ইডেন ও বাংলাদেশের মোহভঙ্গ

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১১:১২ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০২০
ইডেন ও বাংলাদেশের মোহভঙ্গ

মারকুইস স্ট্রিট থেকে ট্যাক্সিতে চড়তেই যেন মনের ভেতর একটা রোমাঞ্চের ঢেউ খেলে গেল। আহা যাত্রা শেষ হলেই যে, সামনে আসবে দেড়শ বছর পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ‘ইডেন গার্ডেন্স’। সেই ছোটবেলা থেকে যে স্টেডিয়ামের বিশালত্ব নিয়ে পড়েছি, শুনে এসেছি। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের আলোচনা করতে করতেই ইডেনের সামনে পৌঁছে গেলাম।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই মূল ফটকের ওপর চোখ গেল। যেখানে শোভা পাচ্ছে বিশাল সাইজের কাঁচের দেয়ালে ভারতীয় গ্রেট ক্রিকেটারদের সব সাফল্যের ছবি। ইডেনের পাশ দিয়ে চলতে গেলে কপিল দেব, সৌরভ গাঙ্গুলি, শচীন টেন্ডুলকারদের ছবিতে আপনার উৎসুক চোখ আটকাবেই।

গেইট পেরিয়ে ভেতরে মূল বিল্ডিংয়ের নীচতলা থেকেই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) অফিস শুরু। দোতলায় উঠলেই চোখে পড়বে আরও কিছু ছবি। যেখানে আছে ফ্রেমে বাঁধানো সৌরভ গাঙ্গুলির জার্সি। লর্ডসের ব্যালকনিতে খালি গায়ে জার্সি উঁচিয়ে দাদার উল্লাসের ছবি। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয় সব ছবি, কিংবদন্তিদের ছবি সবই কাঁচের ভেতর রাখা আছে।

মূল বিল্ডিংয়ের বাম পাশ দিয়ে ইডেনের গর্ভে প্রবেশের রাস্তা। বৃহদাকায় ইডেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬৪ সালে। এখন আর অবশ্য প্রৌঢ়ত্বের চিহ্ন নেই। বরং তারুণ্য যেন রমরমা। এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়াম এটি। একটা সময় লাখ খানেক লোক একসঙ্গে খেলা দেখতে পারতো ইডেনে। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে সংস্কার হয়ে এখন ইডেনের ধারণ ক্ষমতা ৬৬ হাজারে এসে ঠেকেছে। ১৯৩৪ সালে প্রথম টেস্ট, ১৯৮৭ সালে প্রথম ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই মাঠে।

এমন ঐতিহ্যবাহী স্টেডিয়ামের প্রতি কল্পনার মানসপটে থাকা রোমাঞ্চ, ঘোরের ছবিটাতে একটা আঘাতই লাগল প্রেস বক্সে প্রবেশ করে। তিন তলায় উঠতে হয় লিফট ছাড়াই। ক্লাব হাউস গ্যালারির ওপর স্টিলের কাঠামোতে মাচার মতো প্রেস বক্স!

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই প্রেস বক্স থেকে অবশ্য গ্যালারি, মাঠ ভালোই দেখা যায়। তবে সাংবাদিকদের জন্য বসার স্থান মনে ধরেনি। স্টিলের চেয়ার ও ল্যাপটপ রাখার টেবিল খুবই ছোট আয়তনের।
sportsmail24
ইন্টারনেট ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয় (তখন এমনই ছিল)। ইডেন এমনই আছে অনেক বছর ধরে। হয়তো আমার প্রত্যাশার সঙ্গে মিলেনি। তাই প্রেস বক্স দেখে হতাশ হয়েছিলাম। কলকাতায় অনেক সহকর্মী আছেন, যারা এখানেই অহরাত্রি কাজ করেন। যেমনটা আমরা করি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। কলকাতার সহকর্মীরা এর মাঝেই আনন্দচিত্তে কাজ করে যান।

ইডেনকে নিয়ে আমার এই ভাবনা আসলে একান্তই নিজস্ব। অবশ্য পরে জানতে পেরেছিলাম, বাংলাদেশের অনেক সহকর্মীর ভাবনাও আমার সাথে মিলে গিয়েছিল।

ধারণ ক্ষমতায় ক্রিকেট দুনিয়ায় দ্বিতীয় হলেও সার্বিকভাবে মিডিয়া ফ্যাসিলিটিজের দিক থেকে ইডেনের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে বাংলাদেশের সবগুলো আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। এটা কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই বলা সম্ভব।

