যাক বাবা, বাঁচা গেল!
‘কিলার’ মিলারের দ্রুততম ‘খুনে’ সেঞ্চুরি আর আমলার হামলা চালানো ইনিংসে দিশেহারা দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বড় হারে শেষ হওয়ার পর মুখ ফুটে না বললেও মনে মনে হয়তো এভাবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে থাকবে বাংলাদেশ দল।
মুশফিক-ইমরুল-মাহমুদউল্লাহ-সাব্বির, এরা নিশ্চয় একটু বড় করেই হাঁফ ছেড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সমাপ্তি হওয়ায়! এই চার খেলোয়াড়ের নাম আলাদাভাবে বলার কারণ, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে তাঁদেরই সৌভাগ্য হয়েছে তিন সংস্করণে টানা ৭টি ম্যাচ খেলার এবং দূর্ভাগ্য হয়েছে সবগুলো হার হজম (পড়ুন বদহজম) করার।
টাইম মেশিনে চড়ে একটু পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে বাংলাদেশ দলের কাছে কিন্তু খুব বেশি চাওয়া ছিল না। প্রোটিয়াদের দেশ থেকে সিরিজ জিতে আসতে হবে, এরকম বাড়াবাড়ি প্রত্যাশার বোঝা কেউ চাপিয়ে দেয় নি খেলোয়াড়দের মাথায়। অন্তত একটি জয়, সাথে হারার আগে না হারার লড়াকু মানসিকতা দেখানো; বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চাওয়া ছিল এইটুকুই।
কিন্তু, শেষ পর্যন্ত চাওয়া-পাওয়ার মাঝে থেকে গেল আসমান-জমিন ব্যবধান! প্রথম টি-টোয়েন্টিতে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শুধু ব্যতিক্রম; নইলে অন্য সব ম্যাচেই জুটেছে একতরফা পরাজয়! সোজা কথায় যাকে বলে অসহায় আত্নসমর্পন! ইনজুরিসহ নানা কারণে একটা ম্যাচেও সেরা একাদশ নিয়ে মাঠে নামতে পারেনি বাংলাদেশ, এটা স্মরণ রাখার পরও লজ্জা ঢাকার মতো আস্তরন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কই?
দক্ষিণ আফ্রিকা সফর যে কোনো দলের জন্যই কঠিন; বিশেষ করে উপমহাদেশের দলগুলোর জন্য তো অবশ্যই। এই বাস্তবতা মেনে নেয়ার পরও কথা থেকে যায়। খারাপ খেলা ও বাজে পারফরম্যান্সেরও তো একটা সীমা থাকে, নাকি? বাংলাদেশ বল করতে নামলে দেখা গেছে ব্যাটিং স্বর্গ, কী দাপটে রান তুলে নিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা।
আবার ব্যাট করতে নামলে মুহুর্তেই তা হয়ে গেছে বধ্যভুমি, বিপক্ষের বোলাররা চটজলদি তুলে নিয়েছেন উইকেট! আচ্ছ্বা, ভালো ফিল্ডিং ও ক্যাচ নেয়ার ক্ষেত্রে তো উইকেটের কোনো ভুমিকা থাকে না। তাহলে সেখানটাতেও এমন লেজেগোবরে করলো কেন খেলোয়াড়রা? যেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরুর দিনগুলোই মনে করিয়ে দিল বাংলাদেশ!
যদি কোনোভাবে সুযোগ থাকতো, তবে এমন একটা দূঃস্বপ্নের সিরিজ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার এবং খেলোয়াড়দের মন থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য বোধহয় কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করতে হলেও এতটুকু পিছপা হতো না বিসিবি! সেটাই যে অনেক ভালো হতো বাংলাদেশের জন্য! তাহলে অন্তত: বাংলাদেশের সুখের ঘরে দুঃখের আগুন এভাবে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতো না!
ফলে মানতে কস্ট হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই- বাংলাদেশের এতদিনে তিলে তিলে গড়া সুনামের ওপর ঝুলে গেছে বড় একটা প্রশ্ন চিহ্ন! সফরে আগাগোড়া নবীশের মতো খেলে অনেকটাই ধুলোয় মিশে গেছে পূর্বে অর্জিত মান-সম্মান। যদিও গত তিন বছরের সাফল্য রেকর্ডের পাতা থেকে মুছে যায় নি সত্যি; কিন্তু ‘বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ’- স্লোগানটি হয়ে গেছে কেমন যেন অর্থহীন! দলীয় সংহতি ‘সুবোধের মতো’ পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ দলটা এখন বুঝি ছন্নছাড়া একটা তরী! যার গন্তব্য কোথায়, সে নিজেই জানে না!
সব হারানোর সিরিজে অপ্রাপ্তির মিছিলে অনেক রহস্যের আনাগোনা! যা আগেই দেশে ফেরা মাশরাফির ভাষায় ‘বিপদ সংকেত’ এবং সাকিবের মতে, ‘পরাজয়ের ভাইরাস’!
পুরো সিরিজের অংক মেলাতে তাই মোটেই বেগ পেতে হচ্ছে না! কেন এমন হলো, কী কারণে এই বিপর্যয় দলের, কোনোরকম ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে সব! একটা লাশের পুরো শরীরই যদি ঝাঁঝরা হয়ে যায় বুলেটের আঘাতে, তবে মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তো খুব বেশি পোস্টমর্টেমের দরকার পড়ে না! দক্ষিণ আফ্রিকা মিশন শেষে তাই দায়ভারের চার্জশিট শুধু ব্যাটসম্যান, বোলার কিংবা ফিল্ডারদের কারও একার বিপক্ষে যাচ্ছে না।
ব্যর্থতার কাঠগড়ায় বাংলাদেশের ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং; তিন বিভাগই। চলতি বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ পরপর আটটি ম্যাচ হারলেও সেখানে কিছু দলীয় অর্জন ছিল। কিউইদের দেশে গর্ব করার মতো ব্যক্তিগত সাফল্যের খোঁজও মিলেছে। কিন্তু এবার প্রোটিয়াভুমি থেকে ফেরাটা যে হচ্ছে শুন্যহাতে একেবারে ভিখারীর বেশেই!
নিউজিল্যান্ড ৭ : বাংলাদেশ ০! খুবই নীরিহ এই রেজাল্ট শিটের কী সাধ্য আছে বাংলাদেশ দলের অসহায়তা আর হতাশার পুরো চিত্র তুলে ধরে? এর পরতে পরতে জড়িয়ে কত দূঃস্বপ্ন, ব্যর্থতা আর লজ্জার করুণ গল্প! ক্রিকেটে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের যোগফলই দলীয় সাফল্যের নিয়ামক। মুশফিকের ওয়ানডে সেঞ্চুরি, সৌম্য সরকারের দুটো টি-টোয়েন্টি ইনিংস, আর রুবেলের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে চার উইকেট বাদ দিলে ব্যাটিং-বোলিংয়ে বাংলাদেশের শোচণীয় ব্যর্থতার কংকালই বেরিয়ে পড়েছে।
মাঠের দূঃসহ পারফরম্যান্সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও অনেক কিছুই ঘটেছে যা একদিকে যেমন দূঃখজনক, তেমনি লজ্জারও। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে একটি ফিফটি বাদে ওপেনার ইমরুল কায়েস হতাশ করেছেন। পাশাপাশি টেস্টে মুমিনুল এবং ওয়ানডেতে তামিমকে আউট করিয়েছেন ননস্ট্রাইক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ‘অন্ধ’ সেজে রিভিউ নিতে অনুৎসাহিত করে।
তামিম ইকবাল প্রস্তুতিতে কোচের দিকে ব্যাট ছুঁড়ে মেরে সঙ্গে ঘাপলা বাঁধিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এক ফাঁকে নাসির, শফিউল ও তাসকিন ক্যাসিনো কান্ড ঘটিয়ে রাতে রুমে ফিরেছেন নির্ধারিত সময়ের পর। টেস্ট ও ওয়ানডেতে উইকেট পড়তে না পেরে ম্যাচের পর ম্যাচ টস জিতে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েই গেছে বাংলাদেশ।
প্রথম টেস্টের পর মিডিয়ার সামনে বিস্ময়করভাবে মুশফিক প্রকাশ্যে সেই যে বোলারদের তুলোধুনো করলেন, ফল হিসেবে পুরো সিরিজেই তারা গনধোলাই খেয়েছেন। এছাড়া টেস্ট চলার সময় দিনশেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে সাব্বির-তাসকিনরা এক একজন যে পরস্পর বিপরীতধর্মী ও উদ্ভট সব কথাবার্তা বলেছেন, তা কৌতুকের মতো বিনোদন জুগিয়েছে সবার! চাইলে এই তালিকা আরও লম্বা করা যায় অনায়াসে!
