দিল্লিতে অবতরণের পর লাগেজ ফিরে পেতে সময় লাগেনি। এয়ারপোর্টে ওই টুকু কাজ শেষ করে ট্যাক্সির খোঁজে নামতে হলো। আমার বন্ধু শুভাশীষের পরামর্শ অনুযায়ী যেতে হবে কাশমেরি আইএসবিটি বাস স্ট্যান্ডে। সেটা দিল্লি শহরের ভেতরে। ট্যাক্সি ঠিক করার পর সন্ধ্যা রাতের অন্ধকারে ব্যস্ত রাস্তায় ভারতের রাজধানী দিল্লি দেখার চেষ্টায় নিমগ্ন সবাই। পথে দিল্লির যানজটের অভিজ্ঞতাও নিতে হয়েছে।
ঘণ্টা খানেক লেগে গেল কাশমেরি বাস স্ট্যান্ডে যেতে। বাস স্ট্যান্ডটা অনেক বড়। আমরা তিনটে ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। মজার বিষয় হলো, তিনটে ট্যাক্সি আমাদের ওই বাস স্ট্যান্ডের তিন গেইটে নামিয়ে দিল (পরে বুঝেছিলাম)। কারও সাথে কারও দেখা নেই। ফোনে কথা হচ্ছিল। সবাই বলছি, আমরা নেমেছি, আমরা এসে পড়েছি।
কিন্তু কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছিলাম না কোন গেইটে আছি বা সেখানে কীভাবে যেতে হয়। এমন সঙ্কাটাপন্ন অবস্থায় কিছুক্ষণ কেটে গেল। আমার সঙ্গে থাকা আরও তিনজন মিলে আমরা বাস স্ট্যান্ডের ভেতর দিয়ে অন্য পাশে গেলাম। সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে পেলাম। ক্ষণিক পরে বাকিরাও চলে এলেন ওই জায়গায়।
এসব বাড়তি অনুসঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা সময় গেল। এবার বাস ঠিক করার পালা। পাওয়া গেল এক বাঙালিকে। সে জানালো তার বাস আছে। ধর্মশালা যাওয়া যাবে।
বন্ধু শুভাশীষ বলে দিয়েছিল, হিমাচল প্রদেশ সরকারের ভলবো বাস আছে। সেটা রাত ১০টা পর্যন্ত পাওয়া যায়। আমরা যেন সেটাতেই ওঠে পড়ি। কিন্তু এই বাঙালির কথায় অপেক্ষা করতে হলো। আমাদের কয়েকজন গেলেন তার সাথে বাস দেখতে। মিনিট বিশেক কেটে গেল। ঘড়ির কাটা ১০টা পার হয়েছে। ফিরে এসে তারা জানালেন, বাস পছন্দ হয়নি।
তারপর আবারও শুভাশীষের সঙ্গে আলাপ করে ভলবো বাসের সন্ধানে বের হলাম। শুভাশীষের তথ্য অনুযায়ী ২০ নং কাউন্টারে পাওয়া যায় ওই বাস।
সিড়ি দিয়ে উঠানামা করতে হচ্ছে। পেটে তখন রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সবারই প্রায় একই অবস্থা। এর মাঝে এক সঙ্গে অনেক লোক এবং বাক্সপেটরাসহ দেখে ‘কিদার জানা হে, এদার আইয়ে, আচ্ছা বাস হে হামারি’ জাতীয় যন্ত্রণা তো কানের কাছে বাজিয়ে চলেছেন স্থানীয়রা।
আমি ও বন্ধু মিথুন আশরাফ জিজ্ঞাসা করতে করতে এগিয়ে গিয়ে খুঁজে পেলাম ২০ নং কাউন্টার। ধর্মশালার অনেক বাস আছে। কিন্তু আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত বাস একটিই দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ রঙের বাস। আমাদের দেখে লিকলিকে গড়নের সুপারভাইজার এগিয়ে এলেন।
বর্ণনায় বললাম, আমরা ১০ জন আছি, ধর্মশালা যাব। আনুসাঙ্গিক তথ্যও জেনে নিলাম। সে আবার তাড়া দিল, তার বাসা ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। যেতে হলে দ্রুত আসতে হবে। আমি বললাম, তুমি দাঁড়াও ১০ মিনিটের মাঝে আসছি। খাওয়ার কথা, ক্ষুধার কথা তখন ভুলে বসেছি।
সুপারভাইজার বললো, আমার টাইম নেই, লাইন ছেড়ে দিতে হবে। একটু সামনে দাঁড়াবো তুমি সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আসো।
তারপর শুরু সিড়ি, প্যাসেজে দৌড়াদৌড়ি। পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ। হুড়োহুড়ি করে আরেক প্রান্তে থাকা সবার কাছে গেলাম। বাস ঠিক হয়েছে জানিয়ে, লাগেজ-ব্যাগ সমেত দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু। অনেকে অনেক প্রশ্ন করলেন, সেদিকে মনোযোগী হওয়ার সময় কই।
সবার ব্যাগগুলো চেকিং করাতে হলো বাস স্ট্যান্ডে। ওইসব শেষ করে এসে দাঁড়াতেই দেখি আসলে সত্যিই বাসটা কাউন্টারে নেই! আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন সেই মধ্যবয়সী সুপারভাইজার। অন্ধকার একটা জায়গায় বাসটা আমাদের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে। লাগেজগুলো বাসের বক্সে দেওয়া শেষে সুপারভাইজারকে বললাম, ভাই পেটে খুব ক্ষিধে, রাতে কেউ খাই নাই, খেতে হবে। সে জানালো, এক ঘণ্টা পরই বাস দাঁড়াবে খাওয়ার হোটেলে।
আরও এক ঘণ্টা পেটকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখার মনস্থ করেই বাসে উঠলাম। এসি বাস, আরামদায়ক সিট। এক কথায় ক্লান্ত শরীরের জন্য এটুকু যেন, ‘গুড় না চাইতে রীতিমতো সন্দেশ’ পাওয়ার মতো।
মৃসণ রাস্তায় দুরন্ত গতিতে ছুঁটছে বাস। বাইরের নিয়ন আলোয় প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করলাম। আয়েশি স্লিপিং সিট ছিল বলে বাসের সার্বিক বিষয় মনে প্রশান্তিই ছড়ালো। জানালা দিয়ে দেখছি, অনেক সুন্দর রাস্তা। কয়েকটা লেন। কার, ট্রাক, বাস, ছোট গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন লেন দিয়ে আপন গতিতে ছুঁটছে।
আরামপ্রদ বাসের আলোচনা, শেষ মুহূর্তে বাস পাওয়ার স্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ হলো। তারপর কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বাসে অন্য যাত্রীও ছিল। আমাদের কথোপকথন তাদেরও নজর কেড়েছিল। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল। বাসে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় মোবাইল চালু রাখতে পেরেছিলাম।
এক ঘণ্টা পরই একটা বড় ধাবায় বাস (ধাবা মানে খাবার হোটেল) থামলো। ঘুমু ঘুমু চোখে সবাই নামলাম। ধাবাটা দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল। কৃত্রিম আলোয় পুরো জায়গাটা যেন ফুটছে। তার চেয়ে বেশি চোখে পড়লো, ‘আমরিক সুকদেব’ নামক ধাবার বিশালত্ব। ঢাকার কারওয়ান বাজারের বসুন্ধরা সিটির চেয়ে আয়তনে সামান্য ছোট হতে পারে।
