২২ মার্চ সকাল, প্রচণ্ড রোদ ছিল। সুপ্রশস্ত রাস্তায় গাড়িতে বসে থেকেও যেন সেই রোদের তাপ থেকে বাঁচার উপায় নেই। ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকার সময়টাতে গলা শুকিয়ে আসার যোগাড়ও হয়। তবে ব্যাঙ্গালুরু শহরে রাস্তার ধারে অনেক বর্ষীয়ান গাছ রয়েছে। যা খরতাপে পথচারীদের প্রশান্তির আশ্রয় হয়।
ব্যাঙ্গালুরুর আর দশজন নগরবাসীর মতো তৃষিত হৃদয়ের টানটা খোদ টিপু সুলতানের জন্যও হয়তো একই রকম ছিল। টিপু সুলতান মানে মহীশূরের রাজা। পুরো নাম সুলতান ফতেহ আলী খান সাহেব, টাইগার অব মহীশূরও বলা হতো তাকে। যে নামেই ডাকুন টিপু সুলতান সর্বজন পরিচিত উপমহাদেশে। লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন সম্পর্কিত লেখায় তার সম্পর্কে অনেকটা বর্ণনা দিয়েছিলাম।
রাজা হায়দার আলী খান ও বড় ছেলে টিপু সুলতান দু’জনই বেশি আয়েশি ছিলেন। মহীশূরে মূল আবাস হলেও কর্নাটকসহ ব্যাঙ্গালুরু শহরে তাদের পদচারণা ছিল উল্লেখ করার মতো।
সকালে প্রাতরাশ শেষে আমরা পাঁচ বাংলাদেশি সাংবাদিক রওনা হই টিপু সুলতানের সামার প্যালেস দেখার উদ্দেশে। শামীম ভাই, জ্যোতি এক অটোতে চড়ে বসেন। আরেকটি অটোতে আমি, পলাশ ভাই, তপু। অনেক দূর যাওয়ার পর অটোচালক যেখানে আমাদের নিয়ে থামলেন সেটিও বড় বিল্ডিং। বিশাল জায়গা।
কাছে যেতেই নামটা পড়লাম, ‘ব্যাঙ্গালুরু প্যালেস’। চালক ভুল করে আমাদের এখানে নিয়ে আসে। চালকও নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে ততক্ষণে। এর মাঝে শামীম ভাই, জ্যোতি পৌঁছে গেছে নির্ধারিত গন্তব্যে। ওরা ফোন করে বললাম, ভুল জায়গায় চলে আসছি। চালক ভুল করেছে।
এখন এই রোদ-গরমে আর সামার প্যালেস যেতে ইচ্ছে করছে না। জ্যোতির কথায়, আবার অটোতে চড়ে বসি। ওরা আমরা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ওরা প্রবেশের টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে আছে।
জায়গাটা বোঝাতে অনেক কষ্ট হয়েছে অটো চালকদের। শেষ পর্যন্ত একজন চিনলেন ও যেতে রাজি হলেন। যাওয়ার সময় এবার যানজটের কবলে পড়ে যাই। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় পরে আমরা পৌঁছাই কাঙ্ক্ষিত সামার প্যালেসে।
শহরের কালাইসিপালইয়াম বাস্ট স্ট্যান্ডের অঞ্চলটা অনেকটাই বাংলাদেশের পুরাতন ঢাকার মতো। সেখানেই ১৭৮১ সালে গ্রীষ্মকালের জন্য বিশ্রামাগার বানানোর কাজ শুরু করেছিলেন হায়দার আলী। পিতার মৃত্যুর পর ১৭৯১ সালে যে বিশ্রামাগারের কাজ শেষ করেন টিপু সুলতান। ১৭৭৮ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত পিতা-পুত্র গ্রীষ্মের সময়টা এখানে কাটাতেন।
পিতা-পুত্রের রাজত্বের অবসানের পর ব্রিটিশরা এটিকে তাদের সরকারি দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এখন যার পূর্ণ দেখভাল করছে কর্নাটক রাজ্য সরকার। অনেক জায়গা নিয়ে নির্মিত বিল্ডিংটি এখন টিপু সুলতানদের স্মৃতি বহন করেই চলেছে। আর গণমানুষের জন্য সেটি দর্শনীয় স্থান।
মহারাজা কৃষ্ণ রাজ থ্রী ১৮০৮ সালে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এখানে এসে মোঘল আমলের শেষ প্রতিনিধি টিপু সুলতানের রাজত্বসহ সার্বিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন দর্শনার্থীরা।
গোটা বিল্ডিংই কাঠের তৈরি। দেয়ালের চারপাশে সতকর্তা নোটিশ রয়েছে, ‘বেশি ভার দিবেন না। কিছু নষ্ট করবেন না।’
১১৬টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে দোতালা বিল্ডিংটি। দুপাশে ফুলের চাষ হচ্ছে। যার বুক চিরেই তৈরি হয়েছে রাস্তা। প্রধান ফটক থেকে সেই রাস্তা পাড়ি দিয়েই যেতে হয় মূল বিল্ডিংয়ে। সুউচ্চ না হলেও নীচতলায় আছে টিপু সুলতানের রাজত্ব নিয়ে বর্ণনা। কিছুটা গুহার মতো অবয়বও আছে। টিপু সুলতানের ব্যবহৃত তলোয়ার, বন্দুক, আয়েশি ঢঙে তোলা ছবি রয়েছে। যেগুলোর সঙ্গে ছবি তোলা ও হাত দিয়ে স্পর্শ করা নিষেধ।
দেয়ালে রয়েছে অনেক খাঁজ। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন সময়ে এখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো। কাঠের সিড়ি ভেঙে ওপরে যেতেও চোখে পড়ে টিপু সুলতানের রাজত্বের অনেক নিদর্শন। সিড়ি সমেত পিলারগুলো দারুণ সৌন্দর্যের অবতারণা করে। দর্শনার্থীরা সেখানে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কারণ সেখানে ছবি তুলতে নিষেধাজ্ঞা নেই। বাইরে বাহারী গাছ, ফুলের গাছের চাষ হয়। এগুলো কর্নাটক সরকারই করেছে বুঝতে বাকি নেই।
তবে এ অঞ্চলে টিপু সুলতানের করা সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে একটি বাঁধ তৈরি করা। লালবাগে তার তৈরি বাঁধই নাকি এ অঞ্চলের মানুষদের জীবিকায় বড় সাহায্য করেছে। চাষাবাদ ঠিক মতো করতে পারছে লোকজন এই বাঁধের কারণে। এছাড়াও গোটা অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রচলণ, বিভিন্ন পণ্যের সহজলভ্যতাসহ অনেক কিছুই করে দিয়েছিলেন টিপু সুলতান। যা গণমানুষের জীবন ধারণে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তাই শুধু রাজা, শাসক হিসেবে নয় টিপু সুলতান কর্নাটকের উন্নতির পুরোধাও ছিলেন।
ধর্মশালার প্রচণ্ড শীত, কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালুরুতে আমাদের সময় ভালোই কেটেছে। এখানেও গরম ছিল। রাস্তায় আছে যানজট। তারপরও বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়ায় ভালোই স্বস্তি ছিল। গান্ধীনগরে আমাদের হোটেল থেকে বের হতে ৫০ গজের মধ্যেই পেতাম অটো, ট্যাক্সি। খাবারও স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুলভমূল্যে পাওয়া যেত। হোটেলের পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট। যেখানে পুরান ঢাকার হাজীর বিরিয়ানির মতো বিরিয়ানি পাওয়া যেত। প্যাকেটের ভেতর পাতা ছড়ানো, যার মধ্যে থাকতো বিরিয়ানি।
