বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

জান-ই-আলম জান-ই-আলম প্রকাশিত: ১১:৫১ এএম, ০৮ এপ্রিল ২০২০
বন্ধন এমন বিশ্বাস যেমন

বেনাপোল থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় বাস ভ্রমণ, ছবি : আসিফ তপু

পেট্রাপোল থেকে গ্রীন লাইনের বাস যখন কলকাতা রওনা হয় ততক্ষণে ওই এলাকা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ রাস্তায় প্রীত হওয়ার বিষয় এটাই যে, এখানে প্রকৃতি তার আপন আলোয় অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ। বিশাল গাছগুলো বর্ষীয়ান। পেট্রাপোল, বনগাঁ, হাবড়া, বারাসাত হয়ে রাস্তাটা কলকাতা শহরে পৌঁছেছে।

এ রাস্তায় তিক্তকর বিষয় হলো- রাস্তাটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রশস্ত। সরু একটা রাস্তা। দুটি বাস পরস্পর অতিক্রম করতে গেলে, দুটিকেই রাস্তা ছেড়ে বাইরে হেলে পড়তে হয়। তাই বাসগুলোও দ্রুত চলতে পারে না। ট্রাক, ভ্যান, অটো, রিকশার পেছনে আস্তে আস্তে চলতে হয় বাসকে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে এ রাস্তা পাড়ি দিতে।

বলার মতো আরেকটা বিষয় চোখে পড়েছে, তা হলো- হাবড়া বাজার। এ বাজারটা বেশ লম্বা। সেখানে সারি সারি অটো দাঁড়ানো। যেমনটা আমাদের ঢাকায়ও আছে। তবে এখানে সবকিছুই উল্লেখ করা আছে। যেমন সবুজ সাইনবোর্ডে লেখা আছে কোন অটোগুলো কোন দিকে যাবে। গন্তব্যে যেতে হলে যাত্রীকে কোন অটোগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। মানে সবার এক জায়গায় ভীড় করার দরকার নেই। যার যার প্রয়োজনের স্থানেই সবাই বিন্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন বাস, অটোর জন্য।

যেটা ঢাকা শহরে কম। আমাদের এখানে বাস স্টপেজ অনেক। কিন্তু সবগুলো এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যাত্রী উঠা-নামা করে। হাবড়ার মতো নাম উল্লেখ করা স্ট্যান্ড নেই। যেমন মতিঝিলে কোনো সাইনবোর্ড নেই যে, মিরপুরগামী বাসে উঠতে হবে কোন নির্দিষ্ট জায়গা থেকে। শাপলা চত্বরের একই জায়গা থেকে মিরপুর, ধানমন্ডিগামী বাসের জন্য আমরা দাঁড়িয়ে থাকি।

হাবড়ার এই সাইনবোর্ডের আরেকটা সুবিধা আছে। যেমন নতুন কোনো যাত্রী, পর্যটকও এখানে সমস্যায় পড়বেন না। ওই সাইনবোর্ড দেখেই নিজের কাঙিক্ষত স্থানে দাঁড়িয়ে পাবেন যানবাহন এবং পরে গন্তব্যে চলে যেতে পারবেন প্রয়োজনীয় বাহনে চেপে। আর ঠিক এসব সাধারণ তথ্যের অভাবেই গণপরিবহনে হরহামেশা ঝামেলায় পড়তে দেখা যায় ঢাকা শহরের আগুন্তকদের।

আমাদেরকে বহন করা ধীরলয়ে চলা বাসটি ওই রাস্তা ধরেই এগুচ্ছিল। হাবড়া বাজারে একটা বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ডে আমার চোখ আটকে গেল। পরে যেতে যেতে আরও কয়েকবার ওইটা দেখেছি। জুয়েলারি বা বড় কোনো কোম্পানির সাইনবোর্ড হবে। যেখানে বিজ্ঞাপনের নিচে লেখা, ‘বন্ধন এমন, বিশ্বাস যেমন’।