মৃদু বাতাস বইছে, অনেকেই বাইরে বসে খাচ্ছেন। আবার ভেতরের বিরাট জায়গাও লোকজনে ভর্তি। দু-তিন জন ছাড়া আমরা সবাই ভাত খেলাম, সঙ্গে ছিল রুটি। এখানে স্ন্যাকস, ফাস্ট ফুড, মিষ্টান্ন, অন্যান্য খাবারের আলাদা বিভাগ আছে। সবমিলিয়ে সুপরিকল্পিত সৌন্দর্যই চোখে ধরা পড়েছিল।
চোখ এড়াবে না ভারতীয়দের পরিবার সমেত ধাবায় খেতে আসার লাইন। রাত ১২টা বাজলেও কী হবে, ভিড় কমছে না আমরিক সুকদেবের বিভিন্ন কাউন্টারে। কিছুটা পাঞ্জাবি সংস্কৃতির লোকই বেশি দেখলাম।
আবশ্যক ভোজন পর্ব শেষে আবার বাসে চড়লাম সবাই। পথে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। মাঝে চন্ডিগড়ে বাস থামলো মিনিট দশেকের জন্য। বাসে ঘুমিয়ে পড়া, আবার ঘুম ভেঙে একটু বাস থেকে বাইরে তাকানো, এভাবেই কাটছিল রাত। এর মাঝে চন্ডিগড়, পাঞ্জাব, হরিয়ানা রাজ্য পার হয়েছে আমাদের বহনকারী বাস। ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল।
বলুন, ভাঙতে বাধ্য। কারণ, ততক্ষণে বাস যে হিমাচল রাজ্যে প্রবেশ করেছে। আকাঁ বাকাঁ পাহাড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। ওই রাস্তায় চলার সময় বাসের ঝাঁকুনিই ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার মতোই। খাঁড়া রাস্তা দেখে ভয়ও জাগে মনে। বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে এগুচ্ছে বাস।
বাইরে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপূর্ব আয়োজন। চোখ ফিরিয়ে নেওয়া দুঃসাধ্য কাজ। বাসের গতিপথ, মনোহর প্রকৃতি উপভোগ করতে করতেই কাটছে সময়। পাহাড়, পাহাড়ের ভাজে ভাজে থরে থরে সাজানো বসতি তথা বাড়ি-ঘর। এসব ছেড়ে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
এসি বাস হলেও আস্তে আস্তে একটা হিম শীতল পরিবেশ অনুভব হচ্ছিল। প্রকৃতির সুবিন্যস্ত রূপই বলে দিচ্ছিল, হিমাচলে এসেছি। সকাল হয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাটে এখনও মানুষ নেই বললেই চলে। দোকান-পাট খুলেনি। মাঝে মাঝে কিছু ট্যুরিস্ট বাস দেখা যাচ্ছে। ধর্মশালা পৌঁছানোর মিনিট চল্লিশেক আগে থামলো বাস।
এখানে কিছু দোকান খোলা পাওয়া গেল। হালকা নাস্তা করার সুযোগ মিললো। বাস থেকে নামতেই যেন শরীরে ঠান্ডার প্রকোপ আঘাত হানলো। তবে তখনও সেটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। চা, পাকোড়া জাতীয় কিছু খেয়ে বাসে উঠলাম আমরা।
আমাদের বাসটা ঠিক ধর্মশালা শহর পর্যন্ত যায়নি। তার আগে কাংগ্রা নামক একটা জায়গায় থেমে যায়। এই পর্যন্তই বাসের গন্তব্য ছিল। বাস থেকে নেমে আমরা আবারও দর কষাকষি শেষে একটা ট্যুরিস্ট বাস ঠিক করলাম। আধ ঘণ্টার মতো রাস্তা পাড়ি দিয়ে যেতে হবে ধর্মশালা। সবাই যার যার মতো উঠলাম। ছোট্ট বাসও ছেড়ে দিল।
কিন্তু কিছু দূর যেতেই সবাই আবিষ্কার করলাম, আমাদের এক সহযাত্রী বাসে নেই। তিনি, বাসসের আসিফ মাহমুদ তপু। সবাই পরস্পর বিস্ময়চোখে বলছিল, তপু কই-তপু কই?
পরে মোবাইলে যোগাযোগ করে জানা গেল, সে ওই বাস স্ট্যান্ডেই রয়ে গেছে। পরে গাড়ি ঘুরিয়ে গিয়ে তাকে নিয়ে আসা হলো।
এরপর মিনিট পনের যেতেই পুলিশের চেকপোস্ট। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে তখন ধর্মশালায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি (যদিও ম্যাচটা পরে কলকাতার ইডেনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল)। তাই বাড়তি সতর্কতা পুলিশের। পাসপোর্টসহ, গমন হেতু জানানোর পর পুলিশ কর্মকর্তা ছেড়ে দিলেন আমাদের ট্যুরিস্ট বাস।
সকাল ১০টা বেজে গেছে। সেই আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে ধীরে ধীরে বাসটা প্রবেশ করলো একটা শহরে। রাস্তায় ‘এইচপিসিএ স্টেডিয়াম দিস ওয়ে’ লেখা সাইনবোর্ড দেখেই বুঝলাম ধর্মশালা শহরে চলে এসেছি। শহুরে পরিবেশ আছে তবে সেটা খুব শান্ত, কোলাহল মুখর নয়।
আগেই ধর্মশালায় পৌঁছে যাওয়া বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘুরে ঘুরে আমরা খুঁজে বের করলাম ‘কুনাল’ হোটেল। সেখানে নেমে হিমাচল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তার সাহায্যে মিললো হোটেল রুম। ভাড়া মিটিয়ে ছেড়ে দিলাম ট্যুরিস্ট বাস।
দু-একজন ছাড়া বিশ্বকাপ কভার করতে যাওয়া সব বাংলাদেশি সাংবাদিকই এ হোটেলে উঠেছেন। কুনাল হোটেল হিমাচল প্রদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। চার তলা বিল্ডিং। লাগোয়া রেস্টুরেন্ট। রুমগুলো বেশ বড়। ৩০৪ নম্বর রুমে আমার রুমমেট বাসসের আসিফ মাহমুদ তপু। দরজা খুলে বেলকনিতে পা দিতেই প্রশান্তিতে ভরে উঠলো মন। ৭ মার্চ থেকে করা প্রায় ৪০ ঘণ্টার ভ্রমণ ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই উধাও।
আহা, প্রকৃতি কত অপরূপ! ওই তো দূরে পাহাড়। তার চূড়ায় বরফরাজি, মেঘের উড়াউড়ি। যার মায়া ত্যাগ করে বেলকনি থেকে রুমে ফেরা কঠিন। কিন্তু রুমে পানির স্পর্শ নিতে গিয়েই শরীর শিরশির করে উঠলো। ওরে, ঠান্ডা। যেন বরফ মেশানো পানি!
তারপরই পানি গরম করার মেশিনের সুইচ চাপতে হলো। আবশ্যক কিছু কর্ম সেরেই নাস্তা করতে গেলাম হোটেলের অভ্যন্তরে থাকা রেস্টুরেন্টে। পেট শান্তির পর বিশ্রামই হয়ে উঠে মুখ্য। দু-এক ঘণ্টার বেশি বিশ্রামের ফুরসত মিলবে না। কারণ সাড়ে ৩টায় যে আবার বাংলাদেশের ম্যাচ। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মাঠে নামবে টাইগাররা।
ধর্মশালা নেমেই তাই বিশ্বকাপের হাওয়ায় মিশে যেতে হলো। অত লম্বা সময় ভ্রমণের ঝক্কি, ক্লান্তি, শরীরে বিশ্রামের টান সবই উবে গিয়েছে। পথ পাড়ি দেওয়ার কাজ শেষ, ক্লান্তি-কষ্টকে নির্বাসনে পাঠাতেই হচ্ছে পেশাগত দায়িত্বের জন্য।
হ্যাঁ, সবার ভাবনায় এখন শুধুই ক্রিকেট।
চলবে...