ইডেন গার্ডেন্সে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের হারে কলকাতার চৌহদ্দিতে আমাদের ‘বাঙালিয়ানা’ সাজ-অনুভূতির পূর্ণতা মিলেনি। ১৬ মার্চ রাতটাও খুব ভালো কাটেনি। ইডেন থেকে হোটেলে ফিরেই লাগেজ গোছানো, হোটেলে বিল মেটানো, খাওয়া সেরে ঘুম। কারণ খুব সকালেই বিমানবন্দরে রিপোর্টিং করতে হবে। আটটার পরই ছিল ব্যাঙ্গালুুরুর ফ্লাইট।
এ যাত্রায় আমার সহযাত্রী দুই বড় ভাই দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ প্রতিনিধি শামীম চৌধুরী, দৈনিক মানবকণ্ঠের ক্রীড়া সম্পাদক মহিউদ্দিন পলাশ ও বাসসের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আসিফ মাহমুদ তপু। অবশ্য সফরের বাকি অংশে আমরা এই চারজন সবসময় একসঙ্গেই ছিলাম। বলা বাহুল্য, আমি ও আসিফ মাহমুদ তপুকে সফরজুড়ে আগলে রেখেছিলেন পলাশ ভাই এবং শামীম ভাই।
প্রাতঃভ্রমণকারীরা তখন রাস্তায় নেমেছেন মাত্র। চায়ের দোকান, ট্রাম, রেল গাড়ির গমগম আওয়াজও ডানা মেলতে পারেনি। বলা চলে, ১৭ মার্চ সকালে ‘শহর কলকাতা’র কোলাহল জেগে ওঠার আগেই ট্যাক্সি চেপে নেতাজী সুবাস চন্দ্র বোস এয়ারপোর্টে চেক ইন করলাম আমরা। গন্তব্য ব্যাঙ্গালুরু। এয়ার ইন্ডিগোর ফ্লাইট ছিল দুই ঘণ্টা ২৫ মিনিট। তাতে চড়েই ব্যাঙ্গালুরুতে পা দেওয়া। সূর্য তখন মধ্যগগণে। তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীর না পুড়লেও উষ্ণতা ছিল প্রচন্ড।
আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে এসেছেন আরিফুর রহমান বাবু ভাই ও এনটিভির স্পোর্টস এডিটর নাসিমুল হাসান দোদুল ভাই। ব্যাঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে নামতেই ট্যাক্সি ওয়ালাদের চিরচেনা ডাকাডাকি। সেই ফাঁক গলিয়ে এয়ারপোর্টের রাস্তা পার হওয়ার আগেই এগিয়ে এলেন শুশ্রুমন্ডিত দীর্ঘাকায় এক প্রৌঢ়। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটার বেশ-ভূষাই বলে দিচ্ছিল হয়তো তিনি মুসলিম ধর্মালম্বী। ৭০ বছর বয়সী নূর চাচার সঙ্গে ট্যাক্সি ভাড়ার আলাপের দফারফা হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যেই।
নূর চাচার ট্যাক্সিতে চেপে এয়ারপোর্ট সীমানা পার হতেই সবুজাভ প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখ জুড়ালো। সাজানো, পরিপাটি, সুবিশাল রাস্তা। তার দুই ধারে সাজানো বাগান। গাড়িগুলো সব চলছে আপন গতিতে। দ্রুত গতি উল্লেখ করতেই হয়। আমাদের আগমনের হেতু ক্রিকেট, আর নুর চাচা ক্রিকেটের ভক্ত। অল্প দূরত্ব পাড়ি দিতেই কথায় কথায় সেটি পরিস্কার হয়ে গেল। উনার জন্ম ব্যাঙ্গালুরুতেই। দ্বিধাহীন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠেই জানালেন, ভারতে জন্মালেও পাকিস্তানের পাড় সমর্থক তিনি। এমনকি এখানকার বাকি মুসলিমরাও নাকি এমনই।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকেও পছন্দ করেন। বাংলাদেশ দলে তার প্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। ইডেনে তামিম কেন ২০ রান করে আউট হলো, তা নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল তার। বললেন, কী হয়েছে তামিমের? এশিয়া কাপে তো দারুণ খেলেছিল। বিশ্বকাপের শুরুতেও। তামিমের ছক্কা মারাটা নূর চাচার মনে দাগ কাঁটে।
তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে ব্যাঙ্গালুরুর মুসলিমরা নাকি দু’দলকেই সমর্থন দেয়। বাংলাদেশের চার-ছক্কা, উইকেট উৎসবের সঙ্গে পাকিস্তানের সাফল্যে করতালির জোয়ার ওঠে এ শহরের মুসলিমদের মাঝে। তবে ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে, পাকিস্তানের প্রতি একাট্টা তারা। ওই ম্যাচে আফ্রিদিরাই পায় নূর চাচার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সমর্থন।
