অনেক অবহেলা, উপেক্ষা সয়েও মেয়েরা সাফ ফুটবলে কাপ জিতেছে। কিন্তু অবহেলা তাদের পিছু ছাড়েনি। বাফুফের প্রেস-মিটে তা প্রমাণিত হয়েছে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে। দেশের ফুটবলের দুর্দশার জন্য বাফুফের এক কর্মকর্তাকে সরাসরি দায়ী করেন অনেকে। সেই দুর্দশার প্রতিচ্ছবিই ছিল বাফুফের প্রেস-মিট।
যাদের কথা বলার কথা গণমাধ্যমের সাথে তাদের পেছনে দাঁড় করিয়ে রেখে অন্যরা সমুখে চেয়ারে বসে রইলেন। সারা বিশ্বে এমন প্রেস-মিটের নজির বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবহেলা, উপেক্ষা সয়ে কাপ এনেও পুনর্বার অবহেলার শিকার হলো আমাদের মেয়েরা।
অবহেলার কথা বলা না শেষ হতেই গণমাধ্যম জানালো আরেক খবর। বিমানবন্দরে দুই ফুটবলারের লাগেজ ভেঙে আড়াই লাখ টাকা ও মালামাল চুরি হয়েছে। এই ‘চুরি’-টাকে সিম্বলিক ধরে নিলে প্রকৃত চুরির ব্যাপকতা বুঝতে সুবিধা হবে। সুবিধা হবে কেন বেগমপাড়া গড়ে ওঠে কানাডায়, আদমপাচারে কেন ধরা খান আইন প্রণেতা।
সুইস ব্যাংকগুলো উপচে পড়ে কোন অর্থে। গ্রামের প্রচলিত প্রবাদের মতন, ‘একটা ভাত টিপলেই সব ভাতের খবর বোঝা যায়’। প্রবাদ এমনি এমনি গড়ে ওঠে না, সত্যকে ধারণ করেই গড়ে ওঠে। দুস্কৃতিরা কতটা নির্ভার তা এই চুরির মধ্য দিয়েই বোঝা যায়।
২.
মেয়েদের এই জয় নিয়ে না-না জনে হরেক কিছিমের আলাপ ফেঁদে বসেছেন। আমাদের কতিপয় বুদ্ধিজীবী এ বিষয়ে সাপের পাঁচ পা দেখার মতন পাঁচ পা এগিয়ে। পোশাক নিয়ে কথা বলছেন। হুজুরদের মিছিলের ছবি দিচ্ছেন। কার্টুন প্রদর্শন করছেন। রীতিমত প্রদর্শনবাদীতার প্রতিযোগিতা। এমন একজনকে বলা হলো- আপনার মেয়ে তো ছোটবেলায় স্পোর্টসে ভালো ছিল, সেখানে ক্যারিয়ার গড়তে দিলেন না কেন?
তিনি রীতিমত আতকে উঠে বললেন, ‘না-না আমার মেয়েকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এদেশে কিছু হবে না।’
অবস্থা দেখেন, তাদের বাচ্চাদের নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ জীবনের কথা চিন্তা করে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন আর দেশোদ্ধারের দায়িত্ব দিয়েছেন এই মেয়েদের উপর। যে মেয়েরা উঠে এসেছে একেবারে প্রান্তিক জায়গা থেকে। কারো বাবা ভ্যান চালান, সব্জি বিক্রি করেন এমনসব খেটেখাওয়া মানুষের সন্তান এরা। এহেন সংগ্রামী মানুষের সন্তানেরা যুদ্ধ করতে করতেই বড় হয়েছে। কথিত মাথাবেচা বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজন হয়নি সাফ ফুটবলের কাপ জিততে। সে যুদ্ধটা তারা একাই জিতেছে। এই বুদ্ধিজীবীরা মাথা বের করেছেন জেতার পর। না জিতলেও বের করতেন, ‘এই সব মেয়েদের দিয়ে কিছু হবে না’ এই বলে।
একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, যারা এত কথা বলেন, তাদের কোনো মেয়ে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলেন কিনা? তাদের কারো কারো সন্তানদের পাবে-বারে কম পোশাকের ছবি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু খেলার মাঠে হাফপ্যান্ট পরিহিত ছবি পান কিনা তাও একটু খুঁজে দেখতে পারেন। সম্ভবত পাবেন না।
মাঠে খেলে প্রান্তিক গ্রাম কলসিন্দুরের মেয়েরা। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার সুবিধা বঞ্চিত মেয়েরা। ওরা বলেছেই, মায়ের গয়না, বাপের জমানো টাকা দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। অবহেলা ও বঞ্চনায় বেড়ে ওঠা মেয়েগুলো শেষ পর্যন্তও অবহেলার শিকার হয়েছে। এমনকি তাদের নিজ রোজগারের অর্থটা দেশে নিয়ে আসবে এমন নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তারপরও কোন লজ্জায়, কী করে যে কেউ কেউ বড় মুখ করেন, ভেবে পাই না!
৩.
১৯৭৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন বের হতো ‘ক্রীড়া জগত’ নামে। সালটা খেয়াল করুন ১৯৭৭ আর এখন ২০২২ প্রায় শেষের দিকে। তখনকার ক্রীড়া পরিষদ এখন না-না নামে বিকশিত। সে সময়ের সেই ক্রীড়া জগতের একটি প্রচ্ছদ ছবি ঘুরছে সামাজিকমাধ্যমে। সেখানে খুরশিদা নামে একজন নারী ক্রীড়াবিদ সম্ভবত তিনি জিমন্যাস্ট ছিলেন তার ছবিকে ঘিরে কভার স্টোরি করা হয়েছে। স্টোরির শিরোনামটি ছিলো, ‘আরো খেলার মাঠ চাই’।
জিমন্যাস্টের পোশাক ফুটবলের পোশাকের চাইতেও ছোট। আর সেই ছোট পোশাকের ছবিতেই কভার স্টোরি করা হয়েছে, কই তখন তো পোশাক নিয়ে এত আলাপ হয়নি, এখন কেন? এত বছরে কি আমরা এগুলাম না পেছালাম; সেই ক্রীড়া জগতের প্রচ্ছদ ও প্রচ্ছদের গল্প আমাদের এই প্রশ্নের সমুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। যার উত্তর দেবার মতন সাহস অনেকেরই নেই। কেন নেই, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটাই বর্তমান অবস্থা নিরসনে সবচেয়ে বেশি জরুরি। সবকিছু মিলিয়ে দেখার শেষ সময় এখন। এর পরে হলে বড় দেরি হয়ে যাবে।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।
স্পোর্টসমেইল২৪/আরএস