ডালমিয়ার বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে খেয়েছিলাম দুপুরের খাবার। রাত পোহালেই কলকাতা ছাড়ব। ঢাকায় ফিরবো, ভাবতেই চনমনে হয়ে উঠছিল মন। ২৩ দিনের সফরের শেষান্তে চলে এসেছি। এর মাঝে অবশিষ্ট ভারতীয় রুপি টাকায় এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছিলাম (হুটহাট এসে পড়া দরকার মেটাতে কিছু ভারতীয় রুপি পকেটে রেখেছিলাম)।
বিলম্বিত মধ্যাহ্নভোজ শেষে চারজনই নিউ মার্কেটে ছুঁটলাম। কিছু কেনাকাটার জন্য। হোটেল থেকে নিউ মার্কেট কাছে বলে বেশি ক্লান্তি আসেনি। ঘুরে ঘুরে সামর্থ্য, সাধ্যের মধ্যে কিছু কাপড়-চোপড় কিনেছিলাম আমি। আগে থেকেই কম কম করে কিনেছি বলে শেষ দিনে তাড়া হয়নি খুব বেশি আমার।
সবচেয়ে কম কেনাকাটা করেছিল রামিন। প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন বলে রিপন ভাই ওই কয়েক ঘণ্ঠায় বেশ ভালো খরচ করেছেন নিউ মার্কেটে।
তবে খরচের হাত, পরিবার-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন সবার জন্য কেনাকাটায় পলাশ ভাই সবচেয়ে এগিয়ে। উনি পারেনও বটে। একটা সময় তার সঙ্গ ছেড়ে আমরা হোটেলে ফিরেছিলাম। খুঁজে খুঁজে প্রিয়জনকে খুশি করার প্রাণান্ত চেষ্টা দেখেছিলাম পলাশ ভাইয়ের মাঝে। উনার পছন্দও বেশ ভালো। রিপন ভাইও শেষ দিকে একা একা করেছেন শপিং করেছেন মা, বোনের জন্য।
শপিংয়ের পাঠ চুকিয়ে ফ্রি হতে হতে রাত সাড়ে ৯টা বেজে যায়। কে কি কিনলো, কেমন দাম, এসব নিয়ে দেখতে দেখতে আরও এক ঘণ্টা পার। এবার দ্রুত রাতের খাবার খেতে বের হলাম। বিখ্যাত খালেক হোটেলেই খেয়েছিলাম।
মারকুইস স্ট্রিটও তখন বেশ স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা থেকে আসা লোকজন বেশিরভাগই চলে গেছে।
বর্ধমানে নানা বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন নিউ এজের আতিফ আজম ভাই। বর্ধমান থেকে ফিরে রাতে হোটেলে এসে দেখা করে গিয়েছিলেন আতিফ ভাই। উনি আমাদের দু’দিন পর ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। জনকণ্ঠের মিথুন আশরাফ, যুগান্তরের জ্যোর্তিময় মন্ডল জ্যোতিও থেকে গিয়েছিল সেমিফাইনাল, ফাইনাল কভার করবে বলে। বাংলা ট্রিবিউনের রবি, রাইজিং বিডির ইয়াসিন কলকাতা থেকে ফ্লাইটে ঢাকা ফিরেছিল ২৯ মার্চ সকালে।
রাতে আবারও লাগেজ গোছানোর কাজ করতে হলো। রাত প্রায় একটার পর বিছানায় গেলাম আড্ডা, গল্পের পর।
বিআরটিসি-শ্যামলী মৈত্রী বাসের টিকিট ২৭ মার্চই করেছিলাম। পরে রিপন ভাই, রামিনও একই বাসের টিকিট কেটেছিল। তাই ফেরার পথেও এক সাথে চারজন ছিলাম।
খুব সকালে উঠলাম। ৯টায় বাস ছিল। হালকা নাশতা করার সুযোগও পেয়েছিলাম। তারপর মারকুইস স্ট্রিট থেকে বাসে সল্টলেক চলে যাই। সেখানেই মূল বাসটা ছিল।
লাগেজ বক্সে দেওয়াসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় ঘণ্টা দেড়েক পার হয়ে গেল। এখানে অবশ্য বাস আসতে বিলম্ব হয়েছিল, তাতেই সময়টা বেশি লেগেছিল।
তারপর শুরু ঢাকার পথে যাত্রা। জানালার পর্দা সরিয়ে আমি শহর কলকাতা দেখছিলাম। কিছু সময় কাটতেই এক হকার বাসে উঠলো। তার কথা মনোযোগ কেড়েছিল।
বেচারা চকলেট, আচার বিক্রি করে। খুব মিষ্টি-মিষ্টি কথায় পণ্যের গুণাগুণ বলছিল। আমি তখনও বাইরে তাকিয়ে। হকারটা একটার পর একটা চকলেট, আচার, এই সেই বড়ি, নানা আইটেম যাত্রীদের ফ্রি চেখে দেখার সুযোগ দিচ্ছিল।
আর বারবার বলছিল; দাদা, এটা দেখুন, ওটা দেখুন। এটাই শেষ, আর কিছু খাওয়াতে পারবো না, একটু চেখে দেখুন, মুখে আরাম পাবেন; জাতীয় কথাই বলছিল। আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার কথাও বলছিল।
শেষ বেলায় দুটি আইটেম আমিও খেয়েছি, ফ্রি। আমি আর কিছু কিনি নাই ওর কাছ থেকে। তবে যাত্রীদের কেউ কেউ কিনেছিল।
শহর কলকাতার সীমানা পার হতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ওরা দুবার বিরতি দিয়েছিল। সব মিলিয়ে বেনাপোল আসতে আসতে প্রায় বিকেল। বিআরটিসি-শ্যামলী মৈত্রীর যাত্রী বলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া গেল। আলাদা লাইনে কাস্টমসের কাজ সম্পন্ন হলো।
