বিশ্বকাপ আসলেই ক্রীড়াপ্রেমীদের মাঝে উত্তেজনা বেড়ে যায়। স্বপ্নের সোনালি ট্রফি ছুঁতে আশায় বুকে বেঁধে থাকে দল ও তার দেশের মানুষ গুলো। দীর্ঘ চার বছর স্বপ্ন সাধনা দিয়ে লড়াইটা শুধু ঐ সোনালি ট্রফির জন্যই। কিন্তু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হলে তো পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ, জিততে হয় অনেকগুলা ম্যাচ আর খেলতে হয় ৮/১০ কিংবা তার অধিক ম্যাচ।
২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার তকমা জুটে নেয় ইংল্যান্ড। আর তাদের এই চ্যাম্পিয়ন হতে খেলতে হয়েছে ১১টি ম্যাচ যেখানে গ্রুপ পর্বে ৯টি, সেমিফাইনালে ১টি আর ফাইনাল। এখন বলতে পারেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হলে তো এটুকু কষ্ট করতেই হবে৷ কিন্তু জেনে অবাক হবেন যে মাত্র চার ম্যাচ খেলেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে এমন ঘটনাও আছে। আর সেই দলটি হলো ক্লাইভ লয়েড-গর্ডন গ্রিনিজদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপে মাত্র চার ম্যাচ খেলেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৭৫ সালের ন্যায় ১৯৭৯ সালেও ইংল্যান্ডে বসে বিশ্বকাপ আসর। সেই বিশ্বকাপে এ ও বি দুইটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করে আটটি দল। গ্রুপ বি তে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ড। আর গ্রুপ এ তে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও কানাডা।
৯ জুন বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে বার্মিংহামে ভারতের মুখোমুখি হয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুরুতেই টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন ক্লাইভ লয়েড। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ক্যারিবিয়ান বোলারদের বোলিং তোপে ৫৩.১ ওভারে মাতড় ১৯০ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৫ রান করেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৪ উইকেট নেন মাইকেল হোল্ডিং।
জয়ের জন্য ১৯১ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে গর্ডন গ্রিনিজের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে ৭ উইকেটের সহজ জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১০৬ রানে অপরাজিত ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ আর ৪৭ রান করেন ডেসমন্ড হাইনেস।
নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কিন্তু টানা তিনদিন বৃষ্টির কারণে একটি বলও মাঠে গড়ানো সম্ভব হয়নি আর যে কারণে ১ পয়েন্ট করে ভাগ করে দেয়া হয় দুই দলকে।
গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে ১৬ জুন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ক্লাইভ লয়েডের অপরাজিত ৭৩ ও গর্ডন গ্রিনিজের ৬৫ রানের সুবাদে নির্ধারওত ৬০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ২৪৪ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিউইদের হয়ে সর্বোচ্চ ২ উইকোট নেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি।
জয়ের জন্য ২৪৫ রানে লক্ষ্যে খেলতে নেমে সবাই ছোট ছোট করে অবদান রাখলেও তা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪২ রান আসে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ব্যাট থেকে। এছাড়া ৩৬ রান করেন কোনি ও ৩৫ রান করেন অধিনায়ক বুরগ্রেস। ক্যারিবিয়ানদের হয়ে ৩ উইকেট নেন অ্যান্ডি রবার্টস। ১০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকে সেমিফাইনালে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২০ জুন সেমিফাইনালে গ্রুপ এ এর দুইয়ে থাকা পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে গর্ডন গ্রিনিজের ৭৩, ডেসমন্ড হাইনেসের ৬৫ আর ভিভ রিচার্ডের ৪২ রানের কল্যাণে নির্ধারিত ৬০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ২৯৩ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাকিস্তানের হয়ে ৪ উইকেট নেন আসিফ ইকবাল।
২৯৪ রানের লক্ষে খেলতে নেমে মাজিদ খানের ৮১ আর জহির আব্বাসের ৯৩ রানের অনবদ্য ইনিংসের পরও হার দেখতে হয় পাকিস্তানকে। দুজনের ১৬৬ রানের জুটি ছাড়া দাঁড়াতে পারেনি আর কোন জুটি। ফলে ৩.৪ ওভার বাকি থাকতেই ২৫০ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। ৪৩ রানের জয় নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত ফাইনালে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২৩ জুন লর্ডসে ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে স্যার ভিভ রিচার্ডের অপরাজিত ১৩৮ ও কলিস কিংয়ের ৮৬ রানের কল্যাণে নির্ধারিত ৬০ ওভারে ২৮৬ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংল্যান্ডের হয়ে দুটি করে উইকেট নেন ইয়ান বোথাম, হেন্ড্রিক, ওল্ড ও এডমন্ডস।
জয়ের জন্য ২৮৭ রানের লক্ষে খেলতে নেমে দারুন শুরুর পরও হার দেখতে হয় ইংলিশদের। মাইক বেয়ারলি ও জিওফ বয়কটের অনবদ্য ১২৯ রানের জুটির পর আর কেউ দাঁড়াতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ৫১ ওভারে ১৯০ রানে অলআউট হয় ইংল্যান্ড। বেয়ারলি করেন ৬৪ আর জিওফ বয়কট করেন ৫৭ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৫ উইকেট নেন জোয়েল গার্নার।ইংল্যান্ডকে ৯২ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেটিও মাত্র চার ম্যাচে মাঠে নেমেই।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড হয়ে আছে এটি। তবে এই রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখা গেছে আরও তিনবার। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ৫ ম্যাচসহ মোট ৮ ম্যাচ জিতে প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেট বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলেছিল শ্রীলঙ্কা।
অপরাজিত থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার বাকি নজির দুটি অস্ট্রেলিয়ার। ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপে রিকি পন্টিংয়ের অধীনে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। ২০০৩ আসরে ১১ ম্যাচ, আর পরের আসরে ১২ ম্যাচ—মোট ২৩ ম্যাচের প্রতিটি জিতে টানা দুইবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য নজির স্থাপন করেছিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া।