এশিয়ান কাপ ফুটবলের শিরোপা জয় করেছে কাতার। এটি একটি ক্রীড়ার জয় মনে হতেই পারে। এর ফলে দোহায় উদযাপনটিও ছিল উন্মাদনায় ভরা। কিন্তু এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান রাজনৈতিক সংকট আরো ঘণীভূত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানীতে প্রতিকুল পরিবেশে এই জয় প্রতিপক্ষ গ্রুপে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন গ্রুপে আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি জাপানকে ৩-১ গোলে হারিয়ে কাতার শিরোপা জিতে নেয়ার এক দিন পর এটা উপসাগরীয় কূটনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।
রিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো ক্রিস্টিয়ান কোয়েতেস উলরিচসেন বলেন, ‘টুর্নামেন্ট চলাকালে স্বাগতিক আবুধাবী যেভাবে কাতারের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, তার তর্জমা করলে এটিই দাঁড়ায় তারা দেশটির বিরুদ্ধে অবস্থান আরো জোরদার করতে চায়।
এশিয়ান কাপ জয়ের পর কাতার যদি সেটিকে আরো এগিয়ে নেয় তাহলে সেটি উপসাগলীয় অঞ্চলে আরো বিভক্তি ডেকে আনতে পারে। কাতারের এই জয়ে প্রকাশ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ওমান ও কুয়েত। এর মাধ্যমে তারা এটি জানিয়ে দিয়েছে যে কাতারকে একঘরে করার প্রচেষ্টার পক্ষে নেই তারা।’
আঞ্চলিক রাজনীতিতে ফুটবল :
প্রথমবারের মত কাতারের এশিয়ানকাপের শিরোপা জয়, একটি বিষ্ময়কর গল্প। বর্তমান সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। যা ভূ-রাজনীতি ও প্রতিবাদে সিক্ত। ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে যারা কাতারের সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছিল তাদের জন্য একটি সুমচিৎ জবাব।
এশিয়ান কাপের শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে তারা পরাজিত করেছে রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশ নেয়া তিনটি দলকে। এ সময় প্রতিপক্ষের জালে তারা গোল করেছে ১৯টি। বিপরীতে মাত্র একটি গোল হজম করেছে। টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতা ও গোল রক্ষকের পুরস্কারও জিতে নিয়েছে কাতারীরা।
এটি সম্পদশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির বিপুল অর্থ ব্যয়ে মেধাবী ফুটবলারদের গড়ে তোলার ফসল। ২৩ দলের স্কোয়াডের ১৩ জনই এসেছে একাডেমী থেকে। যাদের মধ্যে আছেন টুর্নামেন্টের সর্বাধিক গোলদাতা আলী আলমোয়েজ। তবে এটি ক্রীড়ার চেয়েও বেশি কিছু।
২০১৭ সালের জুনে দোহার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে রেখেছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কটি দেশ। সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয়া এবং রিয়াদের প্রতিপক্ষ তেহরানের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যই কাতারকে বয়কট করে প্রতিবেশী দেশগুলো।
তবে বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে কাতার। তাদের দাবি, স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করার কারণে তাদেরকে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তারা দোহার শ্বাসনতন্ত্রেরও পরিবর্তন চায়।
এর ফলে খুব কম সংখ্যক কাতারী সমর্থক আরব আমিরাতে গিয়ে নিজ দলের খেলা উপভোগ করেছে। টুর্নামেন্ট চলাকালে যে সব দর্শক কাতার ফুটবল দলকে সমর্থন যুগিয়েছে তাদের বেশিরভাগই ওমানের নাগরিক। তারা ওমানের পতাকা নিয়েই কাতারকে সমর্থন করেছে।
টুর্নামেন্টে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারানোর কারণে কাতার ফুটবল দলকে হজম করতে হয়েছে প্লাস্টিকের বোতল ও জুতার আক্রমণ। আরব আমিরাতের বিপক্ষে কাতারিদের ৪-০ গোলের জয়টি ছিল শিরোপা জয়ের চেয়েও বেশি কিছু। উলরিচসেন বলেন, বয়কটকারী প্রতিবেশী দেশটির বিপক্ষে জয়ের পর কাতারিরা উদযাপনের সময় প্রদর্শন করেছে চারটি আঙ্গুল। তাদের ওই উদযাপন মিলে গেছে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকদের উদযাপনের সঙ্গে। ২০১৩ সালে মোহাম্মদ মুরসির সমর্থকরা এভাবেই নিজ দলকে সমর্থন জানিয়েছিল।
এখানে আরো অনেক কিছু ঘটতে পারে বলে মনে করছেন এস. রাজারাতনাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের সিনিয়র ফেলো ও লেখক হামেস এম. দর্সি। তিনি বলেন, ‘এই জয়ে কাতার নিজস্ব ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। সেখানে যত রকম প্রতিবন্ধকতা থাকুকনা কেন।’
সালফোর্ড ইউনিভারসিটির প্রফেসর সিমন চাদভিক বলেন, কাতারের এই জয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাদের ভাবমূর্তি বাড়াতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘কাতারের ভাবমুর্তি ও সম্মান বেড়েছে, যা তাদেরকে প্রতিপক্ষের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দেবে’।
২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতারের সামালোচকদের মুখেও এই জয়ের মাধ্যমে কুলুপ এটে দিতে পেরেছে দেশটি। দর্সি বলেন, ‘কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতাকারী সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের বিপক্ষে এটি কাতারের প্রাথমিক জয়।’
২০২২ বিশ্বকাপে ৩২টি দল অংশ নেবে নাকি এর সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৮টি দলে উন্নীত করা হবে সে বিষয়ে ফিফা আগামী মাসে সিদ্ধান্ত নেবে। আর এতে কাতার তাদের সহ-আয়োজক হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোকে বেছে নিতে পারবে।
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো মনে করেন বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যম আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমন করা সম্ভব। আর এটিকে ‘খুবই স্বাভাবিক’ মনে করছেন দর্সি। তার মতে, ‘রাজণীতি ও ক্রীড়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত’।