ক্রিকেটার সাকিবের স্ত্রী শিশিরের বক্তব্যটা আমাকে নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে এবং তা আমাদের দেশের এক শ্রেণির অতি ইন্দ্রিয়প্রবণ মানুষের সম্পর্কে। এসব মানুষরা কথায় কথায় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এমন সব কাণ্ড ঘটান, যা আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
প্রশংসা আর নিন্দা মিলেই সমাজ। নিন্দাকে গ্রহণ করার মধ্যেই রয়েছে স্বার্থকতা। শিশিরের বক্তব্য এমন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই। এ বক্তব্য অতি ইন্দ্রিয় প্রবণদের জন্য জরুরি বার্তা হিসাবে কাজ করতে পারে।
সাকিবের বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে কিছু রুচির বাইরে করা মন্তব্য ঘিরে সামাজিকমাধ্যমে বেশ কথা হয়েছে। সে ব্যাপারেই মা হিসাবে শিশিরের মন্তব্য ছিল একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের। শিশির বললেন, ‘কী হচ্ছে তা আমি খেয়ালও করিনি কারণ, এতে আমরা বিব্রত হইনি। পাবলিক ফিগার হিসেবে আমাদের অনেক ফ্যান ফলোয়ার্স আছেন, অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী যেমন আছেন তেমনি কিছু লোক আছেন যারা পছন্দ করেন না; এটা সম্পূর্ণ একটা প্যাকেজের মতো। আমরা সবসময় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকি এবং এটা ভালো। বিশ্বের অনেক সেলেব্রিটি অনেক গুরুতর বিষয় ফেস করেন কিন্তু অন্য দেশগুলোতে তাদের এতোটা সময় নেই যে, হাজারো ভালো কমেন্টের মধ্য থেকে ৪/৫টা খারাপ কমেন্ট খুঁটে খুঁটে বের করবে।’
অতি ইন্দ্রিয়প্রবণরা বার্তাটি ভালোভাবে বুঝে দেখতে পারেন। হাজারও মানুষের মধ্যে সব মন্তব্যই মানের পরিমাপে উৎরে যাবে এমন আশা করাটা বৃথা। সেলিব্রেটিদের মিত্র যেমন থাকে নিন্দুকও তেমন থাকে। এটাই স্বাভাবিক। মেজর সিনহা হত্যার মূল বিষয় বাদ দিয়ে অনেকেই শিপ্রাকে নিয়ে টানাটানি করছেন, সাকিবের মেয়েকে নিয়ে মন্তব্যকারীরা সেই শ্রেণিরই। ভালো লাগা, মন্দ লাগা সাকিবকে নিয়ে সেখানে তার পরিবারকে টেনে আনাটা নোংরামি। মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডে শিপ্রার ব্যক্তিজীবন জড়ানোটাও তাই।
শিশিরের বক্তব্যের পরের অংশটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘আমি ওই সকল মন্তব্যকারীদের নিয়ে ভাবছি না, কারণ সেগুলোতে আমরা বিব্রত হইনি বরং ওই সকল পেজের এডমিনদের নিয়ে ভাবছি যারা ওই চারটা কমেন্ট খুঁজে বের করে ছোট্ট একটা বিষয়কে বড় করে তুলেছে।’
তিলকে তাল বানানোর প্রক্রিয়া আমাদের সমাজে আগে থেকেই ছিল এবং তাল বানানোর প্রবাদটিই তার প্রমাণ। কিন্তু এই তিলকে তাল বানায় কারা। খেয়াল করে দেখবেন এর পেছনে কাজ করে ‘ক্যানিবাল’ চিন্তাধারা। হয়তো সাকিবের বাচ্চাকে নিয়ে নোংরা একটা কথা বলা হয়েছে। বিপরীতে সেই কথাকে কেন্দ্র করে যে বলেছে তাকে দেখে নেওয়ার যে জিঘাংসা তা স্বাভাবিক নয়। কাউকে গালি দেওয়ার অপরাধে তাকে জেলে পোরা কিংবা তাকে অ্যাসাসিনেশনের চিন্তাই ক্যালিবালিজমকে ধারণ করে। এই চিন্তা নরভোজি চিন্তা। শিশিরের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নিয়েই ভাবা উচিত যারা এই তিলকে তাল বানানোর কাজ করেন, করছেন।
