ডিং করছিলেন মোস্তাফিজ। এটা আরও বেশি অদ্ভুত মনে হয়েছে। মোস্তাফিজ কেমন ফিল্ডার, সেটা নিশ্চয়ই অজানা ছিল না অধিনায়কের!
সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুলটা হয়েছে ব্যাটিংয়ে। লিটন-সৌম্য আউট হওয়ার পর ওই অবস্থায় মুশফিককে চারে আশা করেছিলাম। সেটাই হয়তো বেশি যৌক্তিক ছিল। নাঈম-মিঠুনের ৯৮ রানের জুটি দেখে এটাও যৌক্তিক মনে হবে। তবে নাঈমের সঙ্গে মুশফিক থাকলে গল্পটা ভিন্ন হতে পারতো। নাঈমের ধুন্ধমার ব্যাটিংয়ের সঙ্গে মুশফিকের হিসেবি ব্যাটিং ম্যাচ জয়ের পথ আরও সহজ করে দিতে পারতো। শেষের দিকে তেড়েফুঁরে ব্যাটিং করার দরকারই হয়তো পড়তো না।
সবশেষে ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো- শুধু ট্যালেন্ট নয়, নাঈমের মতো পারফরমার দরকার বাংলাদেশের। যারা ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেও চাপের বোঝা মাথায় নিয়ে দলের জন্য লড়ে যেতে পারেন।
লেখক : শান্ত মাহমুদ, ক্রীড়া সাংবাদিক