টসে হেরে আগে ব্যাট করেছিল ভারত। আঁটোসাঁটো বোলিংয়ের বেড়াজাল তৈরি করে বিশ্বসেরা ভারতের ব্যাটিং লাইন ও উত্তুঙ্গে থাকা চিন্নাস্বামীর হাজার পঞ্চাশেক দর্শককে রাজ্যের হতাশা উপহার দেয় বাংলাদেশের বোলাররা। মোস্তাফিজ-মাশরাফিদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের বিপরীতে রানের জন্য হাঁসফাঁস করা ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা স্কোর বোর্ডে জড়ো করতে সমর্থ হয়েছিলেন সাত উইকেটে ১৪৬ রান।
প্রেস বক্সে আমার বাঁ-পাশেই ছিল বাংলা নিউজের রিপোর্টার মহিবুর রহমান হিল্লোল। ডান পাশে এক ভারতীয় সাংবাদিক। তাকে ঢাকায়ও দেখেছিলাম কোনো এক সিরিজে। ভারতের ইনিংসের পরই উঁকি দিয়েছিল বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা। গোটা স্টেডিয়ামেও সেটির আঁচ পড়লো। প্রেস বক্সে সাংবাদিকরা বলা শুরু করলেন, বাংলাদেশের জন্য দারুণ সুযোগ।
হিল্লোলকে বললাম, জিতবো তো ম্যাচটা। হিল্লোলের কণ্ঠে দুর্বার জয়ের আত্মবিশ্বাস। যখনই উইকেট পড়ছিল, তখনই সে বলছিল, ভাই আজ জিতবো দেইখেন।
ছোটখাট জুটি, উইকেট পতনের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছিল বাংলাদেশের রান তাড়া করার মিশন। ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া টাইগারদের এগিয়ে নেয় মাহমুদউল্লাহ-সৌম্যর ৩১ রানের জুটি। শেষ ৩ ওভারে ২৭ রান দরকার ছিল। নেহেরার করা ১৮তম ওভারের পঞ্চম বলে সৌম্য আউট হলেও ১০ রান আসে।
আমি বাংলাদেশের জয়ের সুর ধরে নিউজের ইন্ট্রো রেডি করছিলাম। উইকেট পড়লেও হিল্লোল আশাহত নয়। পাশে বসে সে বারবারই আমাকে প্রবোধ যোগাচ্ছিল, বাংলাদেশ জিতবেই আজ।
শেষ ৬ বলে ১১ রানের স্নায়ুক্ষয়ী সমীকরণটা সহজ হয়ে গিয়েছিল তিন বলের মধ্যেই। প্রথম বলে সিঙ্গেলের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে মুশফিকের দুটি চার।
নীথর, পিনপতন নীরবতা নেমে আসে চিন্নাস্বামীতে। গ্যালারির হর্ষধ্বনি মুহূর্তেই যেন শশ্মানের নিস্তদ্ধতায় রূপ নিল। পাশে বসা ভারতীয় সাংবাদিক জয়ের আগাম অভিনন্দন জানালেন আমাকে। স্পোর্টিং মানসিকতায় আমিও তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।
তিন বলে দুই রান। চতুর্থ বলেও চার মারতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ধরা পড়েন মুশফিক। মনে হলো চার মেরে জেতাতে চেয়েছিলেন তাই এমন হয়েছে।
স্ট্রাইকে আসলেন সেট ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে দেখলাম মাহমুদউল্লাহও বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিলেন!
নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এসব কী দেখছি! কী হচ্ছে এসব!
ক্ষণিকের অসতর্কতা কষ্টের চোরাস্রোত বইয়ে দিল বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে। বেদনায় নীল হলো বাংলাদেশ। উন্মত্ত হিংস্রতায় জেগে উঠল চিন্নাস্বামী, গ্যালারিতে উঠল প্রাণের জোয়ার।
পান্ডিয়ার অফ স্ট্যাম্পের বাইরে করা নীরিহ শেষ বলটাতে ব্যাটই ছোঁয়াতে পারেননি শুভাগত হোম। দৌড়ে এক রান নিতে গিয়ে রানআউট হয়েছিল মোস্তাফিজ।
ওই শুনতে পাচ্ছি শঙ্খ বাজাচ্ছে সুধীর গৌতম। চিন্নাস্বামীতে সমুদ্রের গর্জন। যেন বিশ্ব জয়ের উন্মাতাল উল্লাসে মাতল চিন্নাস্বামী।
আমরা সবাই বাকরুদ্ধ, যেন পাথুরে মূর্তি।
আবারও সেই ভারতীয় সাংবাদিক করমর্দন করলেন। এবার সান্ত্বনা সূচক। বললেন, ম্যাচটা ভারত জিতেনি, বাংলাদেশই হেরেছে। এ অবিশ্বাস্য!
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ১৬ বছরেও ভারত আমাদের আতিথ্য দেয়নি। মনে করেছিলাম, সেই বঞ্চনা, উপেক্ষার জবাবটা মাশরাফিরা বিশ্বকাপের মঞ্চেই দেবেন ভারতকে!
অকস্মাৎ নেমে আসা তিন বলের দুঃস্বপ্ন বিদীর্ণ, চৌচির করলো বাংলাদেশের হৃদয়। সম্ভবত একদিন পরই ছিল গোটা ভারতের জাতীয় উৎসব ‘হোলি’। সেটি পন্ড করতে বসেছিল ১৮ বছর পর ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে নামা বাংলাদেশ। কিন্তু তিন বলের ঝড়ে উল্টো হতাশার সাগরে ডুবল টাইগাররা।
চোখে ভাসছিল ২০১২ সালে মিরপুরে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে সেই দুই রানের হার। মনে হলো, আমরা তো এমন হৃদয় এফোড়-ওফোড় করা হার দেখে অভ্যস্ত। পেশাদার সাংবাদিক হলেও সেদিন বিষন্নতায় তলিয়ে গিয়েছিল মন।
ম্যাচ রিপোর্ট শেষ করে, সংবাদ সম্মেলনে কক্ষে আসলাম। মঞ্চে বসা মাশরাফির সাথে চোখাচোখিও হলো একবার।
মাশরাফির কথা শুনে বের হয়ে গেলাম অবর্ণনীয় বেদনা, কষ্টে জর্জরিত করা চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম থেকে। সহকর্মীদের বলেছি, রাতে ট্যাক্সির ড্রাইভাররা ঝামেলা করে তাই তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরছি। বাসসের আসিফ মাহমুদ তপুসহ বের হতেই প্রেস বক্সে যাওয়ার গলিতে দেখলাম কয়েকটি চেনা মুখ।
কম আলোয়, গলির মাঝপথে একটু অন্ধকার জায়গায় বসে অঝোর ধারায় কাঁদছে টাইগার শোয়েব। চিন্নাস্বামীর গ্যালারিতে যে একাই লড়েছিল সেদিন। এমনকি আক্রমণের শিকারও হয়েছিল ও!
পাশেই আরেকটা ছেলে। খালি গায়ে, বাঘের সাজে লাল-সবুজ পতাকা হাতে কাঁদছে। ওকে ম্যাচ চলাকালীন টিভিতে দেখিয়েছিল কয়েকবার।
শোয়েবের কান্না থামানোই গেল না। এই আবেগের কোনো মূল্য হয় না, এটা শ্বাশ্বত।
শোয়েব বলেছিল, ‘ভাই, আমরা ম্যাচটা জিতে গিয়েছিলাম। কীভাবে, কী হলো, কিছু বুঝলাম না। কেন এমন হলো? ভাই আমরা ছক্কা না মেরে ১ রান নিলেই পারতাম। এমন সুযোগ, আল্লাহ।’
আর বলতে পারলেন না শোয়েব। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। শোয়েবদের সঙ্গেই ছিল আমাদের চিরচেনা ‘ভুলু’। বিসিবির আঙ্গিনায় বলুন, বাংলাদেশের ক্রিকেট বলুন, সব জায়গায় পরিচিত মুখ ভুলু।
বিসিবির মিডিয়া বিভাগের তরফ থেকে সবাইকে চা খাওয়ায়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, বিসিবির কর্মকর্তা, কোচ, খেলোয়াড় কেউ বাদ নেই যে, ভুলুর লাল চা একবার খায়নি।
ভুলুর প্রসঙ্গ আসলো বলেই বলতে হয়, ক্রিকেট দুনিয়ার সাবেকদের মধ্যে লিজেন্ড শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি এবং শহীদ আফ্রিদি, মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলি সবাই ভুলুর চায়ের গুণমুগ্ধ। বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটাররা তো আছেনই।
আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ভুলু। ভাঙা গলায় অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন করেছিল সে। যার উত্তর আমার জানা ছিল না। বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিল ভুলু, যা থামানোর চেষ্টা বৃথাই ছিল বৈকি।
ঢাকা থেকে শোয়েব আমার সঙ্গেই ধর্মশালা অবধি গিয়েছিল। ওদেরকে আমাদের সাথেই বের হতে বললাম। শোয়েব বললো, ভাই আপনি যান। আমার একটু পরে যেতে হবে। এখন বের হতে পারবো না।
কেন, জানতে চাইলে শোয়েব বলেছিল, ওই যে দেখেন ওরা দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। আমি গেলে আমাকে মাঝখানে রেখে গোল হয়ে চিৎকার করবে। বিরক্ত করবে, আটকে রাখবে। ম্যাচ শেষে একবার চেষ্টা করেছিলাম যেতে, ওরা আটকে ধরে উৎপাত করছিল বলে এখানে বসে আছি। আমার যেতে দেরী হবে ভাই, আপনি চলে যান।
তারপরই গলির মুখে তাকিয়ে দেখিয়ে অনেক ভারতীয় সমর্থক দাঁড়িয়ে। তখন শোয়েবকে ছেড়ে চলে আসি রাস্তায়। সেখানেও ভারতীয় সমর্থকদের অনাকাঙ্ক্ষিত জয়ের উৎসব চলছেই। ঢাক-ঢোলের বাদ্য, বাঁশি, চিৎকার, গর্জন চলছেই।
তার মাঝেই লম্বা পথ হেঁটে একটা ট্যাক্সি ঠিক করে হোটেলে ফিরি আমরা।
চলবে...
সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি
[sportsmail24.com এর ওয়েবসাইট এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও ব্রাউজ করে পড়তে পারবেন। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস থেকেও খেলাধুলার সকল নিউজ পড়তে পারবেন। ইনস্ট্রল করুন স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস ]