২০২১ সালের আগস্ট, আচমকাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়লো বার্সেলোনা ছেড়ে যাচ্ছেন লিওনেল মেসি। হয়তো খবরটা দেখে বার্সেলোনা সমর্থকরা গুজব ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রথমে।
এরপর বার্সেলোনার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বার্তা দেওয়া হলো, কাতালান ক্লাবটির সঙ্গে মেসির সত্যিই ১৭ বছরের পথচলা শেষ হচ্ছে। মনে হয় না কোনো বার্সেলোনা ভক্ত এটা সহজভাবে হজম করতে পেরেছিলেন।
টানা ১৭ বছর একই ক্লাবে খেলা চাট্টিখানি কথা নয়! কিশোর মেসি থেকে সর্বকালের সেরা মেসি হওয়াও তো বার্সেলোনার জার্সি গায়েই! তবে যা হয়েছে সেটা তো আর মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বার্সেলোনা ছাড়ার পর মেসির ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেই’তেই যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
কয়েকদিন পরেই সেটাই সত্যি হলো। পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো বার্সেলোনার বাইরে অন্য কোনো ক্লাবের জার্সি উঠলো মেসির গায়ে। দেখতে অদ্ভুত লাগলেও সেটাই পরে আস্তে আস্তে বাস্তব হয়ে উঠলো।
পারেদেসকে খুন করতে চেয়েছিলেন মেসি!
লা-মাসিয়ার সময়টুকু হিসেব করলে বার্সেলোনায় মেসি কাটিয়েছেন এক কুড়ি বছর। প্রায় দুই যুগ পর নতুন দেশ, নতুন ক্লাব, নতুন লিগ, নতুন দল, নতুন পরিবেশ যে কারো জন্যই মানিয়ে নেওয়া কঠিন হবে অবশ্যই।
এছাড়া ঠিক ওই সময়েই করোনা ভাইরাসেও আক্রান্ত হন মেসি। সবকিছু মিলিয়ে ফরাসি ক্লাবটিতে অভিষেকে সময়টুকু খুব একটা সহজ ছিল না আর্জেন্টাইন খুদে যাদুকরের জন্য।
অভিষেক মৌসুমটাও খুব একটা ভালো কাটেনি। বলা ভালো, মেসি ‘মেসি’ হয়ে উঠতে পারেননি। নতুন পরিবেশে নতুন দলে ভাগ্য বিধাতাও মেসির সঙ্গে ছিল না হয়তো। না হলে এক মৌসুমে কেনো একটা লোকের গোটা দশেক গোলমুখি শটই গোলপোস্টে আঘাত করে ফিরে আসবে!
ফ্রেঞ্চ লিগে প্রথম মৌসুমে ২৭টি ম্যাচে মাঠে ছিলেন মেসি। গোল করেছেন মাত্র ৬টি! মেসির ক্যারিয়ারে সবচেয়ে কম গোলের মৌসুম। চ্যাম্পিয়নস লিগেও মেসি ছিলেন নিষ্প্রভ, সাত ম্যাচে গোল করেন পাঁচটি। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে পিএসজি যখন হেরে বাড়ি ফিরছিল, কিছুই করতে পারেননি মেসি।
পিএসজিতে মেসির একটা নতুন অভিজ্ঞতাও হয়েছে, যদিও সেটা আক্ষরিক অর্থে তার জন্য অপমানজনক। পুরো ফুটবল ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো মেসিকে গ্যালারি থেকে দুয়োধ্বনি দেওয়া হয়েছে।
১৭ বছরের বার্সেলোনা ক্যারিয়ারে যে অভিজ্ঞতা হয়নি, সেটাই কিনা পিএসজিতে প্রথম মৌসুমেই হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে বার্সেলোনা সমর্থকরা মেসির কাছ থেকে একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
‘মেসি অসাধারণ খেলোয়াড়, তবে ম্যারাডোনার মতো নেতা নন’
যখন পিএসজিতে মেসির নিষ্প্রভ অভিষেক মৌসুম নিয়ে আলোচনা চলছে চারদিকে তখন মনে পড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কথা।
মেসির ক্যারিয়ার জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন পর্তুগিজ রাজপুত্র ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। যে কিনা ফার্গুসনেরই প্রিয় শিষ্য। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রোনালদোকে কোচিং করিয়েছেন তিনি।