লাইনটার অর্থ বুঝতে পারঙ্গম যে কেউ। তারপরও কেমন যেন নিগুঢ়, বাস্তব, চিরন্তন সত্য এখানে নিহিত। লাইনটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই যাত্রা বিরতির জায়গা চলে আসে। মিনিট বিশেকের বিরতি। দুপুর হয়ে গেছে। পেট সেভাবে বিদ্রোহ শুরু করেনি, ঘণ্টা দেড়েক আগেই তো খেয়েছিলাম। আমরা সবাই চা খেয়েই বিরতির সময় কাটালাম।

এর মাঝে বাসে বসে নানা আলোচনায় মত্ত ছিলাম সবাই। ভারতীয় নতুন মোবাইল নম্বর দিয়ে ঢাকায়, যার যার বাড়িতে ফোন করা। ওই সময় ভারতে অবস্থান করা আমাদের অন্য সহকর্মীদের ফোন করা, আনন্দচিত্তে নিজেদের নম্বর পরস্পর আদান-প্রদান আর আধোঘুমো চোখ নিয়েই যাত্রার শেষান্তে চলে আসি।

সূর্য তখন মধ্যগগনে। আমরা পৌঁছে গেলাম ‘সিটি অব জয়’ কলকাতায়। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস বিমানবন্দরের ডমিস্টিক গেইটে আমরা নেমে পড়লাম। বাস থেকে নেমেই রাজ্যের চিন্তার ভিড় মস্তিষ্কে। তার মধ্যে প্রধান ও প্রথম হলো কত দ্রুত ভারতের রাজধানী দিল্লির ফ্লাইট ধরা যায়। কারণ দিল্লি থেকে আমাদের আবার ধরতে হবে ধর্মশালার বাস। সেটা রাত ১০টার আগেই ধরতে হবে।

এর মাঝে সার্বিকভাবে ফোনে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছিলেন আইবিএন-সিএনএন’এ কর্মরত (এখন ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপে) আমার ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু শুভাশীষ দত্ত। দিল্লিতে কাজ করলেও সে আপাদমস্তক বাঙালি। তার সাথে পরিচয় হয়েছিল ঢাকায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজে।

স্পাইজ জেট এয়ারওয়েজের এক কর্মী দেখিয়ে নিয়ে গেলেন বিমানবন্দর অব্দি। দুপুর ২টার পার হয়ে গেছে স্থানীয় সময়। বিভিন্ন এয়ারওয়েজে খোঁজাখুঁজি শেষে সবাই মিলে ঠিক করলাম, এয়ার ইন্ডিয়ার সাড়ে ৫টার ফ্লাইটই ধরবো। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে টিকিট কাটা শুরু। ঘড়ির কাটা তখন তিনটা পেরিয়েছে। মিনিট পনের সেখানে ব্যয় করতেই কাউন্টারে থাকা কর্মী বললেন, আপনারা দ্রুত চেকিং শেষে বোর্ডিংয়ে চলে যান।

সিকিউরিটি চেক, লাগেজ চেক হলো। সব শেষে লাগেজ বোর্ডিংয়ে দেওয়া হলো। এরপর ফ্লাইটের অপেক্ষা। এর মাঝে পাকস্থলীতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে ব্যাপকভাবে। চিকেন মমো বার্গার অর্ডার দিলাম, আমরা বেশিরভাগই। গরম গরম ওই বার্গার খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ নয় বরং আটকে রাখার কাজটাই হয়েছে বলতে হবে। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, এরা অর্ডারের পর খাবার বানিয়ে দেয়, আগেই কোনো কিছু বানানো থাকে না। যেটা এখন ঢাকার ফাস্ট-ফুড দোকানগুলোতেও চালু হয়েছে।

খানা-পিনার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক এসেছে বিমানে চড়ার। ২ ঘণ্টা ৫ মিনিটের ফ্লাইট, কলকাতা থেকে দিল্লি। আকাশ যানে প্রবেশের মুখে দেখা মিললো সুদর্শনা বিমানবালাদের। যারা ‘গুড ইভেনিং’ স্যার বলে স্বাগত জানায় আমাদের।

