চিন্নাস্বামীর দ্রাবিড় ধারণ, মিনি প্রেস বক্স ও সইশিকারী প্রণব

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১১:১০ এএম, ২০ এপ্রিল ২০২০
চিন্নাস্বামীর দ্রাবিড় ধারণ, মিনি প্রেস বক্স ও সইশিকারী প্রণব

বিশ্বকাপের খেলা, টুর্নামেন্টের মাঝপথে ইনফর্ম তাসকিন-আরাফাত সানিকে হারানোর বিষন্নতার মাঝেও চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আরও কিছু অভিজ্ঞতা সঙ্গী হয়েছিল আমাদের। তেমন কয়েকটি বিষয় জানাবো এই পর্বে।

১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টেডিয়ামটা কর্নাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মাঠ হিসেবেই পরিচিত ছিল। কর্নাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এ সভাপতি এম চিন্নাস্বামীর নামেই পরে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়। এখানে শুধু ক্রিকেট নয় অনেক গানের ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। আইপিএলে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু দলের হোম ভেন্যু থাকে এই স্টেডিয়াম।

অনেক বড় জায়গা জুড়েই করা হয়েছে স্টেডিয়ামটা। রঙ বেরঙের গ্যালারিতে দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৫০ হাজার। তবে এই স্টেডিয়ামের সবচেয়ে বড় কমতি হলো ‘মিনি প্রেস বক্স’। এত বড় স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে মাত্র ৬৫ জন সাংবাদিকের বসার আসন রয়েছে। স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় মাঠের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রেস বক্সের পরিধি নির্ধারণে অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে স্থানীয়রা, যেটি এখানে স্পষ্ট।

তাছাড়া প্রেস বক্সের কয়েকটি অংশ থেকেই মাঠের অর্ধেকের বেশি দেখা যায় না। বিভিন্ন আসনের সামনে রয়েছে পিলার। নির্দিষ্ট কিছু আসন থেকে মাঠ পুরোটা দেখা যায়। বেশিরভাগ অংশ থেকে খেলা দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের টিভির অবলম্বন নিতে হয়। অদক্ষতার পরিচয় তাই আভিজাত্যের ব্যাঙ্গালুরুতেও আছে।

প্রেস বক্সের অপ্রতুলতা বাদ দিলে চিন্নাস্বামীর প্রাঙ্গন ক্রিকেটীয় আবহে ঠাসা। মূল ফটক পার হতেই নজরে আসে দেয়ালে সাঁটানো লিজেন্ড রাহুল দ্রাবিড়ের প্রতিচ্ছবি। ক্যারিয়ার জুড়ে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনে ‘দ্যা ওয়াল’ নামে খ্যাতি ছিল তার। দ্রাবিড়ের জন্ম ইন্দোরে আর ব্যাঙ্গালুরুর ছেলে হলেন অনিল কুম্বলে। কিন্তু চিন্নাস্বামী বড় করেই ধারণ করেছে দ্রাবিড়কে। অবশ্য দ্রাবিড় বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে খেলেছেন।

সেই থেকে গাঁটছড়া। ব্যাটিংয়ে শিল্পিত সৌন্দর্যের উদাহরণ দ্রাবিড়ই ঠাঁই পেয়েছেন চিন্নাস্বামীর দেয়ালে। সেখানে লাল ইটের দেয়ালে খোদাই করে লেখা ‘কমিটমেন্ট, কনসিসটেনসি অ্যান্ড ক্লাস’। পাশেই ডানহাতি দ্রাবিড়ের ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ মেনে করা ড্রাইভের স্মৃতিস্তম্ভ। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘অ্যা ট্রিবিউট টু রাহুল দ্রাবিড়’।

শুধু স্মৃতিস্তম্ভেই দ্রাবিড়ের টেস্ট ও ওয়ানডেতে করা সেঞ্চুরিগুলো টাইমলাইন আকারে তুলে ধরা হয়েছে। খেলোয়াড়ী জীবনের পরিসংখ্যানও রয়েছে। তার সেঞ্চুরির আন্তর্জাতিক ভেন্যুগুলোর নামও উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বাদ পড়েনি বাংলাদেশের মিরপুর ও চট্টগ্রামের নাম।

চিন্নাস্বামীর চৌহদ্দিতে রয়েছে একটি ক্লাব হাউসও। যেখানে ভারতীয় ক্রিকেটারদের অনেক কীর্তির স্মৃতি ধারণ করা হয়েছে। লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়েই বড় আয়োজন। তার ক্যারিয়ার, জীবনলিপি সাল আকারে বিল বোর্ডে প্রদর্শিত হচ্ছে। সামনেই রয়েছে ব্যাটসম্যানদের চিরায়ত এক প্রতীকী মূর্তি।

ক্রিকেট দুনিয়ার লিজেন্ডদের অটোগ্রাফ রয়েছে। স্যার ভিভ রিচার্ডস, মুনসুর আলী খান পৌতোদি, ইমরান খান, গুন্ডাপা বিশ্বনাথ, প্রয়াত টনি গ্রেগদেরও সই আছে। চিন্নাস্বামীতে কখনো না খেললেও স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, স্যার গ্যারি সোবার্সদের অটোগ্রাফ এ ক্লাব হাউসের সংগ্রহে রয়েছে। অনেক স্মরণীয় টেস্টের স্কোরকার্ডও ঠাঁই পেয়েছে দেয়ালে।

এবার বলবো ১৯ মার্চের একটি ঘটনা। সেদিন চিন্নাস্বামীতে বাংলাদেশের অনুশীলন ছিল। মাশরাফিরা তখনও এসে পৌঁছেননি। মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল ওয়ার্মআপ করছিল। যারা পরে বিশ্বকাপটাই জিতেছিল।
নেটে অনুশীলনের জায়গা থেকে সরু রাস্তা ধরে মূল মাঠে যেতে হয়। হুট করেই সেখানে যেন হুল্লোড় পড়লো, চঞ্চলতা তৈরি হলো। চোখ ফেরাতেই দেখি দীর্ঘদেহী এক প্রৌঢ় হাঁটছেন, হাতে লাঠি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় হ্যাট।

এখন হাতে একটা চুরুট হলো হয়তো ছবিটা বেশ জমে যেত!

ভদ্রলোক চুরুট ধরতেন কিনা জানি না, তবে বিশ্বকাপ ধরার অভ্যেস তার রয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুইবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিকরা তার পেছনেই ছুঁটছে। তিনি ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ক্লাইভ লয়েড। বিশ্বকাপে ড্যারেন স্যামির দলটার সঙ্গে ছিলেন লয়েড। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সোনালী দিনের নেতাকে অনুরোধ করেও কথা বলানো গেল না।

তাকে দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। পলাশ ভাইকে বললে উনি আমার ছবি তুলে দেন হাঁটতে থাকা লয়েডের সঙ্গে। কম বেশি সবাই ছবি তুলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই সাবেক অধিনায়কের সঙ্গে।

ক্রিস গেইল, ডোয়াইন-ড্যারেন ব্র্যাভো, ড্যারেন স্যামিরা গা গরমের ফুটলব খেলা শেষে মাঠ থেকে সরু করিডর ধরে হেঁটে নেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে সবাইকেই দাঁড়াতে হচ্ছিল। খুব দীর্ঘাকায় নয়। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। হাতে ফাইলের মতো কিছু কাগজ। অনেকটাই লিকলিকে গড়নের এক তরুণই বারবার থামাচ্ছিল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের।

লিজেন্ডারী ক্লাইভ লয়েড, কার্টলি এমব্রোসও বাদ যাচ্ছিলেন না। ছেলেটা সইশিকারী বুঝতে বাকি নেই। ক্রিকেট দুনিয়ায় এ চিত্র খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। শুধু সইশিকারই নয়, ১৮ বছরের এ যুবা হালের চালু ট্রেন্ড সেলফির ফ্রেমেও বেঁধে রাখছিল এসব তারকাদের। পাশাপাশি চলছিল মিনি ব্যাটে স্বাক্ষর নেওয়া।

