কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে উঠেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। এর আগে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ২-২ গোলে সমতা থাকার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও কোনো দল গোল করতে পারেনি।
নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ২০১৪ সালের পর আবারও সেমি-ফাইনালে উঠলো দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। সে আসরের ফাইনালে খেললেও রার্নাস-আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আর্জেন্টিনাকে। এর আগে ২০১৮ সালে শেষ ষোলোতে থেকে মিশন শেষ করেছিল তারা।
শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) দিনগত রাতে (বাংলাদেশ সময়) লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত কোয়ার্টার ফাইনালে মিডফিল্ডার রডরিগো ডি পলের খেলা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও তাকে মূল একাদশে রেখে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা। তবে শুরুর একাদশে সুযোগ হয়নি দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য অ্যাটাকার অ্যাঞ্জেলো ডি মারিয়ার।
ম্যাচে শুরুতে কোন দলই তেমন আক্রমণ করতে না পারলেও ২২ মিনিটে আক্রমণে যায় আর্জেন্টিনা। ডান-প্রান্ত দিয়ে মেসিকে পাশ দেন মিডফিল্ডার রডরিগো ডি পল। বল পেয়ে নেদারল্যান্ডসের দুই খেলোয়াড়কে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে বাঁ-পায়ে শট নেন মেসি। শটটি ঠিক-ঠাক মতো না হওয়ায় নেদারল্যান্ডসের গোলবারের উপর দিয়ে চলে যায়।
পরক্ষণেই পাল্টা আক্রমণে যায় নেদারল্যান্ডস। স্ট্রাইকার মেমফিস ডিপের কাছ থেকে বল পান আক্রমণভাগের আরেক খেলোয়াড় স্টিভেন বার্গুইন। তবে তার ভুল শট আর্জেন্টিনার গোলবারের পাশ দিয়ে চলে যায়।
ম্যাচের ৩৩তম মিনিটে মিডফিল্ডারদের পরিকল্পনায় ডান-প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ করেন আর্জেন্টাইন মধ্য মাঠের খেলোয়াড় এ্যালেক্সিস ম্যাক এ্যালিস্টার। বল পাস দেন মেসিকে। তার সামনেই থাকা মিডফিল্ডার রডরিগো ডি পলকে বল দেন মেসি। ডি পলের দুর্বল শট নেদারল্যান্ডসের গোলরক্ষক আন্দ্রিয়েস নোপার্টের হাতে জমা পড়ে।
এরপর মেসির বুদ্ধিদীপ্ত পাশে গোলের দেখা পায় আর্জেন্টিনা। ডি পলের কাছ থেকে বল পান মেসি। মেসি বল পেতেই তাকে ঘিরে ধরেন নেদারল্যান্ডসের চার জন ডিফেন্ডার। বল নিয়ন্ত্রণে রেখে বাঁ-দিকে সরে গিয়ে ডান-দিকে খালি জায়গা তৈরি করেন মেসি। সেখানে ছিলেন ডিফেন্ডার নাহুয়েল মোলিনা। দুর্দান্ত কোনাকুনি শটে ডান-দিকে থাকা মোলিনোকে বল দেন মেসি।
বল পেয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে নেদারল্যান্ডসের গোলরক্ষকের ডান দিক থেকে বলকে জালে পাঠান মোলিনা (১-০)। দেশের হয়ে ২৪তম ম্যাচে দ্বিতীয় গোল করেন মোলিনা।
বিরতিতে যাওয়ার কয়েক মিনিট আগে মেসির পায়ে বল এলে আবারও তাকে ঘিরে ধরেন নেদারল্যান্ডসের চারজন ডিফেন্ডার। তাদের ডজ দিয়ে নেদারল্যান্ডসের গোলমুখে শট নেওয়ার পথ তৈরি করেন তিনি। কিন্তু তার দুর্বল শট গোলরক্ষকের হাতে গিয়ে জমা পড়ে।
প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে প্রথম মিনিটে নেদারল্যান্ডসের একটি আক্রমণ দক্ষতার সাথে গোলবার ছেড়ে সামনে এগিয়ে এসে তা প্রতিহত করেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। শেষ পর্যন্ত মোলিনার গোলে এগিয়ে থেকে ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ করে আর্জেন্টিনা।
প্রথমার্ধে ৫৭ শতাংশ বল দখলে নিয়েও আর্জেন্টিনার গোলমুখে কোন শটই নিতে পারেনি ডাচরা। বল দখলে পিছিয়ে থাকলেও ডাচদের গোলমুখে পাঁচটি মধ্যে ৩টি অন-টার্গেটে শট করে আর্জেন্টিনা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে বল দখলের লড়াইয়ে মরিয়া ছিল দু’দল। এর মধ্যে দু’বার আক্রমণ রচনা করেও নিজেদের ভুলে সাফল্যের দেখা পায়নি আর্জেন্টিনা। বক্সের কাছে গিয়েও ৬৩ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি-কিক পায় আর্জেন্টিনা। মেসির নেওয়া ফ্রি-কিক নেদারল্যান্ডসের কর্নারের উপরের বার ঘেষে চলে যায়।
৭১তম মিনিট নিজেদের বক্সের মধ্যে নেদারল্যান্ডস ডিফেন্ডার ডেনজেল ডামফ্রাইস আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডা মার্কোস এ্যাকুনাকে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। পেনাল্টি থেকে গোল করেন গ্রুপ পর্বে পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে স্পট-কিক থেকে গোল করতে ব্যর্থ হওয়া মেসি। ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা।
এ গোলের মাধ্যমে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ ১০ গোল করা গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে স্পর্শ করলেন মেসি। বাতিস্তুতা ও মেসির গোল সমান ১০টি করে। ২০০৬ সালে ১টি, ২০১৪ সালে ৪টি এবং ২০১৮ সালে ১টি গোল করেছিলেন মেসি। এবারের বিশ্বকাপে ইতিমধ্যে চারটি গোল করেছেন মেসি।
ম্যাচের ৮৩তম মিনিটে দারুণ এক আক্রমণ থেকে গোলের ব্যবধান কমায় নেদারল্যান্ডস। স্টিভেন বার্গুইসের ক্রস থেকে দারুণ হেডে গোল করে স্ট্রাইকার ওট ওয়ের্স্ট ব্যবধান কমান। ব্যবধান কমানোর পর আক্রমণের তোপে আর্জেন্টিনাকে চেপে ধরে নেদারল্যান্ডস।
ইনুজরি সময়ে ১০ মিনিট যোগ করা হয়। শেষ মিনিটে আর্জেন্টিনার বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি-কিক পায় নেদারল্যান্ডস। ছোট ফ্রি-কিক সামনে পাশ দেন মিডফিল্ডার টিয়ান কুপমেইনার্স। তার বল ধরে বাঁ-পায়ের শটে গোল করলে দলকে নিশ্চিত হার থেকে রক্ষা করেন ওয়ের্স্ট। ২-২ সমতায় শেষ হলে ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়।
সেখানে ১০৪ মিনিটে মেসির ফ্রি-কিক থেকে নেদারল্যান্ডসের গোলরক্ষককে একা পেয়েও বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি ডিফেন্ডার নিকোলাস ওটামেন্ডি। ১১২ মিনিটে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন ডি মারিয়া। ডি মারিয়া নামার পর আজেন্টিনার আক্রমণের ধার বেড়ে যায়।
১১৪ মিনিটে ডি মারিয়ার পাশ থেকে বল নেদারল্যান্ডসের গোলমুখে শট নেন স্ট্রাইকার লটারো মার্টিনেজ। তবে তার শট প্রতিপক্ষের গায়ে লেগে প্রতিহত হয়। ১১৯ মিনিটে ডি মারিয়ার পাশ থেকে আবারও বল পেয়ে গোলমুখে শট নেন মার্টিনেজ। কিন্তু সেটিও প্রতিহত করেন নেদারল্যান্ডসের গোলরক্ষক।
শেষ মিনিটে এনজো ফার্নান্দেজের শট নেদারল্যান্ডসের গোলবারে লেগে ফিরে আসে। অতিরিক্ত সময় শেষেও ২-২ সমতা থাকায় ম্যাচটি গড়ায় টাইব্রেকারে।
সেখানে নেদারল্যান্ডসের প্রথম দুই শটই রুখে দেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক মার্টিনেজ। আর প্রথম দুই শটে গোল করে আর্জেন্টিনা।
তৃতীয় শটে গোল করে নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনা। এতে টাইব্রেকারে প্রথম তিনটি করে শট শেষে ৩-১ গোলে এগিয়ে থাকে আর্জেন্টিনা।
চতুর্থ শটে গোল করে নেদারল্যান্ডস। কিন্তু চতুর্থ শটে গোল পায়নি আর্জেন্টিনা। এতে ৪টি করে শট শেষে ৩-২ গোলে এগিয়ে থাকে আর্জেন্টিনা। পঞ্চম শটে গোল করে ব্যবধান ৩-৩ সমতা করে নেদারল্যান্ডস। এতে সমীকরণ দাঁড়ায় শেষ শটে গোল করলেই ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠবে আর্জেন্টিনা।
শেষ শট থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে সেমিতে তুলেন লটারো মার্টিনেজ। পাঁচটি করে শট শেষে ট্রাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালের বাঁধা টপকায় আর্জেন্টিনা।
সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে হারিয়ে কোয়াটারফাইনাল নিশ্চিত করেছে ক্রোয়েশিয়া।
স্পোর্টসমেইল২৪/আরএস