আগের মতোই হেঁটে জন্মভূমি বাংলাদেশে পা রাখলাম। বাংলাদেশে ঢুকেও কাস্টমসের কাজ শেষ করলাম। পরিচিত লোক থাকায় নির্বিঘ্নে এই পর্ব শেষ হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রবেশের পরই বাংলালিংক সিমটা আবারও চালু করলাম। বাড়িতে আম্মুর সাথে কথা বললাম। সবাইকে জানালাম, আমি বাংলাদেশে এসে গেছি। এই বলার মাঝেও একটা রোমাঞ্চ, অনুভূতি আছে। সেটা ঠিক ওই মুহূর্তেই টের পাওয়া যায়।
এবার যাত্রা শুরু ঢাকায় ফেরার।
বাস চলা শুরু করলো। বাসের সবাই ভাবছি, আলোচনা করছি ঢাকায় কখনো পৌঁছানো যাবে। বেনাপোল এলাকা পার হওয়ার পরই আবার বিজিবির চেক পোস্ট। তারাও মিনিট দশেক সময় নিল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। যশোর শহরের কাছাকাছি এসে বিরতি দেওয়া হলো। সকালের নাস্তার পর টুকটাক খাওয়া হয়েছে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল। দেশি কই, রুই মাছ, মোটা চালের ভাত, ডাল, বাজি-ভর্তা দিয়ে পেটপুরে খেয়েছিলাম। বলতে পারেন রীতিমতো গোগ্রাসে গিলেছিলাম আমরা।
রিপন ভাই অবশ্য কলকাতা থেকেই বলে আসছিলেন, তিনি যশোরে নেমে যাবেন। তার বাড়ি যে যশোর। কিন্তু একসাথে আসায় আমাদের ছেড়ে আর নামেননি যশোরে।
সন্ধ্যার আধারের বুক চিরে বাস চলতে শুরু করলো। ফরিদপুরে ঢুকতেই শুরু হলো দমকা হাওয়া, বৃষ্টি। ড্রাইভারকে বাস চালাতে হচ্ছিল বেশ সতর্ক হয়ে। রাস্তায় গাছের ডাল-পালা পড়েছে অনেক স্থানে।
এদিকে আমাদের চিন্তা যত দ্রুত ঢাকা পৌঁছানো যায়। সবার চাওয়া ছিল রাত ১২টায় হলেও ঠিক আছে। এরপরে হলে হয়তো বাস কাউন্টারেই রাতের বাকি সময় থেকে যেতে হবে।
পলাশ ভাইয়ের জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইক্রো আসবে। উনি বলছিলেন, এত রাতে বাসায় ঢুকতে সমস্যা হলে নারায়ণগঞ্জ চলে যেতে। সকালে আবার ঢাকায় আসতে।
দৌলতদিয়া ঘাটে আসার পর শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি আর ঝড়। যেই ঘাটে গিয়ে বাস থামলো, তখনই বাস বন্ধ করে দেওয়া হলো ঝড়ের কারণে। রাত তখন ১০টা পেরিয়েছে।
আধঘণ্টা পর পাশের আরেক ঘাটে ছোট একটা ফেরিতে উঠলো আমাদের বহনকারী বাস। বৃষ্টি তখনও চলছিল। ছোট ফেরি, দ্রুত চলে বলে মিনিট পঁচিশেক বা আধঘণ্টার মাঝেই নদী পার হলাম।
পাটুরিয়া ঘাট থেকে সাড়ে ১১টার দিকে আবার বাস চলা শুরু করলো। প্রায় দেড়টার দিকে গাবতলী আসলো। পলাশ ভাই কমলাপুর নামবেন। আমি, রিপন ভাই, রামিন গাবতলীতেই নামলাম।
২৩ দিন আগে মাঝ রাতে ভারত সফরের উদ্দেশে বাসে চড়েছিলাম কল্যাণপুর থেকে। ২৩ দিন পর সেই ধলপ্রহরের আগে ফিরলাম ঢাকায়।
মাঝে কথা হাসি-কান্না মুখর সময়, পর্যটকের বেশ, পেশাগত দায়িত্ব, প্রতিবেশি দেশের সৌন্দর্যে পুলকিত হওয়া, নানা অভিজ্ঞতা, ব্যস্ততায় ঠাসা ভ্রমণসহ সবকিছু যেন মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেসব ছাপিয়ে উঠলো দেশে ফেরার অপার, অপ্রকাশ্য তৃপ্তি-স্বস্তি।
রাত প্রায় দুইটা বেজে গেছে। বাসার গেট খুলবে না, এতো রাতে মালামাল নিয়ে যাওয়াটা ঠিক মনে করেননি রিপন ভাই। তাই উনি বাস কাউন্টারে রাতের বাকি সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
আমি, রামিন অনেক অনুরোধ করেও তাকে মিরপুরে আনতে পারলাম না। আমরা সিএনজি পেয়ে চলে আসলাম। মিরপুর স্টেডিয়ামের মেইন গেইটের উল্টো পাশে রামিনদের বাসা। আমার বাসায় ঢুকা সম্ভব হবে না বলে রাতটা রামিনের বাসাতেই কাটিয়ে দেই।
এরপর সকালে ঘুম ভাঙার পর ফিরে আসি নিজের বাসায়।
সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি
[sportsmail24.com এর ওয়েবসাইট এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও ব্রাউজ করে পড়তে পারবেন। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস থেকেও খেলাধুলার সকল নিউজ পড়তে পারবেন। ইনস্ট্রল করুন স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস ]