ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম শুনলে সবার আগে মাথায় আসে ‘সিআরসেভেন।’ সাত নম্বর জার্সি পড়ে নিজেকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরাদের তালিকায় নিয়ে গেছেন, তার মতে সেরা। সাত নম্বর জার্সিটাও যেন পর্তুগিজ রাজপুত্রের কল্যাণে অমরত্ব পেয়েছে।
এই সাত নম্বর জার্সি পড়েই মুড়িমুড়কির মতো গোল করেছেন। প্রতিপক্ষের রক্ষণ ধ্বংস করে দলকে জয় এনে দিয়েছেন। সাত নম্বরকে রীতিমতো ব্রান্ড বানিয়ে ছেড়েছেন। বিশ্বজুড়ে ‘সিআরসেভেন’ নামে তার ব্যবসায়ীক পণ্য দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।
অথচ জানেন কি, ক্যারিয়ারের শুরু থেকে সাত নম্বর তো পড়তেনই না এমনকি তার পছন্দের তালিকাতেও ছিল না। পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুতে পর্তুগিজ ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনে তার জার্সির পিছনে লেখা থাকতো ২৮ নম্বর।
২০০৩ সালে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমান। সেখানেও ২৮ নম্বর জার্সিই পড়ার কথা ছিল পর্তুগিজ সুপারস্টারের। স্বাভাবিকভাবেই সাত নম্বরের কথা মাথাতেও আসেনি তার।
প্রাক মৌসুমে অনুশীলনের মাঝে তখনকার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বস স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন রোনালদোকে সাত নম্বর জার্সি পড়ার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব শুনে প্রথমে খুব একটা সায় দেননি পর্তুগিজ গোলমেশিন।
কিন্তু ফার্গুসন হাল ছাড়েননি। রোনালদোর দ্বিমত দেখে তাকে এর আগে যেসব খেলোয়াড় ইউনাইটেডে সাত নম্বর জার্সি পড়ে খেলেছেন তাদের কথা বলেন। রোনালদোকে বোঝান, তার মধ্যেও সেই ক্ষমতা আছে সাত নম্বর জার্সি পড়ে ফুটবল মাঠে দাপট দেখানোর।
জানেনই তো, ফার্গুসনকে নিজের বাবার মতো সম্মান, শ্রদ্ধা করেন রোনালদো। ফার্গুসনও রোনালদোকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসেন। তাই ফার্গুসনের কথা ফেলতে পারেননি, রাজি হয়ে যান সাত নম্বর জার্সি পড়তে।
তখন কি ভেবেছিলেন এই সাত নম্বরের সঙ্গেই একদিন নাম জুড়ে হয়ে যাবে ব্রান্ড। যে ব্রান্ড সারাবিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াবে। রোনালদো না ভাবলেও গুরু ফার্গুসন হয়তো ঠিকই ভেবেছিলেন। সাত নম্বর জার্সি পড়েই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রথম দফার শেষ মৌসুমে প্রথম ব্যালন ডি’অর জিতেছেন রোনালদো।
২০০৩-০৪ মৌসুমের পর মাত্র এক মৌসুমে সাত ব্যতীত অন্য নম্বরের জার্সি পড়ে খেলেছেন রোনালদো। ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান তিনি।
তখন রিয়ালে সাত নম্বর জার্সি পড়ে খেলতেন ক্লাবের সর্বকালের সেরাদের একজন স্প্যানিশ ফুটবলার রাউল গঞ্জালেস। সদ্য সেরাদের দলে যোগ দেওয়ার দৌড়ে থাকা রোনালদো স্বাভাবিক ভাবেই রাউলের সাত নম্বর জার্সি পাননি। ২০০৯-১০ অভিষেক মৌসুমে ৯ নম্বর জার্সি পড়ে খেলেছিলেন তিনি।
মাত্র এক মৌসুম পরেই রাউল ক্লাব ছেড়ে গেলে সাত নম্বর পেয়ে যান রোনালদো। ওই সাত নম্বর জার্সি পড়ে রিয়ালের ৯ বছরের ক্যারিয়ারে রোনালদো যা করেছেন সেটা ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা হয়তো কারো নাও হতে পারে।
এই সাত নম্বর জার্সি পড়েই রিয়ালের সাদার জার্সিতে প্রতিপক্ষের জালে ৪৫১ গোল করেছেন রোনালদো। ৪৩৮ ম্যাচে করা এই গোলের রেশিও প্রতি ম্যাচে একটার বেশি গোল! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলেন বা সিআরসেভেন, তিনি তো ক্যারিয়ার জুড়ে অবিশ্বাস্য কাণ্ডই ঘটিয়ে চলেছেন।
রিয়ালের হয়ে টানা তিনবার সহ মোট চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন পর্তুগিজ অধিনায়ক। প্রত্যেকবারই রোনালদোর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
রিয়াল মাদ্রিদ অধ্যায় শেষে ২০১৮ জুভেন্টাসে পাড়ি জমান রোনালদো। সেখানে তাকে সাত নম্বর জার্সি ছেড়ে দেন জুভেন্টাসের কলম্বিয়ান ফুটবলার কুয়াদ্রাডো। পরবর্তীতে রোনালদো জন্য সাত নম্বর ছেড়ে রিতীমতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি।
জুভেন্টাসে ৩ বছর কাটিয়ে ২০২১ সালে ফিরে আসেন পুরোনো ঠিকানা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। এখানেও সাত নম্বর জার্সি ফাঁকা ছিল না, পড়তেন উরুগুইয়ান ফুটবলার এডিনসন কাভানি। সবার ধারণা করছিল এবার হয়তো রোনালদোকে আবার অন্য নম্বরের জার্সি পড়তে হবে। কিন্তু এবারও রোনালদোর জন্য জার্সি ছেড়ে দেন সতীর্থ কাভানি। তিনিও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সে সময়।
জাতীয় দল পর্তুগালেও প্রথম দিকে সাত নম্বর জার্সি পড়ে খেলার সুযোগ পাননি রোনালদো। পর্তুগালের সর্বকালের সেরাদের একজন লুইস ফিগো তখন সাত নম্বর জার্সি পড়ে খেলতেন। ২০০৪ সালের ইউরোতে পর্তুগালের হয়ে ১৭ নম্বর জার্সি পড়ে খেলেছেন রোনালদো।
৪২ বছর বয়সেও খেলে যেতে চান রোনালদো
পরবর্তীতে ফিগোর অবসরের পর রোনালদোর গায়ে ওঠে সাত নম্বরের জার্সি। পরবর্তীতে এই সাত নম্বর পড়ে পর্তুগালের সর্বকালের সেরা ফুটবল সাফল্য এনে রোনালদো। তার অধিনায়কত্বেই ২০১৬ সালে ইউরোতে ফ্রান্সকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে পর্তুগাল।
এই সাত নম্বর জার্সি পড়েই পর্তুগাল তো বটেই আন্তর্জাতিক ফুটবলেই সর্বোচ্চ গোলদাতার সিংহাসনে বসেছেন রোনালদো। আন্তর্জাতিক ফুটবলে পর্তুগালের হয়ে তার গোল সংখ্যা ১১৭।
সাত নম্বরকে এমন উঁচুতে নিয়ে গেছেন রোনালদো, তাতে করে তার নাম উচ্চারিত হলে সিআরসেভেনও উচ্চারণ করতে হবে! এমনকি রোনালদো যদি তার পরবর্তী সন্তানের নাম রাখেন ‘সেতে’ (পর্তুগিজ ভাষায় সাত) তাহলেও হয়তো কেউ আপত্তি করবেন না! করবেন? হয়তো না।
স্পোর্টসমেইল২৪/এসকেডি