ফুটবল বিশ্বের অধিকাংশ পণ্ডিত আজকের রোনালদোর পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেখেন ফার্গুসনের। বাবার আসনে বসানো ফার্গুসনের প্রতি রোনালদোরও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। নানা সময়ে নানা সাক্ষাৎকারে নিজের উত্থানের পিছনে ফার্গুসনের ভূমিকার কথা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
শেষ দেড় যুগের বেশি সময় ধরে ফুটবল বিশ্বের অন্যতম বিতর্কের বিষয়, কে সেরা, মেসি নাকি রোনালদো! এই বিতর্কে অনেকেই সামিল হয়েছেন, কেউ বেঁছে নিয়েছেন রোনালদোকে আবার কেউ বাঁ মেসিকে।
মেসি সারাজীবন এক ক্লাবে খেলেছেন বলে অনেকেই তাকে সেরা মানতে রাজি নন। তাদের মতে ভিন্ন ক্লাবে, ভিন্ন পরিবেশে পারফর্ম করতে পারলে তবেই তাকে সেরা মানা যায়।
তবে কি মেসি পারবেন ভিন্ন ক্লাবে পারফর্ম করতে! এর চেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল মেসি কি আদৌ অন্য কোনো ক্লাবে যাবেন! মেসির সঙ্গে বার্সেলোনার আত্মার সম্পর্ক! অবশ্য সেসব এখন অতীত। আর্থিক সংকটে পড়া বার্সেলোনা মেসিকে ধরে রাখতে পারেনি। মেসি এখন পিএসজির খেলোয়াড়, অন্য ক্লাব, অন্য পরিবেশ, অন্য দলের খেলোয়াড়।
তবে অভিষেক মৌসুমটা যে ভালো কাটেনি মেসির। যার কারণে মেসিকে নিয়ে ফার্গুসনের সেই মন্তব্য আবারো উঠে এসেছে আলোচনায়। ২০১৫ সালে কোনো এক আলোচনায় ফার্গুসন বলেছিলেন, “মানুষ যখন জিজ্ঞাসা করে কে সেরা (মেসি না রোনালদো), অনেকেই সহজেই মেসির নাম বলে দেন। কিন্তু রোনালদো মিলওয়েল, কুইন্স রেজার্স পার্ক ছাড়াও যেকোনো ক্লাবের হয়ে খেলতে পারে এবং হ্যাটট্রিক করতে পারবে। আমি নিশ্চিত নই মেসি পারবে কিনা!”
মেসি কথা বললে বাকি সবার চুপ করে থাকা উচিত: মার্টিনেজ
মেসিকে শুধুই বার্সেলোনা কেন্দ্রিক খেলোয়াড় মনে হয় তার। “রোনালদো দুই পায়েই সমান দক্ষ, সে দ্রুত গতির, শূন্যেও ভালো এবং সাহসীও বটে। মেসি সাহসী, তবে আমার মনে হয় সে শুধুই বার্সেলোনার খেলোয়াড়” যোগ করেন ফার্গুসন।
ফুটবল বিশ্বে তাই আলোচনার ভিড়, তবে কি মেসিকে নিয়ে ফার্গুসনের মন্তব্যই সত্য হবে। পিএসজি সভাপতি নাসের আল খেলাইফি অবশ্য মোটেও সেটা মনে করেন না। বরং তার মতে নতুন মৌসুমে মেসির সর্বকালের সেরা পাফর্মেন্স দেখবে বিশ্ব।
খেলাইফি বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর (মেসি) এটা সেরা মৌসুম নয়। কিন্তু ২০ বছরের বেশি সময় পর নতুন দেশ, নতুন শহর, নতুন দল, নতুন লিগে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। তার পরিবারের জন্যও নতুন পরিবেশ! এছাড়া সে করোনাতেও আক্রান্ত হয়েছিল। শেষ মৌসুমটা মেসির জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী মৌসুমে আমরা মেসি সর্বকালের সেরাটাই দেখবো।”
শুধু আল খেলাইফি নয় বিশ্বজুড়ে মেসি সমর্থকরাও এই আশায় দিন গুনছেন। মেসির ভালো একটা মৌসুমই কেবল পারে ফার্গুসনের ভবিষ্যৎবানী মিথ্যা প্রমাণ করতে। পারবেন কি মেসি? যদিও উত্তরটা সময় দিবে।
তারপরও লিগের শেষদিকে মেসির পারফর্মেন্স সমর্থকদের আশা দেখাচ্ছে। মেসির মতো চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়রা তো প্রতিকূল পরিবেশেই দাপট দেখানোর জন্য সেরাদের সেরা হয়ে ওঠেন। তবে কি মেসিও সেটা পারবেন! দেখা যাক…
স্পোর্টসমেইল২৪/এসকেডি