১২ মার্চ তথা শনিবার রাতেই বৃষ্টি বন্ধ হয়েছিল। প্রকৃতির কান্নার বিরতির সময়টা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করি। ১৩ মার্চ রোববার সকালে ফোন করতেই আধঘণ্টার মধ্যে ট্যাক্সিসমেত চালক সুরিন্দর সিং হাজির। এ ক’দিনে তার সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। প্রাতরাশ সেরে আমরা ক’জন চেপে বসি সুরিন্দরের ট্যাক্সিতে।
গন্তব্য আগেই বলা ছিল। পাহাড়ের শরীর বেয়ে গড়ে ওঠা আঁকাবাঁকা, খাড়া রাস্তা ধরে ট্যাক্সি এগিয়ে চলছে। উঁচু থেকে উঁচুতে যাচ্ছি। ধর্মশালার সবচেয়ে অভিজাত তবে ছোট্ট শহর ম্যাকলয়েডগঞ্জ। সেখান থেকেও ৩ কিলোমিটার পরে নাদ্দি। নাদ্দির ভাগসু নামক স্থানই ছিল আমাদের গন্তব্য। নাদ্দিও ধর্মশালার একটা ছোট শহর। খুব সকাল বলে ভাগসুর দোকানপাট খুলেছে, তবে মানুষের আনাগোনা কম। একটা বাজারের সামনে আমাদের ট্যাক্সি থামলো। ভাগসুর প্রসিদ্ধ বাজার এটি।
সুরিন্দরের দেখানো পথে হাঁটা শুরু করি আমরা। খুবই সুরু পথ ধরে এগিয়ে যেতেই সিমেন্টের তৈরি রাস্তা পাওয়া গেল।
হ্যাঁ, ওই দূরে পাহাড়ের চূড়া হতে ঝরে পড়ছে জলপ্রপাত।
ঢাল বেয়ে নামছে সাদা জলরাশি। ঠিক যেন মধ্য দুপুরে গোসল শেষে কিশোরীর পিঠে ছড়িয়ে থাকা এলোচুল। গিরিপ্রপাতের আর্কষণে হাঁটা শুরু। পথ আর শেষ হয় না। একের পর এক উঁচু রাস্তা বেয়ে উঠছি। উঁচুতে উঠতে উঠতে ক্রমশ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে, হাঁপাচ্ছি সবাই। গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার অবস্থা। আবার সবই যেন তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে ঝর্ণার দুর্নিবার টানের কাছে!
পাহাড়ের বিভিন্ন ধাপে পর্যটকদের জন্য চায়ের দোকান আছে। সেখানে হালকা প্রাতরাশ সেরে ফেলার মতো সব উপাদেয় খাবারই আছে। তবে দোকানীরা পর্যটকদের ডাকাডাকি করে না। যাদেরই খাবার প্রয়োজন তারা চলে আসে দোকানে।
দুই-একবার ক্ষণিকের বিশ্রাম নিয়ে সুবিশাল জলপ্রপাতের কাছাকাছি পৌঁছাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। এতক্ষণ পাহাড় ডিঙানোর কষ্ট সবই এক নিমিষে যেন পালিয়ে গেল। হিম শীতল একটা বাতাস অনুভূত হলো। পানিতে হাত দিতেই যেন হাতটা অসাড় হওয়ার যোগাড়। বেশ দীর্ঘ গিরিপ্রপাত থেকে পানির ছটা এসে পড়ছে সবার শরীরে। সাদা, স্বচ্ছ পানি। ঝর্ণার একবারে নিচে কয়েকটি বড়বড় পাথর। সেখানে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে তথা নানা ভঙ্গিতে মুহূর্তটাকে সময়ের ফ্রেমে বন্দি করতে ব্যস্ত সবাই।জলরাশির লাগোয়াই রয়েছে সুভ্যেনির, কাপড়-চোপড়ের দোকান। সময় যত গড়ালো পর্যটক ততই বাড়তে থাকলো। খোদ ভারতীয়দের মতো বিদেশি পর্যটকরাও আসতে শুরু করলেন। ভীড় বাড়তে লাগলো। এর মাঝে কয়েক ইউরোপিয়ান পর্যটকদের সঙ্গে ছবি তুললাম। জার্মানির এক মহিলাকে বললাম, আমি তোমার হাজবেন্ড কই? কিছুটা দাঁড়িয়ে থাকা এক লোককে দেখিয়ে দিল ওই নারী।
তখন আমি বললাম, ১ মিনিট ওকে ভুলে যাও। এই ১ মিনিট আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড! কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়া চলো ছবি তুলি।
মহিলা বলল, আচ্ছা চলো ছবি তুলি, তুমিই আমার বয়ফ্রেন্ড। আবার কানে কানে বললো, আমার হাজবেন্ড শুনলে মারবে কিন্তু (বলেই হাসি)।
যদিও দূর থেকে আমাদের ছবি তোলার পর্বটা দেখেছেন ওই ভদ্রলোক (মহিলার স্বামী)।
আসিফ মাহমুদ তপু আমাদের ছবি তুলে দিল। দুই বড় ভাই- পলাশ ভাই, শামীম ভাই পাশেই দাঁড়িয়ে দেখলেন। তারা অবশ্য ছবি তুলেননি।
