ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কিংবদন্তি ক্রিকেটার গ্যারি সোবার্স ও রোহান কানহাই। ১৯৭৮ সালের ৫ এপ্রিল টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজেরিএই দুই কিংবদন্তি। শুধু গ্যারি সোবার্স ও রোহান কানহাই’ই নয়, একই দলের দু’জন বা ততোধিক বড় মাপের ক্রিকেটার আছেন যারা একই দিনে একই ম্যাচ থেকে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। এমন কয়েকজন ক্রিকেটারের গল্প তুলে ধরা হলো।
গ্যারি সোবার্স এবং রোহান কানহাই - বনাম ইংল্যান্ড, পোর্ট অব স্পেন, ১৯৭৪
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কিংবদন্তি ক্রিকেটার মানা হয় গ্যারি সোবার্স ও রোহান কানহাইকে। যারা কি না ভিন্ন সময়ে ক্রিকেট শুরু করলেও শেষ করেছেন একই দিনে ও একই ম্যাচে। ১৯৭৮ সালের ৫ এপ্রিল টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার গ্যারি সোবার্স ও রোহান কানহাই। যে ম্যাচে তারা অবসর নেন সেই ম্যাচ খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে বেশ কয়েকটি রেকর্ড করেছিলেন গ্যারি সোবার্স ও রোহান কানহাই। তারা তখনকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ছিলেন যেখানে গ্যারি সোবার্স ৯৩টি ও রোহান কানহাই ৭৯টি ম্যাচ খেলেন।
তারা দুজন ছিলেন তখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের শীর্ষস্থানীয় দুই রান সংগ্রহকারী। ৯৩ ম্যাচ খেলে গ্যারি সোবার্স করেছিলেন ৮০২২ রান আর ৭৯ ম্যাচ খেলে রোহান কানহাই করেছিলেন ৬২২৭ রান । তারা দুজন সবচেয়ে বেশি ৬টি শতরানের জুটি গড়েন। ল্যান্স গিবসের পর গ্যারি সোবার্স ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর মালিক এবং সেরা অলরাউন্ডার।
যদিও শেষ টেস্টটি তাদের জন্য স্মরণীয় ছিল না। টোনি গ্রেগের ১৩ উইকেট শিকারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৬ রানে ম্যাচটি হেরে যায় এবং পাঁচ ম্যাচের সিরিজটি ১-১ ব্যবধানে ড্র হয়েছিল। যেখানে গ্যারি সোবার্স করেছিলেন ০ ও ২০ রান আর রোহান কানহাই করেছিলেন ২ ও ৭ রান। ভারতের বিপক্ষে পরের সিরিজে ।ভিষেক হয় ভিভ রিচার্ডস এবং গর্ডন গ্রিনিজের যারা কি না পরবর্তীতে নিজেদের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে জায়গা তৈরী করেছিলেন।
গ্রেগ চ্যাপেল, ডেনিস লিলি এবং রড মার্শ - বনাম পাকিস্তান, সিডনি, ১৯৮৪
পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে খেলে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলেন ১৯৭০ দশকের অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ত্রয়ো গ্রেগ চ্যাপেল, ডেনিস লিলি এবং রড মার্শ। যারা কি না ৮০ এর দশকের টেস্ট ক্রিকেটে অ্যাডিয়েউকে বিড করেছিলেন। তিনজনের অবসরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে একপ্রকার ধস নামার মতো অবস্থায় পড়ে।
গ্রেগ চ্যাপেল ৮৭টি টেস্ট খেলে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ৭১১০ রান করেছিলেন। অজিদের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫৫ উইকেট ছিল ডেনিস লিলিরি আর ৩৫৫টি ডিসমিসাল ছিল রড মার্শের দখলে যা কি না সেই সময়ে সর্বাধিক। চ্যাপেল অস্ট্রেলিয়ার সর্বাধিক সফল অধিনায়ক এবং সেই সময় ক্লাইভ লয়েডের পরে দ্বিতীয় ছিলেন।
গ্যারি সোবার্স ও রোহান কানহাই তাদের শেষ ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকলেও তিন অস্ট্রেলিয়ানের জন্য একটি স্মরণীয় টেস্ট ছিল। যেখানে তারা বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করেছিল। চ্যাপেল তার শেষ টেস্ট ইনিংসে ১৮২ রান করে ডন ব্র্যাডম্যানের সমান ৬৯৯৬ রান সংগ্রহ করেছিলেন। লিলি প্রথম ইনিংসে চারটি উইকেট নিয়ে ৩৫০ টেস্ট উইকেট শিকারী বোলার বনে যান এবং রড মার্শ উইকেটকিপার হিসাবে তার ৯৯তম টেস্ট খেলেছিলেন এবং অ্যালান নটের রেকর্ডটি পিছনে ফেলেন।
একজন নির্দিষ্ট বোলারের বলে অর্থাৎ ডেনিস লিলির বলে টেস্টে ৯৫ টি ডিসমিসালকরেছিল রড মার্শ ,যা এখনও বোলার-উইকেটরক্ষকের যৌথভাবে রেকর্ড। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি ১০ উইকেটে জয় লাভ করে আর চ্যাপেল ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। এছাড়া চ্যাপেল তার প্রথম এবং শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করার বিরল গৌরব অর্জন করেছিলেন।
তাদের বিদায়ে স্পষ্টতই অস্ট্রেলিয়াকে শক্তভাবে আঘাত করেছে। ত্রয়ীর বিদায়ের পরে তারা পর পর চারটি টেস্ট সিরিজ হারে এবং তাদের পরবর্তী আটটি সিরিজেও কোনও জিতেনি, যার মধ্যে দুটি অ্যাশেজ সিরিজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের বিদায়ের আগে অস্ট্রেলিয়া আগের মৌসুমে সবেমাত্র অ্যাশেজ ফিরে পেয়েছিল এবং তাদের শেষ ১০ সিরিজের মাত্র দুটিতে হেরেছিল।
ভিভ রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল এবং জেফ ডুসেন - বনাম ইংল্যান্ড, ওভাল, ১৯৯১
১৯৮০ এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে শক্তিশালী ত্রয়ী ছিলেন ভিভ রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল এবং জেফ ডুসেন। যারা কি না অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ত্রয়ী গ্রেগ চ্যাপেল, ডেনিস লিলি ও রড মার্শের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক ও সর্বোচ্চ ডিসমিসালের মালিক। ৮৫৪০ রান নিয়ে ভিভ রিচার্ডস, ৩৭৬ উইকেট নিয়ে ম্যালকম মার্শাল ও ২৭২ ডিসমিসাল নিয়ে অবসর নেন জেফ ডুসেন।
ভিভ রিচার্ডস অবসর নেওয়ার সময় রান সংগ্রাহকে তার উপরে ছিলেন কেবল সুনীল গাভাস্কার ও অ্যালান বোর্ডার। কেবল মাত্র রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান বোথাম মার্শালের চেয়ে বেশি উইকেট শিকারী ছিল আর রড মার্শই কেবল ডুসনের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ক্যারিবিয়ানদের এই ত্রয়ী যদিও তাদের শেষ টেস্টটা অজিদের বিখ্যাত ত্রয়ীর মতো করে শেষ করতে পারেননি। নিজেদের শেষ টেস্টে ভিভ রিচার্ডস করেন ২ ও ৬০ রান, ডুসেন ০ পও ৫ রান আর মার্শাল নেন ২ উইকেট।
শেষ টেস্টে ইংল্যান্ডের কাছে ৫ উইকেটে হেরে ২-২ ব্যবধানে সিরিজ ড্র করে। সাত বছরে প্রথমবারের মত ফলো-অনে পরে টেস্ট হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ২২ বছর পর ফলো-অনে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্ট হারায় ইংলিশরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই সময় বেশ শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল সবার জন্য। যারা কি না ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কোন টেস্ট সিরিজ হারেনি।
শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং জাস্টিন ল্যাঙ্গার - বনাম ইংল্যান্ড, সিডনি, ২০০৭
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সফল লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন, সবচেয়ে সফল পেস বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রা একই সাথে অজিদের অন্যতম সেরা ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গারের সাথে অবসর নিয়েছিলেন। ১০০ এর অধিক টেস্ট খেলে এক সাথে কোন ত্রয়ীর অবসর ছিল এই প্রথম। এই তিন ত্রয়াী বিদায়টা ছিল রঙিন। যারা কি না পঞ্চম ও শেষ টেস্টে ইংল্যান্ডকে ১০ উইকেটেহারিয়ে ৫-০ ব্যবধানে অ্যাশেজ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
নিজেদের শেষ টেস্টে ম্যাকগ্রা দুই ইনিংসে ৬ উইকেট নেন, ওয়ার্ন মাত্র ২ টি উইকেট সংগ্রহ করেছিল তবে প্রৎম ইনিংসে গুরুত্বপূর্ণ ৭১ রান করেছিলেন। জাস্টিন প্রথম ইনিংসে ২৬ রান করেন আর দ্বিতীয় ইনিংসে ননস্ট্রাইকে থাকতেই হিট আউট হন। ওয়ার্ন, ম্যাকগ্রা আর ল্যাঙ্গারের ত্রয়ীর বিদায়ের পর অস্ট্রেলিয়া তাদের পরবর্তী ৮ সিরিজের তিনিটিতে হারে। একটি করে টেস্ট সিরিজ হারে দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও অ্যাশেজ সিরিজ।
ইউনিস খান এবং মিসবাহ-উল-হক - বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, রোজাউ, ২০১৭
পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান ইউনিস খান ও সফল অধিনায়ক মিজবাহ -উল -হক একই সাথে অবসর নিয়েছেন। পাকিস্তানের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন ইউনিস খান।তিনি যখন তার ক্যারিয়ার শেষ করেন তখন তার ঝুলিতে ছিল ১০০৯৯ রান।
অধিনায়ক হিসেবে মিজবাহ ছিলেন অন্যান্য অধিনায়কের থেকে বেশ এগিয়ে বলতে গেলে জয়ের দিক থেকে তাদের দ্বিগুন। অধিনায়ক হিসেবে ৫৬ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেন মিজবাহ। মিজবাহর অধিনায়কত্বে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কেবল একটি সিরিজ হেরেছে পাকিস্তান। ৪২ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন মিজবাহ-উল-হক। অধিনায়ক হিসেবে ইউনিস খানও ৫৩টি ম্যাচ খেলেন তবে মিজবাহর মত তিনি এতটা সফল ছিলেন না।
তাদের দুজনের বিদায়ের পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান তাদের সাত টেস্ট সিরিজের মাত্র দুইটিতে জয় পায়। আর ১৬ ম্যাচ খেলে জয় পায় কেবল মাত্র ৪টি ম্যাচে পাশপাশি হারে ১০টি ম্যাচে।
রাহুল দ্রাবিড় এবং ভিভিএস লক্ষ্মণ - বনাম অস্ট্রেলিয়া, অ্যাডিলেড, ২০১২
ভারতের তিনজন অভিজ্ঞতম টেস্ট খেলোয়াড়ের মধ্যে দু'জন এবং শীর্ষস্থানীয় চার রান সংগ্রহকারীদের মধ্যে দু'জনই ২০১২ সালে অ্যাডিলেডে শেষ টেস্ট খেলেছিলেন। যারা হলেন রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণ।
ভারতের হয়ে সবচেয়ে বড় টেস্ট জুটি (৩৭৬ রান) গড়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণ। শুধু তাই নয় ভারতের একমাত্র জুটি হিসেবে টেস্টে দুইটি ত্রিপুল সেঞ্চুরির জুটি গড়েছন তারা। ১৬৪ ম্যাচ খেলে ১৩২৮৮ রানে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন রাহুল আর ১৩৪ টেস্ট খেলে ৮৭৮১ রানে অবসর নেন লক্ষ্মণ। তবে তাদের শেষ সিরিজটি মোটেও সুখকর ছিল না। শেষ চার টেস্টে আট ইনিংসে রাহুল করেছিলেন ১৯৯ রান ও লক্ষ্মণ করেছিলেন ১৫৫ রান।
৭৫ বা ততোধিক ম্যাচ খেলে এক সাথে শেষ টেস্ট খেলেছেন এমন খেলোয়াড় জুটি
ইয়ান বোথাম এবং অ্যালান ল্যাম্ব, বনাম পাকিস্তান, লর্ডস ১৯৯২
গ্রাহাম গুচ এবং মাইক গ্যাটিং, বনাম অস্ট্রেলিয়া, পার্থ, ১৯৯৫
শন পোলক এবং হার্শেল গিবস, বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ডারবান, ২০০৮
এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং মরনে মরকেল, বনাম অস্ট্রেলিয়া, জোহানেসবার্গ, ২০১৮
হাশিম আমলা ও ডেল স্টেইন, বনাম শ্রীলঙ্কা, পোর্ট এলিজাবেথ, ২০১৯।