জীবনযুদ্ধে হার না মানা স্যাম ওয়ার্ডের গল্প

মমিনুল ইসলাম মমিনুল ইসলাম প্রকাশিত: ০৬:২৯ পিএম, ০৭ মার্চ ২০২০
জীবনযুদ্ধে হার না মানা স্যাম ওয়ার্ডের গল্প

মানুষের জীবন আর জীবনের গল্প গুলো একটু বেশিই অদ্ভুত। জীবনের কোন পথে গিয়ে জীবনের গল্পগুলো রঙ বদলাবে সেটা আপনি বুঝেই উঠতে পারবেন না। জীবনে খারাপ সময় আসবে তা শক্ত হাতে মোকাবেলা করাই জীবনের স্বার্থকতা। জীবন যুদ্ধে থামতে নেই, জীবনের পথে পিছুপা হটতে নেই। জীবনের যেকোন লগ্নে এসে আপনাকে হাঁটতে হবে, আপনাকে দৌঁড়াতে হবে।

ধরুণ খেলতে গিয়ে আপনার এক চোখ অন্ধ হয়ে গেল তখন কি কখনো আবারও খেলার জগতে ফিরে আসার কথা ভাববেন? আবারও কি মনে হবে দীপ্ত মনে দেশের তরে লড়ে উঠি। কিছু মানুষ হারার আগে কখনো হারে না তাদেরই মত একজন গ্রেট ব্রিটেনের হকি খেলোয়াড় স্যাম ওয়ার্ড। এক চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও স্বপ্ন দেখেন ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে দেশের জার্সিতে প্রতিনিধিত্ব করতে নামবেন। জীবনে কখনো যদি দমে যাওয়ার ভয় জাগে তাহলে স্যাম ওয়ার্ডের মত মানুষদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন।

সময়টা খুব বেশি আগের নয় ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর, মালেশিয়ার বিপক্ষে চলছিল গ্রেট ব্রিটেনের অলিম্পিকের বাছাইপর্বের ম্যাচ। সে ম্যাচে দুই গোল করে হ্যাটট্রিকের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন স্যাম। তবে হঠাৎই তার সে স্বপ্নে পানি ঢেলে দিল তার কপাল কিংবা সতীর্থ। তার এক সতীর্থ হঠাৎই একটি শট নিলে তা ৫০ কিলোমিটার গতিতে এসে তার বা চোখে লাগে। আর তাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন স্যাম ওয়ার্ড।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথে তাকে মাঠের বাহিরে নেয়া হয় আর তখনই ছিটকে যান ম্যাচ ও বাছাইপর্বের ম্যাচ গুলো থেকে। ৫০ কিলোমিটার গতির শটটি তার বা চোখে লাগলে পরক্ষণেই তার চোখের চিত্র পাল্টে যায়। শটটি চোখে লাগায় চোখে সাতটি ফ্রেকচার হয়েছিল আর অঝোরে রেটিনা থেকে পানি ঝড়ছিল। আর একটু পরেই চোখে অন্ধকার দেখতেছিলেন, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন।

sportsmail24

এমনটা হওয়ার পরও স্যামকে টোকিও অলিম্পিকে খেলার স্বপ্নটা তাড়া করছিল। রাতে যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারছিলেন না, ঘুমের মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠতেন তার চোখ আর মুখের ছবি কল্পনা করে। একা একা বসে কাঁদতেন আর ভাবতেন আমি কি আর হকি খেলতে পারবো না?

এগারো দিন পর স্যাম তার চোখের পরীক্ষার জন্য গিয়েছিলেন, সেখানে ডাক্তাররা খুব আশাবাদী ছিলেন তার সুস্থতা নিয়ে। তবে স্যাম ওয়ার্ড হতাশ হয়ে পড়েছিলেন কারণ সে বাম চোখে দেখতে পারেন না।

চিকিৎসার পর ডাক্তাররা জানায় আমরা ঠিকঠাক করতে পেরেছি এখন থেকে আপনি দেখতে পারবেন তবে বাস্তবতা ছিল একদমই ভিন্ন। স্যাম ডাক্তারদের বলেছিলেন তিনি চোখে কিছুই দেখতে পারছেন না। স্যামের এমন কথার পর লন্ডনের এক রেটিনা বিশেষজ্ঞ তার চিকিৎসার সকল তথ্য সংগ্রহ করেন আর চিকিংসা নিয়ে পরামর্শ দেন।