আমাদের দেশে কিছু মানুষ অতি ইন্দ্রিয়প্রবণ হয়ে উঠেছেন। তাদের অনুভূতি এতই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে যে, তিল পেলেই তাকে তাল বানাতে উঠে-পড়ে লাগছেন তারা। তবে এই প্রবণতার মূল কারণ হচ্ছে ব্যক্তি পর্যায়ের ঈর্ষা এবং ক্ষোভ। ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’, এমন ঈর্ষা থেকেই প্রতিপক্ষকে দমনের যাচনাই মূলত এসব ইন্দ্রিয়প্রবণতা। অনুভূতির আঘাত। কোনক্রমে যদি প্রতিপক্ষের কোনো একটা কিছু পাওয়া যায়, তাহলে আর যায় কোথা। একেবারে সারা জাহান জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে যা মানুষের দৃষ্টিতেই আসতো না, তা একেবারে বায়স্কোপ বনে যায়। হাতেগোনা মানুষ যা জানতো, তা রীতিমত রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। এই যে একটা বিষয় পাড়া থেকে রাষ্ট্র করার জন্য যারা দায়ী, নিন্দুকের চেয়েও তারা বেশি ক্ষতিকর।
এই যে যারা শিপ্রার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্য করছেন, তারা কী ঠিক করছেন। ধরলাম শিপ্রার লাইফ-স্টাইল অন্যদের থেকে আলাদা। সে সিগারেট খায়, হয়তো মদও খায়। বাংলাদেশে কী আর কোনো নারী মদ বা সিগারেট খায় না? অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের হাল-হকিকত অনেকেরই জানা। তাদের ক্লাব-পার্টির খবর অনেকেই রাখেন। সুতরাং শুধু শিপ্রাকে টার্গেট করাটা নিশ্চিত বিশেষ উদ্দেশ্য বহন করে। এমনি অধিকাংশ অতি ইন্দ্রিয়প্রবণতা বিশেষ কিছুকে টার্গেট করেই। এর পেছনে উদ্দেশ্য থাকে।
ইন্দ্রিয়প্রবণতার এমন মচ্ছব বোঝাতে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পের উদাহরণটা ধরি। সামাজিক মাধ্যমে একটা ভিডিও ক্লিপ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। ট্রাম্পের একটি রাবারের মূর্তি যার পশ্চাতদেশ উন্মুক্ত। সেই পশ্চাতদেশে যে যেমন পারছেন লাথি মারছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতার রাষ্ট্রের প্রধান হয়েও ট্রাম্প কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেননি। ট্রাম্পের অনেক অসহনীয় পর্যায়ের কার্টুন আঁকা হয়েছে এবং গণমাধ্যম সেগুলো প্রকাশ করেছে। ট্রাম্পের ইন্দ্রিয় আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি।
এখানে শিশিরের কথার পুনঃউচ্চারণটা জরুরি। ‘পাবলিক ফিগারদের যেমন ফ্যান-ফলোয়ার থাকেন তেমনি নিন্দুকও থাকেন’। নিন্দা যিনি সফলভাবে সয়ে নিতে পারেন পাবলিক ফিগার হিসাবে তিনি ততটাই স্বার্থক। সে অর্থে শিশির অনেক পাবলিক ফিগারের থেকেই নিঃসন্দেহে স্মার্ট, নিঃসন্দেহে স্বার্থক।
লেখক : কাকন রেজা, সাংবাদিক-কলাম লেখক ও বিশ্লেষক।
[স্পোর্টমেইল২৪.কমে সকল মতামত লেখকের নিজস্ব। এর জন্য কর্তৃপক্ষ কোন দায় বহন করবে না। চাইলে আপনিও খেলাধুলার যেকোন বিষয় নিয়ে আপনার চিন্তা, যুক্তি বা মতামত লিখতে পারেন। আমরা আপনার মতামত তুলে ধরবো আমাদের পোর্টালে। লেখা পাঠাতে পারেন এই ঠিকানায়- sportsmailinfo@gmail.com]