কৌতূহল ক্রমশই বাড়তে থাকে তার কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা দেখে। মাঠে টাইগার বাহিনী আসার পরও আপন কাজে ব্যস্ত সময় কাটছিল তার।

কাছে গিয়ে কথা বলতেই জানা গেল, ব্যাঙ্গালুরুর এক অদম্য যুবার সইশিকারের গল্প। গিনেজ বুক অব রেকর্ডসে নাম লেখানোর স্বপ্ন দেখে সে। ক্রিকেটার, চলচ্চিত্রের তারকাদের সইশিকারের সংগ্রহশালা দিয়ে জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

ছেলেটার নাম- প্রণব জেইন। বাবার জুয়েলারী ব্যবসা। সেখানে প্রণবকেও সময় দিতে হয়। অবশ্য এই শহরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হলে মাহাবীর জুয়েলার্সে প্রণবের দায়িত্বে আসে ‘অঘোষিত ছুটি’। সংসারে প্রণবই বড়। তার একটি বোনও আছে। সইশিকারের নেশায় দুবাই, শ্রীলঙ্কা, গোটা ভারত ঘুরেছে সে।

জাদুঘর বানানোর পরিকল্পনা খুব দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে চায় প্রণব। আর সেটা করার পূর্ণ রসদ তার কাছে আছে। ৩ থেকে ৪ হাজার ক্রিকেটারের অটোগ্রাফের সংগ্রহ আছে। মিনি ব্যাটে আছে আরও ৬-৭’শ অটোগ্রাফ।

সইশিকার এখন প্রণবের ধ্যান-জ্ঞান। যার শুরুটা হয়েছিল ৮ বছর আগে। তার মূলে ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। প্রণবের ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেরণা, জীবনের হিরো ধোনি। যার মাধ্যমেই এ পথে প্রণবের যাত্রা শুরু।
sportsmail24
ওই গল্প জানাতে গিয়ে প্রণব বলেছিল, ‘আমি ধোনির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। বিশাখাপত্তমে তার ১৪৮ রানের (পাকিস্তানের বিপক্ষে, ২০০৫ সালে) ইনিংস দেখার পর। তার সঙ্গে যে কোনো মূল্যে দেখা করতে চেয়েছিলাম। ওই ইনিংসের পর তার বড় ভক্ত হয়ে যাই। তাকে দেখেই ক্রিকেট খেলা শুরু করি।’

১০ বছর বয়সে ধোনির অটোগ্রাফ নিয়েছিল প্রণব। সইশিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সময় অপেক্ষাও তাকে করতে হয়েছিল ধোনির জন্যই। একবার নাকি হোটেলের লবিতে ১২ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল প্রণব। ওই অপেক্ষার পর ১০ মিনিট ধোনির সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিল সে।

চিন্নাস্বামীতে বাংলাদেশ দলের সবার অটোগ্রাফ নিয়েছিল প্রণব। মোস্তাফিজ থেকে শুরু করে নারী দলের অধিনায়ক জাহানারা আলমও বাদ যাননি।

সেই পরিচয়ের পর প্রণবের সঙ্গে যোগাযোগটা এখনও অব্যাহত আছে আমার। সেটা ফেসবুকের মাধ্যমে। এখনও মাঝে মাঝে সংগ্রহে রাখার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচের টিকিট চায় প্রণব।

চলবে...

সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

তাসকিন-সানিকে মাশরাফির অশ্রুসজল বিদায়

তাসকিন-সানিকে মাশরাফির অশ্রুসজল বিদায়

দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

গাঙ্গুলির প্রশংসার অর্থ পরে বুঝেছিলেন ম্যাককালাম

গাঙ্গুলির প্রশংসার অর্থ পরে বুঝেছিলেন ম্যাককালাম

জুয়াড়িদের নিয়ে ক্রিকেটারদের সতর্কবার্তা দিল আইসিসি

জুয়াড়িদের নিয়ে ক্রিকেটারদের সতর্কবার্তা দিল আইসিসি