বিদায়... ‘বাপু’র ভক্ত ব্যাঙ্গালুরু

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১০:৩৫ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০২০
বিদায়... ‘বাপু’র ভক্ত ব্যাঙ্গালুরু

মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতের অবিসংবাদিত নেতা। ভারতের জাতির পিতা তিনি। ‘বাপু’ নামেও তাকে সম্বোধন করে থাকে ভারতীয়রা। আইটি ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া নামে খ্যাত ব্যাঙ্গালুরু শহর জুড়ে চিরঞ্জীব ‘গান্ধীজী’। শহরের নানা স্থানে, মোড়ে মোড়ে চোখে পড়ে গান্ধীর ছবি।

মহান এ নেতার জীবনাচরিত, উজ্জীবনী বক্তব্য, বাণী উদ্ধৃত আছে ওইসব পোস্টার, ব্যানারে। শহরের অভ্যন্তরে গান্ধীর উপস্থিতি একটা ভালো ধারণাই পাইয়ে দেয় ব্যাঙ্গালুরু সম্পর্কে। গান্ধী ভক্তি প্রদর্শনে এ শহরটা কম যাচ্ছে না, তা স্পষ্ট।

তবে এ শহরে সাতদিনের অভিজ্ঞতায় অবলীলায় বলে দেয়া সম্ভব, এখানকার অটো-ট্যাক্সি ড্রাইভাররা গান্ধী-বাদের পরিপন্থি। নীতিকথার অনুসারী নন বা এসবের ধারে-কাছেও পা মাড়ান না। এই শহরে যারা ভবিষ্যতে আসবেন তাদের জন্য কিছুটা সহায়ক হতে পারে আমার অভিজ্ঞতা। কারণ চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসেই বাংলাদেশের অনেক মানুষ যায় ব্যাঙ্গালুরুতে।

শহরবাসী, আগন্তুক, পর্যটক সবার ‘পকেট কাটায়’ সিদ্ধহস্ত এই চালকের দল। শহরের আমজনতা থেকে শুরু করে সবার কাছেই এরা দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে মূর্তিমান আতঙ্ক। বিভীষিকার অপর নাম বলতে পারেন।

অটো ড্রাইভারদের নিয়ে উচাটান, হতাশা থাকলেও লোকজন নিরুপায়। কারণ মটরবাইকের পর শহরের সবচেয়ে ব্যবহৃত বাহন অটো। শহরে এমনিতে মটরবাইক চালকের সংখ্যাই বেশি। প্রত্যেক ঘরে ঘরেই হয়তো অন্তত একটি করে বাইক আছে। ধনাঢ্যদের তো গাড়ি আছেই।

গান্ধীনগরে নিত্যই দেখতাম খাবার হোটেলে, আবাসিক হোটেলে, দোকানদাররা মোদ্দা কথা সিংহভাগ লোকই অটো ড্রাইভারদের মুন্ডুপাত করতো হরহামেশা।

নির্ধারিত মিটারে যেতে আগ্রহী চালকের সংখ্যা খুব কম। আপনি পথ-ঘাট না চিনলে তো আরও বড় বিপদ। আপনার সাথে মিটারে যাওয়ার কথায় রাজি হয়ে যাবে নিমিষে। তারপরও সহজে গমনের পথ বাদ দিয়ে আপনাকে ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে নিয়ে যাবে গন্তব্যে। ফলে অনায়সে ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যাবে!

ব্যতিক্রমও আছে। সেটি মুষ্ঠিমেয়। যারা ঠিকমতোই আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। এমনকি মিটারও ব্যবহার করবে।
অবশ্য এমন আতিথ্য পাওয়ার বিষয়টি ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। আর চুক্তিতে যেতে চাইলে আপনাকে গুণতে হবে মিটারের ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি।

এই মিশনে অটো ড্রাইভারদের বড় অস্ত্র হলো ভাষা। ব্যাঙ্গালুরুতে চলে তামিল ভাষা। শহরের অতিথিরা হিন্দি, ইংরেজিই ব্যবহার করেন। ড্রাইভারদের অনেকে আবার হিন্দি জানে। কিন্তু হিন্দিতে উত্তর দিবে না, বুঝলেও।

আপনি তামিল ভাষা না জানায়, আপনার সামনেই কারচুপির প্ল্যান করবে, আপনি বুঝবেন না। কোনো স্ট্যান্ডে একবার একজনের কথায় রাজি হননি, তো বিপদ বাড়বে। এরপর যত ড্রাইভার ওই স্ট্যান্ডে থাকবে সবাই প্রথমজনের পক্ষ অবলম্বন করবে। অথবা সে গিয়ে বাকিদের তামিল ভাষায় বলে দিবে সব। কাউকে না কাউকে বাড়তি টাকা আপনাকে দিতেই হবে।

আবার শহরের নিয়মও আছে, রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত যে কোনো গন্তব্যে মিটারের দেড়গুণ ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। শহরের শাসকরাই নাকি এ নিয়ম করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের সিএনজি ড্রাইভারদের মাঝেও এ প্রবণতা দেখা যায় নিয়মিত। তবে ব্যাঙ্গালুরু শহরের অটো ড্রাইভারদের মতো এত প্রবল নয়, এটা নিশ্চিত। ক’দিনের অবস্থানেই এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, অটো ড্রাইভারদের এ আধিপত্য বাদ দিলে ব্যাঙ্গালুরু শহর পছন্দ হবে সবার।

এখানে রোদটা কড়া। গ্রীষ্মকালে ত্রিশ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা সবসময় থাকে। জামা-কাপড়, শাড়ির জন্য এ শহর বিখ্যাত। দক্ষিণ ভারতের প্রসিদ্ধ শাড়ি পাওয়া যায় হাতের নাগালে থাকা মূল্যে। মহীশূর সিল্ক, সুরাঠ-মিরাঠ, চেন্নাই-হায়দরাবাদ থেকে আসে মহিলাদের শাড়ি। পুরুষ, শিশুদেরও বস্ত্র মিলবে ভালো দামে।

আনন্দ ফূর্তিতেও ব্যাঙ্গালুরু পিছিয়ে নেই। শহরটা অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। পানশালা রয়েছে প্রায় প্রত্যেক গলিতেই। সেখানে লোকের সমাগমও অনেক হয়। আমোদ-প্রমোদের ব্যাঙ্গালুরু ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে মাঝ রাত পেরিয়ে যায়।

ভারতের বিরুদ্ধে ওই বেদনাবিধুর হারের পর চিন্নাস্বামী থেকে মাঝ রাতেই হোটেলে ফিরেছিলাম আমরা। ধীরে ধীরে সবাই ফিরেছেন। বিমানবন্দর যাওয়ার যাত্রায় এই হোটেলে থাকা আমাদের সবার সাথে যোগ দিয়েছিল জনকণ্ঠের মিথুন আশরাফ ও রেডিও টুডের আবিদুর রহমান সৌরভ। সবকিছু গোছানোই ছিল।

ব্যাঙ্গালুরু শহর ছাড়ার আয়োজন সম্পন্ন। আমরা রাত দুইটার পর চড়ে বসি ট্যাক্সিতে। সকাল ছয়টায় ছিল ফ্লাইট। দুই ঘণ্টা আগে চেক ইন ছিল। রাস্তা ফাঁকা থাকায় আমরা রাত তিনটার পরপরই বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই।

সেখানে একই ফ্লাইটে আমরা অনেক বাংলাদেশের সাংবাদিক কলকাতা যাচ্ছিলাম। একে একে সবাই বিমানবন্দরে চেক ইন করে। ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ এর রিপোর্টার আতিফ আজম ভাই আমাদের মধ্যে সবার আগে ব্যাঙ্গালুরু এসেছিল। কলকাতা ফেরার ফ্লাইটে তিনিও আমাদের সহযাত্রী।

ঘুম তো হলোই না। অপেক্ষার সময়টাতে খাওয়া-দাওয়া সারলেন সবাই নিজের মতো। তারপর কেউ কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করেছেন।

টিকিট, লাগেজ বুকিংয়ের সময় আমরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। সেখানে আমরা কয়েকজন ব্যাঙ্গালুরু নিয়ে কথা বলছিলাম। শহরটার ভালো, মন্দ নিয়ে। এই সময় আমি অটো ড্রাইভারদের প্রসঙ্গ আসতেই, একটা বাজে কথা (গালি সদৃশ) বলেছিলাম। তাও একটু জোরেই। কারণ নিশ্চিত ছিলাম এখানে কেউ বাংলা ভাষা বুঝবে না।

আমাদের আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই অগ্রবর্তী লাইনে থাকা এক ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, ‘ওরা খুব খারাপ তাই না। ওলা ব্যবহার করলেই পারতে।’ (ওলা হলো, আধুনিক টেক-ফ্রি ট্যাক্সি ব্যবস্থা। ভাড়া নির্দিষ্ট, ছলচাতুরি নেই। সার্ভিস ভালো। গুগুল প্লে-স্টোরে ওদের অ্যাপস আছে। অ্যাপসের মাধ্যমে ঠিকানা দিলেই ট্যাক্সি আপনার বাসার সামনে চলে আসবে।)

আমার চক্ষুচড়াক গাছ, রীতিমতো আক্কেলগুডুম আমি!
একি, এখানে বাংলায় উত্তর পাওয়া সত্যিই অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় ছিল।

আমার কথোপকথনের সঙ্গীরাও ইতিউতি তাকাচ্ছে। আমি লজ্জায় অবনত হয়ে অন্য দিকে ফিরে গেলাম। কয়েক মিনিট পর ঘুরে দেখি ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমাদের কয়েক সাংবাদিকের আলাপ হচ্ছে। পূজা নামের ওই মহিলার জন্ম কলকাতায়, ব্যাঙ্গালুরুতে সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করতেন। এখন চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কলকাতায়।

আলাপ করতে করতে সময় কেটে গেল। খাওয়া, থাকা মিলিয়ে সবচেয়ে ভালো ছিলাম ব্যাঙ্গালুরুতে, এটা শতভাগ স্বীকার্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শহরটার পরিবেশ যেন তিক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই শহরেই ব্যর্থতা, দুর্ভাগ্যের কোপানলে জর্জরিত বাংলাদেশ দল। মনটাও যেন বিষিয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, দ্রুত ত্যাগ করতে পারলেই বাঁচি।

শুভ্র সকালে বিমানবালাদের মোহনীয় কণ্ঠে ‘গুড মর্নিং স্যার’ শুনতে শুনতে কলকাতাগামী ফ্লাইটেও চড়লাম আমরা। ফ্লাইটে উঠেই ক্লান্তি, অবসাদে ঘুম।

চলবে...

সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

ব্যাঙ্গালুরু : বাংলাদেশের বেদনার প্রান্তর-২

ব্যাঙ্গালুরু : বাংলাদেশের বেদনার প্রান্তর-২

লালা ছাড়া বলের সুইং ধরে রাখার খোঁজে টাইগার পেসাররা

লালা ছাড়া বলের সুইং ধরে রাখার খোঁজে টাইগার পেসাররা

দেশে করোনার প্রভাব সম্পর্কে আইসিসিকে জানিয়েছে বিসিবি

দেশে করোনার প্রভাব সম্পর্কে আইসিসিকে জানিয়েছে বিসিবি

সব কিছু আর আগের মতো থাকবে না : ডোমিঙ্গো

সব কিছু আর আগের মতো থাকবে না : ডোমিঙ্গো