মন-উচাটান নিয়েই প্রিভিউর কাজ শেষ করেছি আমরা সবাই। তবে প্রিভিউ ডে এবং ম্যাচের দিন মিলে সত্যিই চক্ষু চড়কগাছ হয়েছে আমাদের। কলকাতা শহর, ইডেন সবই যারপরনাই বিস্ময় উপহার দিয়েছে। মাঠের ক্রিকেটে মাশরাফিদের আর মাঠের বাইরে আমাদের মোহভঙ্গ হয়েছে কলকাতা ও ইডেনকে ঘিরে।

ইডেনে আসতে আসতে পেয়েছিলাম মন ভোলানো পরিবেশ। বাংলাদেশি শুনেই, সবাই আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন। আর দু-একটা কথা পাড়ার পরই প্রসঙ্গ চলে যাচ্ছে ক্রিকেটে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলছে বলে, এমন আলোচনা খুব স্বাভাবিকই বটে। তবে সেখানে উল্লেখ্য হলো, বেশিরভাগ মানুষই ১৬ মার্চ ম্যাচে বাংলাদেশকে সমর্থন করার বিষয়টি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়েছে। মাশরাফির দল নিয়ে সবাই বেশ উচ্ছ্বসিত।

ভারতীয়দের পাকিস্তান বিরোধিতা এই প্রয়াসের একটা অংশ বটে। আবার এখানে অনেক বাংলাদেশিও আছেন। পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশের এমন অনেকেই আছেন। এরা সবাই ইডেনে টাইগারদের জন্য গলা ফাটাবেন বলছেন।

পাকিস্তানের হার কামনা করছেন ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে চা দোকানি, হোটেল মালিকসহ সবাই। মানে ১৬ মার্চ ইডেন, শেরেবাংলার গ্যালারির মতো ভুবনজয়ী উন্মাদনায় রূপ নেবে, আবহটা এমনই। বিমানে ৪০ মিনিট, সড়ক পথে ৩২৭ কিলোমিটার দূরেই মাশরাফিদের ঘর। অনেক জল ঘোলা করে বিশ্বকাপে আসা পাকিস্তানকে আপাদমস্তক বৈরী পরিবেশেই খেলতে হবে মনে হচ্ছিল!

তাছাড়া ক’দিন আগেই শেরেবাংলায় এশিয়া কাপে শহীদ আফ্রিদির দলকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই স্মৃতি তো তরতাজাই। সবমিলিয়ে ‘ইডেন হয়ে যাবে শেরেবাংলা!’ হেডিংয়ে একটা লেখাও আমি লিখেছিলাম। প্রথম রাউন্ডে দুটি জয়, এশিয়া কাপে ফাইনাল খেলা মিলে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা ছিল অনেক।

ইডেনে কাজ শেষ করে হোটেলে ফেরা। রাতে খালেক হোটেলে খাওয়া। ক্লান্তি-অবসাদে ঘুমিয়ে পড়া। সকালে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার টিকিট কাটা নিয়ে আলোচনা। দুপুরের মাঝেই বিমানের টিকিট কাটা হলো। ১৭ মার্চ সকালের ফ্লাইটে চলে যাব ব্যাঙ্গালোর।

দিবারাত্রির ম্যাচের জন্য রাস্তায় আসতেই দেখলাম দলে দলে মানুষ ইডেনে যাচ্ছে। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে একটা আলোচনাও চলছে। মাঝে মাঝে জার্সি পরা বাংলাদেশি সমর্থক দেখা গেছে। সেটা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তবে জনস্রোতের মাঝে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে হুল্লোড় ছিল নজর কাড়ার মতো।

খরতাপের দুপুরে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে, খুঁজে-খুঁজে পেতে হয়েছে ম্যাচ টিকিট। যার ঝক্কিটা ছিল অবর্ণনীয়। কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাব, ইডেনের উল্টো দিকে এমনটাই সবাই বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু অচেনা শহরে আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমনকি রাস্তার ট্রাফিক, মানুষ, ট্যাক্সিওয়ালা কেউ চিনতে পারছে না ক্লাবটি। অবশেষে মিনিট বিশেকের চেষ্টার পর পেয়েছিলাম কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাব।

প্রেস বক্সে আসতেই যেন এক লহমায় ঘোরের জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম। যেন একটা ছোটখাট ধাক্কা লাগলো মনোজগতে। খুব সরল অনুভূতি নিয়েই বলছি। হয়তো সেখানে কিছুটা আবেগ, কল্পনা, আশা জড়িয়ে আছে।
sportsmail24
১৯৯০ সাল তথা ২৫ বছর পর ইডেনের সবুজ জমিনে খেলছে বাংলাদেশ। এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ। একি, ইডেনের গ্যালারি যে চিরশত্রু পাকিস্তানের সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছে!