কথা বলতে বলতে পথ এগিয়ে যাচ্ছে। ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ব্যাঙ্গালুরু শহরে প্রবেশ করতে গিয়ে রক্ষু পাহাড় (হয়তো টিলা বলাই ভালো) চোখে পড়লো অনেকগুলো। বাড়ি-ঘরগুলো বেশ অভিজাত। ভারতের অন্যতম ধনী শহর এটি। ব্যাঙ্গালুরুর চারপাশে তামিলনাড়ু, অন্ধপ্রদেশ রয়েছে। এখানকার রাজধানী কর্নাটক। তামিল ভাষাটাই এখানে বহুল প্রচলিত। দক্ষিণ ভারতের কেন্দ্রও ব্যাঙ্গালুরু শহর।
ব্যাঙ্গালুরু মূলত ‘সিলিকন ভ্যালি অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত। যাকে আরও বলা হয় ‘আইটি ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া’। ভারতের জিডিপিতে চতুর্থ সর্বোচ্চ অবদান রাখে এ কর্নাটক রাজ্য। মুম্বাই, দিল্লি ও কলকাতার পরই ব্যাঙ্গালুরুর অবস্থান। ১৩.৭ ভাগ মুসলিম রয়েছে এখানে। যেখানে সর্বোচ্চ ৭৯.৪ ভাগ হলো হিন্দু ধর্মালম্বী। শিক্ষা-দীক্ষায়ও ভারতের যে কোনো রাজ্যের চেয়ে অনেক এগিয়ে ব্যাঙ্গালুরু। তামিল চলচ্চিত্রের আবাসও এখানে। শহরে পথ চলতেই খ্যাতিমান অভিনেতা রজনীকান্তসহ বড় বড় তারকাদের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড চোখে পড়ে।
কয়েকটি হোটেলের খোঁজ আমরাই দিয়েছিলাম নূর চাচাকে। পরে তাকে বিশ্বাস করে, উনার পছন্দের ওপরই ভরসা করলাম। উনি আমাদের নিয়ে গেলেন মুসলিম অধ্যুষিত একটা এলাকায়। নাম গান্ধীনগর। তবে এলাকাটা বেশি পরিচিত হোটেল ‘মতি মহল’র কারণে। অনেক প্রাচীন, অভিজাত হোটেল মতি মহল। তাই গান্ধীনগরের চেয়ে মতি মহল বললেই অটো চালকরা বেশি দ্রুত চিনে ফেলে।
সেখান থেকে ব্যাঙ্গালুরু স্টেডিয়াম মিনিট বিশেক দূরত্বে। অটো-ট্যাক্সির মিটারে আসে ৫০ রুপির মতো ভাড়া। একটা হোটেল দেখিয়ে বললেন, ওখানে গিয়ে রুম দেখতে। স্বস্তির বিষয় প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় হোটেলটি। তাই লাগেজ, ব্যাগ নিয়ে বেশি ঘুরাঘুরি করতে হয়নি হোটেলের সন্ধানে।
এসি রুম, ওয়াই-ফাইয়ের ডাবল লাইন, হোটেল থেকে বের হলেই অনেক বাহারী খাবারের হোটেল, পছন্দসই খাবার খাওয়া যায়, মসজিদও খুব বেশি দূরে নয়, ফল-ফলাদি, ফলের জুস পাওয়া যায় নির্বিঘ্নে। আমরা ওঠে গেলাম পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের ‘শ্রী ত্রুপতি কমফোর্টস’ হোটেলটিতে।
সেদিন আর মাঠমুখো হইনি আমরা। খানিকটা বিশ্রাম, দুপুরের খাওয়া, ভাত-ঘুম শেষে সন্ধ্যায় লেখালেখি। রাতে কাজের পর এলাকায় ঘুরা ফেরা করেছিলাম আমরা।
হোটেলের টিভিতে দিনভর বিভিন্ন গানের চ্যানেলে চলতো দুটি গান। তখন ছবি দুটি মুক্তি পেয়েছিল। ধর্মশালা, কলকাতায় একই চিত্র ছিল। গান দুটি বারবার দেখানো হতো। কাপুর অ্যান্ড সনস ছবির ‘লাড়কি বিউটিফুল কার গায়ি চ্যুল’ যেখানে আলিয়া ভাট ও সিদ্ধার্থ মালহোত্রা অভিনয় করেছেন।
আরেকটা হলো কারিনা কাপুর ও অর্জুন কাপুর অভিনীত ‘কি অ্যান্ড কা’ ছবির ‘হাই হিলস টে নাচেসে’ গানটি। এ দুটি গান শুনলেই এখনও আমার ভারত সফরের কথা, সময়গুলো মনে পড়ে যায়। কারণ গোটা সফর জুড়ে টিভিতে এ দুটি গানই বেশি শুনেছি। কাজ করার সময়ের বাইরে বেশিরভাগ সময়ই গান দুটি শোনা হয়েছে।
আমাদের মতোই ১৭ মার্চ দুপুরে ব্যাঙ্গালুরু পৌঁছেছিল বাংলাদেশ দল। আসলে তখন এ শহরটা ছিল বাংলাদেশময়। এ দিন ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ নারী দল খেলেছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। পুরুষ দল, নারী দল, বিসিবির পরিচালক, কর্মকর্তা, সাংবাদিকরাসহ বাংলাদেশের বেশ বড় বহর তখন এ শহরে অবস্থান করছিল। যদিও বাংলাদেশ সেখানে সুখস্মৃতির সন্ধান পায়নি।
চলবে...
সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি