নটিংহ্যাম শহরের ফুটবলীয় ‘রবিনহুড’ দ্য রেড

পার্থ প্রতীম রায় পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ০৯:০৬ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২২
নটিংহ্যাম শহরের ফুটবলীয় ‘রবিনহুড’ দ্য রেড

ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম শহরটির বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছেন কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নামলে প্রথমেই আসবে রবিনহুডের নাম। তার নামেই যে শহরটির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। একই শহরের ফুটবলীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে নটিংহ্যাম ফরেস্ট। যাকে সমর্থকরা আদর করে ডাকে দ্য রেড বলে। শুধু নটিংহ্যাম শহর নয়, ইংলিশদের ফুটবল সাম্রাজ্য বিস্তারেও ছিল ক্লাবটির অবদান। বলতে পারেন ইংলিশ ফুটবলের অন্যতম বনেদি ক্লাবও।

ইংলিশ ফুটবলের ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালের পাশাপাশি আপনাকে অবশ্যই উচ্চারণ করতে হবে নটিংহ্যাম ফরেস্টের নাম। তরুণ সমর্থকদের কাছে ক্লাবটির নাম নতুন ঠেকলেও একসময় ইংলিশ ফুটবলে ছিল তাদের রাজত্ব। দীর্ঘ উত্থান-পতনের সময় পেরিয়ে ২০২২-২৩ মৌসুমে ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ পর্যায় প্রিমিয়ার লিগে দেখা মিলেছে নটিংহ্যাম ফরেস্টের। দ্য রেডরা শীর্ষ লিগে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে রেকর্ড ২৩ বছর পর।

নটিংহ্যামের শেরউড জঙ্গলে আদৌ রবিনহুডের অস্তিত্ব ছিল কি-না বর্তমান শহরে তা নিয়ে একের জন একেক মত। মত যাই হোক, রবিনহুড আর নটিংহ্যাম একই সমান্তরাল পথে এগিয়ে চলে। একইভাবে নটিংহ্যামে ফুটবল মানে দ্য রেডসদের সাথে সমান্তরাল পথে এগিয়ে চলা।

শেরউডকে একপাশে সরিয়ে ট্রেন্ট নদীর তীরে গড়ে উঠা নটিংহ্যাম ফরেস্ট যে ইংলিশ ফুটবলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব তা নিয়ে কারো মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ। ইংলিশ ফুটবলের সুদীর্ঘ ইতিহাসই নটিংহ্যাম ঐতিহ্যের সাক্ষী। জানান দেয় ইউনাইটেড-লিভারপুল-আর্সেনালের মতো তারাও বনেদি ক্লাব।

sportsmail24

প্রায় দুই যুগ ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে খেলতে না পারায় এই বনেদিয়ানায় হয়তো কিছুটা ভাটা পড়েছিল। শীর্ষ পর্যায়ে ক্লাবটির দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি সামান্যতম টলাতে পারেনি সমর্থকদের। নটিংহ্যাম শহরের ফুটবল সমর্থকদের মন থেকে এক মুহূর্তের জন্য জায়গা হারায়নি দ্য রেডরা। বরং, ক্লাবের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসাই ক্লাবটিকে পুনরায় ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে ফিরে আসতে ভালোবাসা জুগিয়েছে।

২০২১-২২ মৌসুমে ইংলিশ ফুটবলের দ্বিতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের প্লে অফে হাডার্সফিল্ড টাউনকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রিমিয়ার লিগে নিজেদের খেলা নিশ্চিত করে নটিংহ্যাম ফরেস্ট। নিজেদের উন্নতি নিশ্চিত করতে ক্যালেন্ডারের পাতায় দ্য রেডদের অপেক্ষাটা ছিল ৮ হাজার ৪১৪ দিন। এই সময়ে তাদেরকে খেলতে হয়েছিল গুণে গুণে ১ হাজার ৬৯ টি লিগ ম্যাচ।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ফিরে আসার পথে নটিংহ্যামকে কোচিং করিয়েছিলেন ২০ জন কোচ। তাদের মধ্যে ১৯ জনই ব্যর্থতার খাতায় নাম লেখালেও স্টিভ কুপার ব্যতিক্রম। ইংলিশ ফুটবলের এই উদীয়মান কোচ দ্য রেড সমর্থকদের প্রমাণ করে দিয়েছেন এখনো প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা রাখে নটিংহ্যাম।

দীর্ঘ ২৩ বছর প্রিমিয়ার লিগে না থাকা নটিংহ্যাম ফরেস্ট প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে জয় করেছিল ইউরোপ। শুরু থেকেই ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যের অধিপতি রিয়াল মাদ্রিদের বাইরে গিয়ে প্রথম ক্লাব হিসেবে একাধিক ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের রেকর্ডও এই নটিংহ্যামের।

sportsmail24

ব্রায়ান ক্লফের হাতে থাকা এই নটিংহ্যাম জিতেছিল দুই ইউরোপিয়ান কাপ। এর প্রথমটি এসেছিল ১৯৭৯ সালে। পরের বছরই নিজেদের ডেরায় তুলে নিয়ে আসে দ্বিতীয় ইউরোপিয়ান কাপ শিরোপা। পাশাপাশি ক্লাফের অধীনে তাদের অর্জনের পালকে যুক্ত হয়েছিল একটি লিগ শিরোপা ও চার লিগ কাপও। ১৯৭৫ সালে দায়িত্ব নেওয়া ক্লাফ ক্লাবটির দায়িত্ব ছেড়েছিলেন ১৯৯৩ সালে।

ক্লাফ দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকেই দূর্ভাগ্য সাথী হয়েছিল নটিংহ্যাম ফরেস্টের। অন্ধকার রাতের সেই আধার কাটিয়ে প্রভাতের নতুন সূর্য উদয় দেখতে ক্লাবটিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় দুই যুগ। উত্থান-পতনের এই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছে ক্লাবটির সমর্থকরা। তাদের বিশ্বাসে বারবার আঘাত লাগলেও আস্থা হারিয়ে ফেলেননি তারা। 

ক্লাফের দায়িত্ব ছাড়ার পরের পাঁচ বছরে নটিংহ্যাম ফরেস্টের দায়িত্বে সবচেয়ে বেশি সময় ছিলেন ফ্রাঙ্ক ক্লার্ক। তার অধীনে দুইবার অবনমিত হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে আরো একবার অবনমিত হতে হতে বেঁচে যায়। তবে ১৯৯৯ সালে চোর-পুলিশ খেলায় হার মানতেই হয় ক্লাবটিকে।

নটিংহ্যামের এই চোর পুলিশ খেলার শুরুটা অবশ্য ১৮৬৫ সালে। এই মৌসুমে প্রথম বিভাগ তো পরের মৌসুমে তাদের ঠিকানা দ্বিতীয় বিভাগ। প্রথম-দ্বিতীয় বিভাগ করে ক্লাবটির ইংলিশ ফুটবলে টিকে থাকা নিয়ে সবাই যখন শঙ্কা প্রকাশে ব্যস্ত ওই সময়ই দায়িত্ব নেন খ্যাপাটে স্বভাবের ব্রায়ান ক্লাফ।

দলকে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে প্রথম পর্বে তুলে লিগ শিরোপার জয় করিয়ে দলকে করেছিলেন ইউরোপ সেরা। এমনকি ইংলিশ ফুটবলে নটিংহ্যাম সাফল্যের পুরোটা সময় দায়িত্বে ছিলেন এই ব্রায়ান ক্লাফ।

