জয়, ইতিহাস ও ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা

স্পোর্টসমেইল২৪ স্পোর্টসমেইল২৪ প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০২০
জয়, ইতিহাস ও ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা

করোনার একপাক্ষিক দাপটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এই রঙিন পৃথিবী। এই পৃথিবীর আকাশে এখন কেবলই ধূসর মেঘ। পৃথিবীর অশান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে একটুকু সুখ খুঁজতে মানুষের এদিক সেদিক ছুটে চলা তবুও কি সুখের দেখা মিলছে? পৃথিবী এখন শুধু হাহাকারে নিমজ্জিত। করোনার কবলে পড়ে নিরব নিথরের মতো হয়ে আছে মিরপুর, মেলবোর্ন কিংবা লর্ডস কিংবা নূ-ক্যাম্প, অ্যানফিল্ড। এরই মাঝে একটু সুখের ছোঁয়া পেতে আমরা ফিরে যেতে যাই ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল আজকের এই দিনে। যেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটর সূর্য্য উঠে ছিল, যেদিন থেকে শুরু হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন পথচলা।

সময়টা ১২ এপ্রিল, ১৯৯৭ সাল
সেমিফাইনালের ম্যাচের মত ফাইনালেও বৃষ্টির বাগড়া। রিজার্ভ ডে থাকার কারণে সিদ্ধান্ত হলো দুইদিন খেলা হবে, একদল প্রথম দিন আর অন্য দল দ্বিতীয় ব্যাট করবে। আউটফিল্ড ভেজা থাকায় সহায়তা পেতেই টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকরাম খান।

টসে হেরে ফিল্ডিং করতে নেমে ইনিংসের প্রথম ওভারেই আসিফ করিমকে বোল্ড করে সাজঘরে ফেরান পেসার সাইফুল ইসলাম। তিন নম্বরে নামা কেনেডি ওটিয়েনোও সুবিধা করতে পারেননি। দলীয় ১৫ রানের মাথায় সাইফুলের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যান। দলের এমন সময়ে হাল ধরেন কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভ টিকোলো। টিকোলো ও গুপ্তার ৪৩ রানে জুটি ভাঙেন খালেদ মাহমুদ।

এরপরে অধিনায়ক মরিস উদম্বে ও টিকোলো মিলে বাংলাদেশকে নাকাল করে দেয়। টিকোলো রীতিমত টাইগার বোলারদের শাসন করতে লাগলেন। এরপর ত্রাতা হয়ে টিকোলো ও উদম্বের ১৩৮ রানের জুটি ভাঙেন মোহাম্মদ রফিক। ৪৩ রানে উদম্বকে স্ট্যাম্পিং করেন পাইলট। এরপর ১৪৭ রানে মহাকাব্যিক ইনিংস খেলা স্টিভ টিকোলোকে ফেরান খালেদ মাহমুদ টিকালোর বিদায়ের পর আর কেউ সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। শেষপর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৪১ রান তোলে কেনিয়া।

বাংলাদেশের হয়ে ৩টি উইকেট নেন স্পিনার মোহাম্মদ রফিক আর ২টি করে উইকেট নেন খালেদ মাহমুদ ও সাইফুল ইসলাম। আর এরই মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের প্রথম দলে খেলা। 

১৩এপ্রিল, ১৯৯৭ সাল
বাংলাদেশ সময় সকাল ৭ টায় খেলা শুরু হবে তাই তো বহু আশা নিয়ে বাংলাদেশ বেতারের কান পাতলো ১১ কোটি মানুষ। তবে হঠাৎই শঙ্কার বানী ভেসে আসলো চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফাতের কন্ঠে। কুয়ালালামপুর মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টি থামলেও খেলার হওয়ার সম্ভবনা কম কারণ ড্রেনেজ সিস্টেম খুব একটা ভালো না। চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মাঝে। হঠাৎই বৃষ্টি থেমে গেল তারপর যা হলো তা কেবলই ইতিাহাস। ইতিহাসে এমন আর কখনো কোথাও ঘটেছিল কি না জানা নেই হয়তো ঘটেওনি আর কখনো ঘটবে কি না তা বলাও বিরল।

বহুসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি যারা খেলা দেখতে মাঠে ছিলেন, তারা পানি ভরা মাঠে নেমে স্বেচ্ছায় গ্রাউন্ডসম্যান হয়ে গেলেন! তৎকালীন বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীও তাদের সাথে যোগ দিলেন! বালতি-বেলচা, ঝাড়ু আর তোয়ালে যে যেভাবে পেরেছেন, তাই নিয়ে কাজ শুরু করলো সবাই, যাতে যেকোনো মূল্যে খেলা শুরু করানো যায়। ভাবা যায়, কতটা দেশপ্রেম থাকলে উপস্থিত সকলে এমনটা করেতে পেরেছিলেন। আসলে সেই প্রবাসীরা ছিলেন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের নেপথ্যের অবিসংবাদিত মহানায়ক!

অনেক বাংলাদেশি দেশ থেকেও গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক এই ফাইনাল ম্যাচ দেখার জন্য। দেশের তারকা খ্যাতি নিয়ে চলা একাধিক মানুষজন মাঠ পরিচর্যায় নেমেছিলেন। শুধু দেশের জন্য! কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর ক্রিকেট মাঠে গ্রাউন্ডসম্যান হয়ে যাওয়া ইতিহাসে নেই, এটা অন্তত চ্যালেঞ্জ করে বলাই যায়! ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত খ্যাতিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী যেন আরেক রকম সংগ্রামে নেমেছিলেন! ম্যাচ মাঠে গড়ানোর সংগ্রাম!

sportsmail24ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশ দলের মিছিল, ১৩ এপ্রিল ১৯৯৭

তারপর ঘোষণা হলো দুপুর দেড়টায় শুরু হবে খেলা। অনেক দেরিতে শুরু হওয়ায় ওভার কমে আসবে তা অনুমেয়ই ছিল। অবশেষে ২৫ ওভারে বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়ালো ১৬৬ রান। সে সময় ওভার প্রতি ৬ রান করে তুলে জিততে পারবে তো বাংলাদেশ? এমন চিন্তায় বিভোট কোটি সমর্থক। শঙ্কায় যখন বিভোর সমর্থকরা তখন ওপেনিং চমক দেখালেন টিম ম্যানেজমেন্ট। ওপেনিং আতাহার আলীকে না নামিয়ে ওপেন করতে দুর্জয়ের সাথে পাঠালেন হার্ডহিটার মোহাম্মদ রফিককে। প্রথম ওভারেই বজ্রঘাত নেমে আসলো সমর্থকদের। ইনিংসের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে ফিরে যান দুর্জয়।

তারপর নান্নুকে নিয়ে ঝড় তুললে মোহাম্মদ রফিক। টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করে দ্রুতই নান্নুর সাথে ৫০ রানের জুটি গড়েন রফিক। তারপরই ১৫ বলে ২ চার ও ২ ছক্কার কল্যাণে ২৬ করে আউট হন রফিক। রফিকের বিদায়ের পর ২৬ রান করে সাজঘরে ফিরেন নান্নুও। এরপর দলের প্রতিরোধ গড়ে তুলেন অধিনায়ক আকরাম খান ও সহ-অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। হঠাৎই আবারও ছন্দপতন, বুলবুল ৩৭ রান করে আউট হয়ে গেলে ভাঙে ৫৩ রানের জুটি। এরপর দলীয় ১১৮ রানে ২২ রান করা আকরাম ও দলীয় ১২৩ রানে ৫ রান করা এনামুল হক মণি আউট হয়ে গেলে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ।

১৩ বলে ১৪ রানের মহামূল্যবান ইনিংস খেলে বিদায় নেন সাইফুল। পাইলট একটি ছক্কা ও সুজন একটি বাউন্ডারি মারলে স্বস্তি আসে টাইগার শিবিরে৷ তবে জয় থেকে ১৫ রান দুরে থাকতে ৫ রানে স্ট্যাম্পিং হয়ে সাজঘরে ফিরেন সুজন। শেষ ওভার জয়ের জন্য ৬ বলে দরকার ১১ রান। যেখানে ৬ রান করাই কঠিন সেখানে ১১ রান। এমনটা ভাবতেই যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো ১১ কোটি মানুষের।

শেষ ওভারে মার্টিন সুজির হাতে বল তুলে দিলেন অধিনায়ক উদম্ব। ওভারের প্রথম বলেই ফুলটস পেয়ে ছক্কা হাঁকান পাইলট। শেষ ৫ বলে দরকার ৫ রান। দ্বিতীয় বলে ডট, তবে পরের বলে ওয়াইড যাওয়ায় আবার সমীরকণ দাঁড়ায় ৪ বলে ৪ রান। তৃতীয় বলে পাইলট হালকা করে ঠুকে দিয়ে দৌড়ে এক রান নেন। তখনও ৩ বলে প্রয়োজন ৩ রান। চতুর্থ বলে টাইমিল করতে না পারায় কোন রান হলো না। সমীকরণ গিয়ে দাঁড়ালো ২ বলে ৩ রান। পরের বলেই শান্তর জোরালো শট। সবাই ভেবে নিয়েছিল এটাই উইনিংস শট তবে ভেজা আউট ফিল্ড ২ রানের বেশি নিতে দেয়নি। শেষ বলে প্রয়োজন ১ রান।

পরে দৌড় শুরু করলেন সুজি, প্রস্তুত শান্ত। শেষ বলটি লেগ স্ট্যাম্পের বাহিরে বের হতে যাওয়ার আগেই তা শান্তর প্যাডে লাগার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত আর পাইলটের ভো দৌড়! বল চলে গেল ফাইন লেগে থাকা ফিল্ডারের হাতে আর ১ রান নেয়ার সাথে সাথে চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফাত বলে উঠলেন চিৎকার করে- ”এবং বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭ সালের চ্যাম্পিয়ন’! সাথে সাথেই উৎসবের দেশ হয়ে গেল বাংলাদেশ! শান্ত ও পাইলটের দুই হাত উঁচু করে দেওয়া ছবিটা এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

sportsmail24১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের পর শিরোপা হাতে আকরাম খান

আজ থেকে ২৩ বছর আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের পথ তৈরী করে দেওয়া এই ম্যাচের বিবরণ নানাভাবে নানা আঙ্গিকে হয়তো তুলে ধরা  যাবে, কিন্তু  এই অর্জনের মাহাত্ত কি কখনো লেখার অক্ষরে বা মুখের ভাষায় প্রকাশ করা যাবে? এমন অর্জন কেবল অনুভব করেই উপলব্ধি করা যায়, পড়ে বা শুনে নয়! এই বিজয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও সবাইকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিল।



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

একসাথে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া কিংবদন্তিদের গল্প

একসাথে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া কিংবদন্তিদের গল্প

দুই দশকে ঘরের মাঠে টেস্ট ক্রিকেটে কে সেরা?

দুই দশকে ঘরের মাঠে টেস্ট ক্রিকেটে কে সেরা?

দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

দালাইলামার মন্দিরে সাকিব ভক্ত

স্বাধীনতাকামী তিব্বতী ও ঘটনার ঘনঘটা

স্বাধীনতাকামী তিব্বতী ও ঘটনার ঘনঘটা