স্যাম বলেছিলেন, সেদিন আমি আমার বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলাম কিন্তু মাকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। আর হ্যাঁ হকিই আমার জীবনের সবকিছু ছিল কিন্তু তখন আমি আমার খেলোয়াড়ি জীবনের ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছিলাম না।

তিনি আরও বলেন, তখন আমি সবসময় ভয়ে ছিলাম আমার চোখ আর ক্যারিয়ার নিয়ে। হকির শব্দ আমাকে সবসময় পীড়া দিত। অনেক রাত ঘুমাতে পারিনি এই শব্দের পীড়ায়। এছাড়া আমি স্বপ্নে দেখতাম আমার ভালো চোখ নষ্ট করার জন্য লোকেরা গুলি করছে।

আমি আমার বা চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি এটা বুঝতে পারছিলাম যে আমার চোখের কারণে মুখের কাঠামোর বিকৃতি ঘটেছে। এসব আমাকে অনেক পীড়া দিত আর আমি তা অনুভব করতাম।

‘আমার মুখ ফুলে যাওয়ার কারণে আর চোখের সমস্যার কারণে ডাক্তারের কাছে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর তারা আমার মাথার উপরের অংশ থেকে কান পর্যন্ত কেটে ফেলেছিল। আমার মুখটি খুলে ৪টি প্লেট আর ৩১টি স্ক্রু বসিয়েছিল। ঐ মূহুর্তটা ভয়াবহ ছিল কিন্তু তারা সত্যিই অসাধারণ কাজ করেছে।’

এমন কিছুর পর দলের কর্মকর্তারা আলোচনা করছিলেন ওয়ার্ডের ক্যারিয়ার শেষ। তবে স্যাম তখনও বিশ্বাস রেখেছিলেন নিজের উপর যে তিনি আবারও খেলায় ফিরবেন আর দেশের হয়ে লড়বেন। তিনি চাননি একজন গাড়ি বিক্রেতা হিসেবে বেঁচে থাকতে। তাই তো হকিতে ফিরতে কঠোর অনুশীলন চালিয়ে গেছেন।

নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হকির মঞ্চে ফিরলেন আর গোলও করলেন। এ যেন মহানায়কের রাজস্যিক প্রত্যাবর্তন। তাঁর গোলেই ৩-২ ব্যবধানে জয় পায় তার দল।

তিনি বলেন, আমি আমার ক্যারিয়ারে কখনো এমন মূহুর্তের সম্মুখীন হইনি। ভয়ে ছিলাম সমর্থকদের নিয়ে কিন্তু তারা আমার জন্য চাওয়ার থেকে বেশি করেছে। আর আমার বিশ্বাস ছিল আমি স্কোর করবো। আমি এখানেই থামতে চাই না আমি আরও বড় লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চাই।

ওয়ার্ড বিশ্বাস করেন ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকের মাধ্যমে আন্তজার্তিক অঙ্গনে ফিরবেন। আর সে অনুযায়ী নিজের কাজটাও ঠিকঠাক চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমি আমার জীবনে যে সময় পার করেছি তার চেয়ে কঠিন কিছু হতে পারে না। আমি আশা করি খুব শীঘ্রই আন্তর্জাতিককে ফিরবো। তবে ক্লাব হকি আর জাতীয় দলের হকি অনেক পার্থক্য। তাই আমার সেরাটা দিতে আরও পরিশ্রম করতে হবে।


বিষয়ঃ

শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

পঙ্গুত্বকে হার মানিয়ে সফল স্বর্ণজয়ী সাইকেলিস্ট ভোগেল

পঙ্গুত্বকে হার মানিয়ে সফল স্বর্ণজয়ী সাইকেলিস্ট ভোগেল

‘এগারো’ ভিন্ন ভিন্ন গল্প জুড়ে দিলে ইতিহাস

‘এগারো’ ভিন্ন ভিন্ন গল্প জুড়ে দিলে ইতিহাস

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন কবি ব্রায়ান্ট

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন কবি ব্রায়ান্ট

অধিনায়কত্ব ছেড়ে মিশ্র অনুভুতিতে মাশরাফি

অধিনায়কত্ব ছেড়ে মিশ্র অনুভুতিতে মাশরাফি