নটিংহ্যাম ফরেস্টের চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে প্রিমিয়ার লিগে ফেরা নিশ্চিতের পর ৩১ বছর ধরে ক্লাবটির ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়া কোলিন ফ্রাই বলেছিলেন, “এটা ইয়ো ইয়ো ক্লাব। আপনি যখন ইউরোপে (শীর্ষ লিগে) ফিরবেন সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার আর এটা চলতেই থাকবে (অবনমন-উন্নতি)। এটার পরে কিছু একটা হবে। তারা যেভাবে ফিরেছে, সেটা দারুণ। ১৯৯৯ অবনমনের সময় যে অবস্থায় ছিল, সেখান থেকেই তারা শুরু করেছে।”

১৯৯৯ সালে প্রিমিয়ার লিগে থেকে অবনমনের পরও তাদের অধপতন আটকে রাখা যায়নি। টানা ছয় মৌসুম চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার পর ২০০৩ সালে তাদের লড়াই ছিল দ্বিতীয় বিভাগ নেমে যাওয়া আটকানো। শেফিল্ড ইউনাইটেডের সেই বাঁধা পেরোতে না পারায় দ্বিতীয় বিভাগে খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে সমর্থকদের হতাশ করা দ্য রেডরা যে আরও বড় হতাশা তৈরি করতে পারে তা হয়তো কোনো সমর্থকদের ধারণাতেই ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগে নিজেদের দ্বিতীয় মৌসুমে সমর্থকদের হতাশ করে তৃতীয় বিভাগে নিজেদের নাম এন্ট্রি করে নটিংহ্যাম। ব্যর্থতার গল্প যখন দীর্ঘ হচ্ছে, ওই সময়ই তাদের গায়ে সেঁটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত এক ট্যাগ। নটিংহ্যাম ফরেস্ট প্রথম কোনো ইউরোপ সেরা দল যাদের কি-না নিজ দেশের তৃতীয় বিভাগে খেলার অভিজ্ঞতার সঞ্চয় করেছে।

sportsmail24

প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমনের বছরে নটিংহ্যাম ফরেস্টের মালিকানা নাইজেল ডাউটি নামে এক ব্যবসায়ী ক্লাবটিকে ১১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে কিনে নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরই শুনেছেন ক্লাবটির অবনমন। এরপর বহু চেষ্টাতেও দলকে গুছিয়ে তুলতে পারেননি। বরং, তার মালিকানায় দল ইংলিশ ফুটবলের তৃতীয় বিভাগে নেমেছিল!

ইংলিশ ফুটবলের তৃতীয় বিভাগ থেকে ক্লাবটিকে উপরে তোলার কৃতিত্বও অবশ্য নাইজেল ডাউটিরই। কোচ কোলিন কালডারউডের উপর রেখেছিলেন ভরসা। তার অধীনেই ২০০৮-০৯ মৌসুমে নটিংহ্যাম ফরেস্টের জায়গা হয় চ্যাম্পিয়নশিপে। তবে দলকে উপরে তুলে মাত্র চার মাস পরে চাকরি হারাতে হয়েছিল তাকে। স্থলাভিষিক্ত হওয়া বিলি ডেভিসের অধীনে পরপর দুই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের প্লে অফে জায়গা করে নিয়েছিল দ্য রেডসরা। ভাগ্য দেবতা মুখ তুলে না দেখায় শেষ পর্যন্ত আর প্রিমিয়ার লিগে ফেরার গল্পটা লেখা হয়নি তাদের।

২০১১ সালে দল ছাড়া বিলি ডেভিসের জায়গা নেন ইংল্যান্ডের সাবেক কোচ স্কট ম্যাকলারেন। তার অধীনে দল ক্রমেই নেমে যাচ্ছিলো নিচের দিকে। মৌসুমের ১০ ম্যাচ আগে অবনমন অঞ্চলের ঠিক উপরে ছিল দলটি। সেই সময় সমর্থকদের দাবির মুখে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান নাইজেল ডাউটি।