আহমেদ শেহজাদ, হাফিজদের প্রতিটি চার, ছক্কায় ইডেনে ঢেউ উঠছে। উৎসবের ঢঙে, প্রাণের উল্লাসে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কলকাতার মানুষ। চিরশত্রুর মাটিতে এমন সমর্থন খোদ আফ্রিদিরাও কখনো কল্পনা করেছিলেন কি না বলা কঠিন। ইডেনে সেদিন উপস্থিত দর্শকদের তিন ভাগের দুই ভাগ সমর্থনই পেয়েছিল পাকিস্তান।

ম্যাচ কভারে আসার আগে কলকাতার রাস্তায় কয়েকটা ব্যানার দেখেছিলাম, ‘ইডেন মানে খেলা, মানুষের মেলা’। কিন্তু দর্শকদের এমন পাকিস্তান প্রীতির পর মন বলছিল স্লোগানটা হতে পারতো, ‘ইডেন মানে খেলা, ইডেন মানে পাকিস্তানের ঘাঁটি’। আফ্রিদিদের প্রতি কলকাতার মানুষের প্রকাশ্য টানের রহস্যও পরে জানা গেল।

স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার এক সাংবাদিক জানালেন, আসলে কলকাতায় যারা হিন্দি ভাষী মুসলিম আছে তারা সবাই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। আফিদ্রির খেলা তাদের খুব পছন্দ। কলকাতায় যারা বাংলা ভাষী মুসলিম আছে তারা বাংলাদেশকে পছন্দ করে। সেদিন মাঠে এসেছে বেশি হিন্দি ভাষী মুসলিম। তাছাড়া রাজাবাজার, খিদিরপুর, মেটিয়াবুরজ, পার্ক সার্কাস, পিকনিক গার্ডেন, হাওড়াতে প্রচুর বিহারী মুসলিম রয়েছে। এরা সবাই পাকিস্তানের সমর্থক।

পাকিস্তানকে ইডেনের বাহারী অভ্যর্থনায় আমাদের এবং মাঠে ৫৫ রানের পরাজয়ে টাইগারদেরও মোহভঙ্গ হয়েছিল। কারণ, জয়ে সুপার টেন পর্ব শুরুর করার স্বপ্ন ছিল মাশরাফিদের।

তবে এই ইডেনেই সেদিন আমার জীবন পেয়েছিল নতুন ‘বন্ধু’র সন্ধান। কলকাতার দৈনিক ‘কলম’ পত্রিকার স্পোর্টস রিপোর্টার আবুল হোসেনের সঙ্গে কথায় কথায় দারুণ হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল। সমবয়সী বলে আলাপ জমতে সময় লাগেনি। পরে ভারত সফরে বাকি সময়টাতে তার সাহায্য পেয়েছি। আমাদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট। অর্ন্তজালের দুনিয়ায় ওর সাথে যোগাযোগটা নিয়মিতই হয়।

এছাড়া ক্রিকেট পোর্টাল ‘ক্রিকউইজ’ এর রিপোর্টার সন্দিপন ব্যানার্জিও অনেক সহযোগিতা করেছিল। ওর সাথে পরিচয় অবশ্য ২০১৬’এর শুরুতে ঢাকায় আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। সন্দিপন টুর্নামেন্টটা ঢাকায় কভার করতে এসেছিল। যেই পরিচয় ক্রমে ক্রমে ‘সৌজ্যনতার’ গন্ডি পেরিয়েছিল।

চলবে...

সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

বোনাস পয়েন্টে পাকিস্তানের অপেক্ষা বাড়িয়ে বিশ্বকাপে ভারত

বোনাস পয়েন্টে পাকিস্তানের অপেক্ষা বাড়িয়ে বিশ্বকাপে ভারত

ধোনি কিভাবে দলে সুযোগ পাবে : গৌতম গম্ভীর

ধোনি কিভাবে দলে সুযোগ পাবে : গৌতম গম্ভীর

মারকুইস স্ট্রিট : কলকাতার বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ

মারকুইস স্ট্রিট : কলকাতার বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত