করোনাভাইরাসের কারণে মহাকাশের রৌদ্রজ্জ্বল আকাশটাও আজ মেঘমালায় বিরাজমান। একটু একটু মেঘের কল্যাণে এ এক বিশাল মেঘের অবয়ব সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাণঘাতি করোনার প্রকোপে থেমে আছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন।
রাত ২টা অবদি জেগে যে মানুষটা লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইপিএল কিংবা সারাদিন ঘরে বসে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতো সেই মানুষটাও আজ স্থবির হয়ে আছে। বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব লিগ আর আসর। জানি না আবারও কবে ফিরবে আমার আপনার এই সোনালি শহর, রঙ্গিন পৃথিবী।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি থমকে গেছে ক্রীড়াজগতটা। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ক্যালেন্ডারে আবারও হয়তো খেলাধুলা ফিরবে। তবে আমাদের বেশ কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর অনুশীলন পরিত্যাগ করতে হবে। বিশেষ করে বলতে গেলে ক্রিকেটের কিছু অস্বাস্থ্যকর অনুশীলন বাদ দিতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রত্যেকটি ক্রিকেটিয় দেশে ওলট-পালট হয়ে গেছে ক্রিকেট ক্যালেন্ডার। তবে কেবল মাত্র করোনার প্রকোপটা কম এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে। তার কারণটা অবশ্য তারা সবার থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন।
করোনাভাইরাস বিশ্বে মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বেশ কিছু তথ্যের উৎপত্তি হয়েছে। কিছু তথ্যের সাথে ক্রিকেটের মিল রয়েছে। এখানে দুইটি দিক বলা যেতে পারে ১. ভাইরাসের আচরণ ২. হোস্টের আচরণ।
করোনাভাইরাসের আচরণ এখন পর্যন্ত সন্তোষজনকভাবে ধরা যায়নি তবে হোস্টোর আচরণ সম্পর্কে অবশ্যই কিছু করা যেতে পারে। বিশেষ করে ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে আরও বিশেষ করে বলতে গেলে ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে।
দীর্ঘকাল ধরে ক্রিকেটে বেশ কিছু অস্বাস্থ্যকর অনুশীলন চলে আসছে তার মাঝে বলে থুথু দেয়া অন্যতম একটি। এই অভ্যাসটা স্কুল ক্রিকেট, ক্লাব ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট অবদি পৌঁছে গেছে। খেলোয়াড়রা জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস আর রোগের সংক্রামণ সম্পর্কে অবহিত নয় বলেই হয়তো অভ্যাসটা চালিয়ে যাচ্ছে।
মোডাস অপারেন্ডিটি বলে একটা কথা আছে যার অর্থ হলো একদিকে শুকনো রাখতে হবে যাতে মনোযোগের পরিবর্তন ঘটে। আর এই কাজের জন্য সেদিকে সম্ভবত থুথু দেয়া হয়। আর এই কাজটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্লিপের ফিল্ডাররা করে থাকে। স্লিপের ফিল্ডারের হাতে বল এলে তাতে কিছুটা থুথু মিশিয়ে টাউজারের সাথে ঘষে তারপর সেটা গালির ফিল্ডারের হাতে দেয়। তারপর সে কভার, মিড-অফ ও অন্যান্য ক্রিকেটারের মাধ্যমে বোলারের কাছে বল পৌঁছায়। গালি, কভার, মিড-অফ ও অন্যান্য খেলোয়াড়রাও একই কার্যপদ্ধতি অবলম্বন করে। তারা এমনভাবে কাজটার পুনরাবৃত্তি করে যেন বলটা খাবার আচার। বলের চকচকে জায়গাটি আরও চকচকে রাখার জন্য মূলত তারা এই কাজটি করে থাকে।
ফিল্ডারদের পর বোলাররা আরও কিছু কাজ করেন। বিশেষ করে স্পিনাররা বলের উপর কাজটা বেশি করে। বলকে শুকনো রাখতে হাতের তালুতে ফুঁক দেয় তারপর বলটি ভালো হাতে রেখে আঙ্গুল চেটে চেটে বলে লালা লাগায়। আর তাতেও যদি যথেষ্ট মনে না হয় তাহলে আম্পায়ার দ্বারা পরীক্ষা করান। কিন্তু কথা হলো আম্পায়ার যে বলটি পরীক্ষা করছেন সেটা অন্যান্য ফিল্ডারদের হাত ঘুরে আসা বল। সেখান থেকে রোগজীবাণু ছড়াবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
ক্রিকেটের আইন ৪২.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বলটি ততক্ষন পোলিশ করা যাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত কৃত্রিম পদার্থ ব্যবহার করা হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় আপনি ইচ্ছা করলেই শরীরের যেকোন অংশ অর্থাৎ ঘাম, ব্রাউড, আন্ডারআর্ম পিট, ঘাড় বা লালা প্রয়োগ করা আইনগতভাবে বিধিসম্মত।
এত সব সুযোগ সুবিধা থাকার পরও ক্রিকেটারদের দেখা গেছে সীমালঙ্ঘন করতে। ইংল্যান্ডের সাবেক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মার্কাস ট্রেসকোথিক অবসর নেয়ার পর এ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। তিনি প্রকাশ করেছিলেন যে এই আইনকেও ক্রিকেটাররা কিভাবে অবজ্ঞা করতো। তিনি বলেছিলেন যে কিছুটা থুথু দিয়ে বল পরিষ্কার করাই তার কাজ ছিল। তিনি চেষ্টা করে সঠিক ধরণের থুথু চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন যা সবচেয়ে বেশি কাজে দিত।
কাউন্টি ক্রিকেটে এই ধারণা ছিল যে নির্দিষ্ট মিষ্টি লালা বলে ব্যবহার করলে সেটি বেশি চকচকে হয় আর বেশি সুইয়িং করে। ২০০৫ সালের অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ ব্যবধানে হারায় ইংল্যান্ড। তারপর তার আত্মজীবনীতে তিনি স্বীকার করেন যে ম্যারে মিন্টস দক্ষতার সাথে এই কাজ করার জন্য সর্বাধিক লালা তৈরী করেছেন।
শুধু মাত্র ইংলিশ খেলোয়াড়রাই এমন কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়াতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ম্যাচে বল উজ্জ্বল করার জন্য মুখ থেকে টানা লজেন্স বের তা বলে ব্যবহার করেন যার জন্য তাকে ম্যাচ ফির ৫০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়।
বল উজ্জ্বল করার জন্য অবশ্যই কোন পদার্থ ব্যবহার নিষিদ্ধ তবে এবার সময় এসেছে লালা ও ঘামের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার। যদিও থুতু আর ঘামের ব্যপারে খুব বেশি কিছু করা যায় না। যদিও এসবের মাধ্যমে বক্সিং ও রাগবি খেলায় বেশি ছড়ায়।
তবে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, ব্যাডমিন্টনের মত যোগাযোগহীন খেলাতেও এসবের মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে কিংবা জীবাণু ছড়াতে পারে। যেমন ধরুণ ঘামে ভেজা টি-শার্ট বিনিময়, ঘাযুক্ত হাত কাঁপানো, আলিঙ্গন করা, হাতে ফুকানো, হাত বা লালা ব্যবহার, একে অপরের উপর লাফানো, এক সাবানে সবাই গোসল করার মত কাজের মাধ্যমে।
আবারও মহাজগতের ক্রীড়াঙ্গন সচল হবে। তবে কিছু খেলা বিশেষ করে ক্রিকেটের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস গুলো তৃণমূল থেকে শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত নিষিদ্ধ করতে হবে। বিশ্বজুড়ে মহামারীর সময়ই প্রকৃত সময় এসব পরিত্যাগ করার। কর্তৃপক্ষ আদৌ কি জাগবে?