সব মিলিয়ে কী দাঁড়ালো?
নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামনে দুলছে বিপদ সংকেত! তবে চুড়ান্ত সর্বনাশ অবশ্যই হয়ে যায়নি! প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ অন্যান্য বিপদের পূর্বাভাস পেলে আমরা কী করি? আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহন করি, পূর্বেই প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা করি মোকাবেলা করার।
কিংবা হঠাৎ এসে যদি সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়ও; তারপরও প্রানপনে চেস্টা থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর। তাতে বিপদ অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। এমনকি অনেক সময় প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে আগের চেয়ে ভালো জায়গায়ও ফেরা যায়!
তার মানে? সোজা কথায় মাথা ঠান্ডা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটা নিয়ে এখন নতুন করে ভাবা উচিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় চরম বিপর্যয়ের পর খেলাটা তো আর বন্ধ করে দেয়া যাবে না! ডিসেম্বরে আঙিনায় আসছে শ্রীলঙ্কা। ফলে কোথায় কী সমস্যা হয়েছে, ঘাটতিগুলো কোথায় তা চিহ্নিত করে প্রয়োজন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অবশ্যই দলে বিশাল অদল-বদল করে ভাঙচুরের খেলায় মেতে উঠে নয়!
শেষ করি একটা তরতাজা কৌতুক দিয়ে।
প্রশ্ন: তিন অধিনায়ক প্রথা চালু করে বাংলাদেশ দলের কী লাভ হলো?
উত্তর: পরাজয়গুলো ভাগ করে নিতে সুবিধা হয়েছে। কারও একার কাঁধে হারের বড় বোঝা চাপে নি। নেতৃত্বের ‘মজার’ বন্টনটা হয়েছে এমন- মুশফিক ২, সাকিব ২ এবং সিনিয়র হিসেবে মাশরাফির ভাগে ৩ পরাজয়!
হাসছেন? হাসুন! মাঠ এবং মাঠের বাইরে বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পারফরম্যান্সও কিন্তু হয়েছে হাস্যকর পর্যায়েরই। যা মনে করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘জিততে ভুলে যাওয়া’ দূঃসহ অতীতের স্মৃতি।
পূনশ্চ: জানা কথাই, সাফল্যের অনেক মা-বাবা। আর ব্যর্থতা এতিম। তাই চোখ থাকবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। বাংলাদেশ দলের দেশে ফেরার সময় নির্বাচনী ডামাডোলে ব্যস্ত বিসিবির কর্মকর্তাদের মধ্যে সেখানে কারা উপস্থিত থাকেন, কিংবা আদৌ কেউ থাকার দরকার মনে করেন কীনা; সেদিকে নজর না রেখে উপায় আছে।
লেখক : মাহবুব মিলন
[মতামত ক্যাটাগরির সকল লেখার দায় লেখকের, স্পোর্টমেইল২৪ কর্তৃপক্ষ এর দায় বহন করবে না।]