আহা, প্রথমবার প্লেনে প্রবেশ! শিহরণ চেপে বসার আগে খুঁজতে হলো সিট। কারণ আমাদের সিটগুলো আলাদা-আলাদা হয়েছিল। দু-একজন একসাথে বসেছিলেন। তবে আমি একা পড়ে গিয়েছিলাম।

পাশাপাশি তিনটে সিট। নম্বর দেখতে দেখতে আমার সিট খুঁজে পেলাম। কিন্তু দেখলাম একজন আমার সিটেই বসে আছেন। কোরিয়ান, জাপানি, চীনা আকৃতি চেহারার এক অষ্টাদশী। আবার ভারতীয় উপজাতিও হতে পারে। আমি উপস্থিত হতেই সে ইঙ্গিত করছিল অপর পাশে গিয়ে তার সিটে বসতে। আমি সেখানে কর্নপাত না করে বুঝালাম, দিস ইজ মাই সিট। আধুনিকা মেয়েটি ওঠে গিয়ে নিজের সিটে বসলো। আমাদের দু’জনের বিভাজক একজন পুরুষ। হয়তো ওই মেয়ের ভাই বা বাবা হবেন।

ব্যাগ রেখে বসে পড়লাম। আশ-পাশে তাকিয়ে বাংলাদেশি অন্য সাংবাদিক ভাইদের দেখতে পেলাম না। দূরে, দূরে বসেছেন। তবে একটু দাঁড়াতেই দুই সিট পর আবিষ্কার করলাম, বাংলাদেশের দুই টিভি চ্যানেলের তিন সাংবাদিককে। এসএ টিভির শিপুল ভাই, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির সাইফুল মজুমদার ও রুবাইয়াত। হাই-হ্যালো হয়ে বসে পড়লাম আবার।

প্রথমবার বিমানে, আমার মনে পড়ে গেল। কিন্তু অনুভূতিটা বুঝতে পারছিলাম না। লাউড স্পিকারে অনেক ঘোষণা আসছে। সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছি। আমি কি শিহরিত, আমি কি ভীত, বুঝতে পারছিলাম না সত্যিই। সিট বেল্ট বাঁধার চেষ্টায় পুরোপুরি সফল হইনি। বেশি টাইট হয়ে গিয়েছিল। পাশের ভদ্রলোক সাহায্য করলেন। বিমানে আমার প্রথম ভ্রমণের সহযাত্রী তিনি।

চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেখেছেন। সিটের সামনে থাকা এলইডিতে কেউ ছবি দেখছেন, কেউ গান। তাদের অনুকরণে সামনে থেকে হেডফোন নিলাম। কানে লাগালাম। কিন্তু শব্দ আসছিল না।

নানা চেষ্টায় কয়েক মিনিট কেটে গেল। খুব গভীরভাবে পাশের জনকে খেয়াল করে বুঝলাম, আসলে আমি হেড ফোনের জ্যাক পিনটাও ভুল জায়গায় লাগিয়েছিলাম। পরে ঠিক জায়গায় লাগাতেই শব্দ পেলাম। টাচ স্ক্রিনে চেপে বলিউড, ইংলিশ ছবির চার্ট দেখলাম। কিছুক্ষণ গান শুনলাম।

গান শোনা বার বার বিঘ্ন হচ্ছিল বিমানের নানা ঘোষণার কারণে। যাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বললেন, পাইলটও। উড্ডয়নরত অবস্থায় এই করা যাবে, এই করা যাবে না -এসব ঘোষণাও দেওয়া হলো যাত্রীদের উদ্দেশ্যে।

হ্যাঁ, ধীরে ধীরে বিমান চলতে শুরু করেছে। স্পষ্ট অনুভব করতে পারলাম, বুঝতে পারলাম। গতি বাড়ছে। তীব্র শব্দ হচ্ছে। এবার আর চাকা চলছে না। তার মানে আমি শূন্যে চড়েছি এখন! বাইরে তাকানোর সুযোগ নেই, কারণ আমি উইন্ডো সিটে নই। ইকোনমি ক্লাসে মাঝের সারিতে সিট।

বিমান উপরে উঠছে। পরিষ্কার অনুভব করলাম, একটু উঠছে, আবার যেন একটু নিচে নামছে। আবার নিচু হতে হতে থামলো। আবার উঠছে, উঠছে। একটা সময় থিতু হলো। এবার ছুঁটছে আপন গতিতে। আমি ভাবলাম, আর বিমান চলা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এখন ছবি দেখাতে মনোযোগী হওয়া যাক। কারণ বিমান উড্ডয়নের সেই অনুভূতি মস্তিষ্কে গেঁথে গেলে খারাপ বৈ ভালো কিছু হবে না।

আমার একটু উচ্চতা ভীতি আছে। এটা নিয়ে অনেকবার দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের (দেবু দা) সঙ্গে আলোচনা করেছি। বিমানে চড়ার আগে অলক্ষ্যে সেই ভাবনাও মনে এসেছিল। আল্লাহর অশেষ কৃপা যে, আমি সফলভাবেই সেই ভীতি কাটাতে পেরেছি।

এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট বেশ ভালোই লেগেছে। শেষ পর্যন্ত ইংলিশ ছবি দেখলাম একটা, ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া। নাম ‘এন এ্যাফেয়ার টু রিমেমবার’। ঘণ্টা দেড়েকের ছবি দেখায় একবার বিরতি আনতে হয়েছিল। বিমানবালা’রা ফ্লাইটের ‘সৌজন্য’ খাবার নিয়ে হাজির হওয়ায়। যৎসামান্য, বেছে বেছে যা কিছু সম্ভব হয়েছে তা পেটে পুরেছিলাম। মিনি পানির বোতলটা শেষ করেছিলাম, সঙ্গে হালকা গরম চা। বাকি খাদ্য দ্রব্যের বেশিরভাগই ফেরত গিয়েছিল।

ছবি শেষ হওয়ার কাছাকাছি আসতেই আবার বিমান বালার ঘোষণা, ‘আমরা দিল্লির কাছাকাছি চলে এসেছি।’ সঙ্গে সিট বেল্ট বাঁধা, মোবাইল সুইচ অফ রাখাসহ যাবতীয় ঘোষণা দিলেন। পাইলট সাহেব আরেকবার কথা বললেন। সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট পছন্দ করার জন্য।

কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে উইন্ডো দিয়ে একটু বাইরে তাকালাম, সন্ধ্যার অন্ধকারে এত উপর থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিকে যেন ‘জলন্ত পিন্ড’ মনে হচ্ছিল। এক অদ্ভূত সৌন্দর্য! আসলে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানিতেই এমন পরিবেশের অবতারণা হয়েছিল।

বিমান অবতরণের শব্দটা এতদিন ছবি, আরও কত জায়গায় শুনে এসেছি। এবার বাস্তবে শুনতে হেডফোন খুলে ফেললাম। বিমানটা ক্রমেই ক্রমেই নেমে আসছে। সেই নিম্নগামীতা স্পষ্ট বুঝেছি। মনে হয় যেন, কেউ আমাকে শূন্য থেকে ধরে নামাচ্ছে। এমন করে কাটছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎই একটা আওয়াজ হলো।

হ্যাঁ, এটা বিমানের চাকা ভূমিতে স্পর্শ করার শব্দ। আহ, কেমন নির্ভেজাল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলো আমাদের বহনকারী বিমান।

আর বলে রাখছি, পুরো ভ্রমণে চোখাচোখি হলেও একটি কথাও হয়নি পাশের সহযাত্রীদের সঙ্গে। তবে মাঝপথে তাদের চীনা ছবি দেখা, এলইডি স্ক্রিনে ছবি খুঁজে বের করা দেখে মনে হলো, এরাও হয়তো আমার মতো ভারতীয় নয়।

চলবে...



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

অপ্রতুল প্রস্তুতি, বড় অভিযাত্রা

আয়ে ভাটা, পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বিসিবি

আয়ে ভাটা, পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বিসিবি

স্থবির ক্রীড়াঙ্গন, সাংবাদিকদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ

স্থবির ক্রীড়াঙ্গন, সাংবাদিকদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ

দেশে সবধরনের ক্রিকেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

দেশে সবধরনের ক্রিকেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