চেয়ারম্যানের পদ থেক সরে দাঁড়ানোর কিছুদিন পরেই ওপারে পাড়ি জমান ডাউটি। ফলে নতুন মালিকানা খুঁজে বের করাই হয়ে দাঁড়ায় মূল চ্যালেঞ্জ। সেই সময় ডাউটির অংশের শেয়ার কিনে নেন কুয়েতি ব্যবসায়ী ফাওয়াজ আল হাসাওয়ি। মালিকানা বুঝে নিয়েই সরিয়ে দেন ম্যাকলারেনকে। 

sportsmail24

২০১১ সালে দায়িত্ব নেওয়া ফাওয়াজের চাওয়া ছিল দলকে যেভাবেই হোক দলকে নিতে হবে প্রিমিয়ার লিগে। কিছুদিন পরপরই কোচকে ছাটাই করা নিয়মিত এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মালিকানায় থাকা পাঁচ বছরে কোচ বদল করেছিলেন আটবার।

শুধু তাই না, কোচ বদলের পাশাপাশি ফুটবলার দলে ভেড়াতে দেদারচ্ছে খরচ করে উয়েফার ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে (এফএফপি) নিয়ম ভেঙে নটিংহ্যাম দল-বদলের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিল। ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা থাকাকালীন তার মালিকানার বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে তোলেন নটিংহ্যাম সমর্থকরা। একরকম বাধ্য হয়েই ফাওয়াজ মালিকানা ছাড়তে বাধ্য হন।

ফাওয়াজের মালিকানার সময়টা মোটেও ভালোই কাটেনি নটিংহ্যামের জন্য। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যেতে যেতে বেঁচে যায় নটিংহ্যাম। ওই মৌসুমে গোলব্যবধানে এগিয়ে না থাকলে হয়তো আরও একবার দ্বিতীয় বিভাগে ক্লাবটিকে নাম লেখাতে হতো।

বাধ্য হয়ে ফাওয়াজ আল হাসাওয়ির বিক্রি করে দেওয়ার ওই শেয়ার কিনে নেন  গ্রিসের শিপিং ব্যবসায়ী ইভানগেলোস মারিনাকিস। ফুটবল ব্যবসায় ঝানু এই ব্যবসায়ী নটিংহ্যামের আগে মালিকানায় নিয়েছিলেন নিজ দেশ গ্রীসের প্রভাবশালী ক্লাব অলিম্পিকায়োসকে। সেই অভিজ্ঞতাটাই কাজে লাগিয়েছিলেন ইংলিশ ক্লাবটিতে। 

শুরু থেকেই তার পরিকল্পনায় ছিল দলকে তুলতে হবে প্রিমিয়ার লিগে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগে তোলার মিশনে মারিনাকিস কখনই কোচ কিংবা খেলোয়াড়দের উপর চাপিয়ে দেননি নিজের সিদ্ধান্ত। বরং, কোচের চাওয়া পূরণ করে দলকে শীর্ষ ফুটবলে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা সফলতার মুখ দেখে ২০২২ সালে এসে। ক্লাবটি তার মালিকানায় আসার পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রিমিয়ার লিগে ফেরে। মারিনাকিসের হাত ধরেই দীর্ঘ দুই দশক পর পূরণ হয়েছে সমর্থকদের আশা, আবারো ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ পর্যায় মাতাবে দ্য রেডসরা।

স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

ফাইনালের মঞ্চে সর্বোচ্চ গোল যাদের

ফাইনালের মঞ্চে সর্বোচ্চ গোল যাদের

ডকট্রোভ: ফুটবল রেফারিং করা ডোমিনিকান ক্রিকেট আম্পায়ার

ডকট্রোভ: ফুটবল রেফারিং করা ডোমিনিকান ক্রিকেট আম্পায়ার

থ্রি বাইটস, নো কার্ড!

থ্রি বাইটস, নো কার্ড!

ফুটবলের সাথে আগাচ্ছে ব্রাজিলের নারী ক্রিকেট

ফুটবলের সাথে আগাচ্ছে ব্রাজিলের নারী ক্রিকেট