মন ভোলানো জলপ্রপাত দর্শনের পালা শেষ করে আমরা যখন ভাগসু, নান্দি ছাড়ছি ততক্ষণে আকাশে সূর্য উঠেছে। মিঠে রোদের তাপ টের পাচ্ছে শরীর। পাহাড়ের চূড়ায় থাকা বরফখন্ড সূর্যের তাপে চিকচিক করছে। সুবিশাল ভাগসু ঝর্ণার মায়া ছেড়ে সুরিন্দরের ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে ছুটে চলে নতুন গন্তব্যে।
এবার গন্তব্য সমুদ্রপৃৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৭৭৫ মিটার উঁচুতে কাংগ্রা জেলার টোটা রানি গ্রাম। হিমাচল প্রদেশের এই গ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে। পুলিশের সতর্ক পাহারাও রয়েছে। টোটা রানি গ্রাম থেকে পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ খ্যাত জম্মু-কাশ্মীরের দূরত্ব মাত্র ২১৭ কিলোমিটার।
কাশ্মীরের বিখ্যাত ডাল লেক এর নামকরণে টোটা রানি গ্রামেও আছে ডাল লেক। হ্রদ, দীঘি না বলে এখানকার ডাল লেক কে কিছুটা লম্বাটে, বড় আকারের জলাশয় বলাই শ্রেয়। ট্যাক্সি চেপে এখানে এসে জলাধার ও চারপাশে বাহারি গাছ দেখে তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ কম।
কথায় আছে, পর্যটকরা খালি হাতে ফিরে না। কিছু না কিছু অমলীন স্মৃতি ঠিকই সঙ্গী হয় পর্যটকের। ডাল লেক-এ এসে আমরাও শেষ পর্যন্ত অতৃপ্ত থাকিনি।
লেকের পাশেই খোলা মাঠে একদল কিশোর-কিশোরী ক্রিকেট খেলছিল। ক্রিকেটের নেশা তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে ঠান্ডার প্রতাপ। তাদের ম্যাচের মাঝেই আমার আবদার রাখতে দুটি বল ব্যাটিং করার সুযোগও দিয়েছিল এই ক্ষুদে ক্রিকেটাররা। পরে বাংলাদেশের নাম শুনতেই যেন জনা দশকের দলটার সবার চোখে-মুখে বিস্ময় আর আনন্দ খেলে গেল। পলকেই তাদের কাছে অতিথির মর্যাদা পেয়ে গেলাম আমরা ক’জন বাংলাদেশি সাংবাদিক।
টোটা রানি গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের কাছে বাংলাদেশের নামটা পরিচিত ক্রিকেটের কারণেই। এদের কারও প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, কারও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, কারো আবার বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ও হালের তারকা মোস্তাফিজুর রহমান। স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করে এরা সবাই। টোটা রানি সরকারি বয়েজ স্কুল, ও হিমাচল সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীই বেশি।
পুরো দলটাতে একমাত্র কিশোরীর নাম অনন্যা। লাল সুয়েটার জড়ানো সোনালী গারুয়া বর্ণের অনন্যা। ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে বীরদর্পে ক্রিকেট খেলছে সে। ফিল্ডিং, বোলিং, ব্যাটিং করছে সমানতালে। অনন্যার প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি।
স্যাটেলাইটের এই যুগে নড়াইল এক্সপ্রেসের প্রেমে মজে আছে এ কিশোরী। তার খুব পছন্দ মাশরাফিকে। জীবনের কোন এক সময় সাক্ষাতের সুযোগ পেলে, অনন্যার প্রথম চাওয়া মাশরাফির অটোগ্রাফ।
অংশু নামক কিশোরের প্রিয় ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বাংলাদেশি এ ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং খুব ভালো লাগে অংশুর। মাহমুদউল্লাহর অটোগ্রাফ তার চাই চাই।
আমার অনুরোধে সমস্বরে ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে গ্রুপ ছবিতে অংশ নিয়েছে ক্ষুদে ক্রিকেটারদের এ দলটা। যথারীতি ছবি তুলেছেন তপু। সেখান থেকে যখন ফিরছি তখন পেছন থেকে ওরা আবার আমাদের ডাকলো।
বাংলাদেশের স্মৃতি হিসেবে আমাদের কাছ থেকে কিছু চায় ওরা। কী দেব, ভাবছিলাম। এর মাঝে ওরাই এগিয়ে এসে বলে কিছু লিখে দিতে।
মাশরাফি-মাহমুদউল্লাহদের না পেলেও আমরা ক’জন সাংবাদিকদের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্মৃতি রেখে দিয়েছে অনন্যারা। নিজেদের খেলার জার্সিতে, মোবাইলে, ট্যাবে ‘বাংলাদেশ’ কে ধারণে এ কিশোর-কিশোরীদের চেষ্টা যারপরনাই পুলকিত করেছে আমাদের সবাইকে।
একটু লজ্জাবনত হয়ে বলেই ফেলি, ওরা আমার অটোগ্রাফই নিয়েছিল! যে স্মৃতি আমি কখনোই বিস্মৃত হতে পারবো না।
টাইগারদের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি অনন্যাদের ভালোবাসা সত্যিই অতুলনীয়। বিশেষ করে অনন্যার কথা পরেও বেশ মনে পড়েছে। ও জ্যাকেটের মাঝে অটোগ্রাফ নিয়েছিল। একবার মনে হয়েছিল, নাম্বার বা ফেসবুক আইডি চেয়ে নেই। কিন্তু শেষ অব্দি আর নেওয়া হয়নি।
দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখেছিলেন পলাশ ভাইরা। কাছে গিয়ে গাড়িতে উঠতেই শামীম ভাই বলেছিলেন, কি নাম্বার নিয়েছো ওই মেয়ের? আমি বললাম, না বড় ভাই, নেইনি তো।
উনি আবার বললেন, আরে নিতে পারতে। তোমাকে যেমন সম্মান দিল। চাইলে দিত। পরে যোগাযোগ করতে পারতা। এসবই তো স্মৃতি।
পলাশ ভাইও সুর মেলালেন শামীম ভাইয়ের সাথে। উনিও বললেন, নাম্বার নিয়ে রাখা উচিত ছিল আমার।
দুই বড় ভাই হয়তো রসিকতা বা মন থেকেই বলছিলেন কথাগুলো। যা আমার মনেও দাগ কাটে। বড় ভাইদের কথা শুনে, অলক্ষ্যে আমি যেন আবার পেছনে ফিরে তাকালাম গাড়িতে বসেই। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দূরে চলে এসেছিলাম আমরা। অনন্যা-অংশুদের আর দেখতে পাইনি।
ওখানেই ধর্মশালার সৌন্দর্য দর্শনের মিশনে ইতি টানতে বাধ্য হই আমরা। দুপুর হয়ে যাচ্ছে। হোটেলে ফেরার তাড়া আছে। বিকেলেই বাংলাদেশ-ওমান ম্যাচ ছিল।
১৩ মার্চ দিনটা আবার ধর্মশালায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের শেষ দিন। স্টেডিয়ামে যাওয়ার আগেই আমরা স্থানীয় ট্রাভেলস থেকে দিল্লির জন্য বাসের টিকিট কেটে ফেলি। সেখানেই আবার দিল্লি থেকে কলকাতার ফ্লাইটের টিকিটও কিনেছিলাম।
আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ দিনের প্রথম ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে ১২ রানে হারিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডস। দারুণ জয়ে বিশ্বকাপ শেষ করে ডাচরা। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ পেয়ে যায় সুপার টেনের টিকিট। পুঁচকে ওমানকে ডিএল মেথডে ৫৪ রানে হারায় মাশরাফির দল। তবে ম্যাচটা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এই ম্যাচেই দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তামিম ইকবাল।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির খরা কাটিয়েছিল বাংলাদেশ ২০১৫ সালে। পঞ্চমবার অংশগ্রহণে দেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তাও জোড়া সেঞ্চুরি। ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাট টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসরে সেঞ্চুরি শূন্য ছিল বাংলাদেশ। ষষ্ঠ আসরে সেটির পূর্ণতা আসল বাংলাদেশ তামিমের ব্যাটে।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে দেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের গৌরব অর্জন করলেন তামিম। অপরাজিত ১০৩ রান করেন ৬৩ বলে। বিধ্বংসী, খুনে ব্যাটিংয়ের ইনিংসে তামিম হাঁকিয়েছেন ১০টি চার ও ৫টি ছক্কা। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ৫৮তম ম্যাচে সেঞ্চুরি খরা কাটে বাংলাদেশের। তামিম ৪৯তম ম্যাচে পান তিন অংকের ম্যাজিক ফিগারের দেখা।
চলবে...
সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- ভারত ভ্রমণের দিনলিপি