চিকেন কাউন্ট্রি নামে একটা সুন্দর হোটেল ছিল আমাদের আবাস থেকে এক মিনিট দূরত্বে। সেখানে ভেজালহীন, হালাল খাবার পাওয়া যেত। ওদের বিরিয়ানি, চিলি চিকেন দারুণ সুস্বাদু ছিল। বিরিয়ানির পরিমাণ এতটাই দিত যে ভরপেট হয়ে যেত একবার নিলেই। আমরা বেশ কয়েক বেলা ওই রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম। চিকেন কাউন্ট্রির নীচতলায় তরতাজা, ফরমালিন ছাড়া ফলের জুস পাওয়া যেত। মূল্য ছিল ২০-৩০ রুপির মতো। ওই এলাকায় এই হোটেলটিই সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। মধ্য রাত অবধি ওদের হোটেলে মানুষজনের আনাগোনা থাকতো।
রাস্তায় ২০ রুপিতে হরেক রকমের ফলের সমাহারে প্লেট বিক্রি হতো। যার এক প্লেট দিয়ে দিব্যি আপনার সন্ধ্যার নাস্তা হয়ে যাবে। আমি ও মহিউদ্দিন পলাশ ভাই প্রায়ই ফল, ফলের জুস খেতাম। বিশেষ করে প্রতিবেলা খাওয়ার পর। আসিফ মাহমুদ তপুর অবশ্য চায়ের প্রতি আসক্তি খুব কম ছিল।
চায়ে ওরা নানা মশলা ব্যবহার করতো বলে আমি শামীম ভাই, পলাশ ভাই লাল চা তথা ব্ল্যাক টি-ই বেশি পান করতাম। ভেজিটেরিয়ান হোটেলও ছিল। আমি জ্যোতির্ময় মন্ডল জ্যোতি (দৈনিক যুগান্তরের) সেই ভেজিটেরিয়ান হোটেলও এক বেলা খেয়েছিলাম।
এর মাঝে একদিন এম জি (মহাত্মা গান্ধী) রোড থেকে গান্ধীনগরে ঘুরতে চলে আসলেন নিউ এজের আতিফ আজম ভাই। এম জি রোডের বিভিন্ন হোটেলে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক ছিলেন। আতিফ ভাইও সেখানেই থাকতেন। উনি গান্ধীনগর আসার পর একসঙ্গে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম চিকেন কাউন্ট্রিতে। বেশ জম্পেশ আড্ডা হলো। চা-জুস পর্ব শেষে ফিরে গেলেন আতিফ ভাই।
লন্ড্রি হতে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই আমাদের হোটেলের চারপাশে পাওয়া যেত। খানিক দূরে কাপড়-চোপড়ের মার্কেটও ছিল। সেখানেই আবার মসজিদ ছিল। মসজিদের পাশেই মুসলিমদের মালিকানায় কয়েকটি হোটেল ছিল। তার মধ্যে একটা হোটেলে খেয়ে সবাই মজা পেয়েছিলাম।
পরে কয়েকদিন ওদের হোটেলে গিয়েছিলাম। বেশ আন্তরিকতার সহিত ওরা আমাদের আতিথ্য দিত। বংশানুক্রমে করে আসা ব্যবসাটা দেখতো সুদর্শন এক ছেলে। বয়সে আমাদের কাছাকাছিই হবে। সর্বদা কাবলি পরা ছেলেটা আমাদের খুব দেখভাল করতো। নামটা ভুলে গিয়েছি ওর।
তবে বেশিরভাগ সময়ই আমাদের খাবার পরিবেশন করতো আশরাফ নামের একটি ছেলে। ওর সাথে ক্রিকেট নিয়ে আলাপ ভালোই জমেছিল আমাদের। বাংলাদেশের ক্রিকেটের খবর তার কাছে সবসময় থাকে। ফিক্সিং পাপে মোহাম্মদ আশরাফুলের নিষিদ্ধ হওয়া, মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকদের খবর সে রাখে। তার আশা আশরাফুল আবারও ফিরবে জাতীয় দলে। বাংলাদেশ দলে আশরাফের প্রিয় ব্যাটসম্যান মুশফিক।
গান্ধীনগরেই বড় বড় কয়েকটি সিনেমা হল আছে। ত্রিভুবন নামক সিনেমা হলটা ছিল অনেক বড়। আমরা সিনেমা দেখার প্ল্যান করেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারিনি।
চলবে...
সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি