বয়স ত্রিশের কোটা পার হলেই ক্রিকেটাররা কখন বিদায় বলবেন সেই নিয়ে শুরু হয় ফিসফাঁস। বয়স এর চেয়ে বেশি হলে তো ফিটনেস সমস্যা কিংবা ফর্মহীনতায় ভুগে ক্রিকেটাররাও নিজে অবসর পরবর্তী জীবনের পরিকল্পনা শুরু করে দেন। অন্তত এই বয়সে কেউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের স্বপ্ন দেখেন না। কিন্তু রিচার্ড গ্লেসন এই বয়সেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের স্বপ্ন দেখতে পারেন। ৩৫ ছুঁই ছুঁই বয়সে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পেয়ে অভিষেকের অপেক্ষায় দিন গুনছেন গ্লেসন।
ক্রিকেটাররা যখন ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে থাকেন সেই বয়সে নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নাম লেখান রিচার্ড গ্লেসন। অবশ্য এর আগে ক্রিকেটকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। ২৭ বছর বয়সে নর্থহ্যাম্পটনশায়ারে যোগ দেওয়ার আগে বেশিরভাগ সময় ব্ল্যাকপুলে ক্লাব ক্রিকেট ও মাইনর কাউন্টিতে ক্রিকেট খেলতেন তিনি।
মাইনর কাউন্টি ও ক্লাব ক্রিকেট থেকে মূল কাউন্টি দলে কোনো চুক্তি করতে না পারায় পেশাদার ক্যারিয়ার ছেড়ে কোচিংয়ে নাম লিখিয়েছিলেন রিচার্ড গ্লেসন। কোচিংয়ে যোগ দিলেও মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার সেই ইচ্ছা। এই কারণেই বিভিন্ন কাউন্টি ক্লাবে ট্রায়াল দিতে থাকেন। সুযোগটা পেয়ে যান নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে খেলার।
২০১৫ সালে নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেকের বছরে দলকে জিতিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট শিরোপা। তার এই পারফর্মেন্স জাতীয় দলের দরজা খুলে না দিলেও তাকে ইংল্যান্ড লায়ন্সে সুযোগ করে দিয়েছিল।
২০১৮ পর্যন্ত গ্লেসনের ঠিকানা ছিল নর্থহ্যাম্পটনশায়ার। সেখান থেকে ফেরেন নিজ ডেরায় ল্যাঙ্কাশায়ারে। অবশ্য এটাকে ঠিক তার নিজ ডেরা বলাও যায় না। কারণ, এখানে প্রথমবার তিনি খেলোয়াড় নয় যোগ দিয়েছিলেন কোচ হিসেবে। এর আগে ছোটবেলায় তার ক্রিকেটের হাতেখড়িটা এখানেই হয়েছিল।
নর্থহ্যাম্পটনশায়ার থেকে যখন ল্যাঙ্কাশায়ারে এসেছেন তখন অবশ্য গ্লেসন কোচ নয় এসেছিলেন চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার হিসেবে। শুধু ল্যাঙ্কাশায়ার কিংবা নর্থহ্যাম্পটনশায়ার নয় বিগব্যাশ, টি-টেন ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) মতো টুর্নামেন্টগুলোতেও খেলেছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের ক্রিকেটার ছিলেন এই গ্লেসন। এই সুবাদে কিছু বাংলাদেশির কাছে হয়তো পরিচিত নাম তিনি।
প্রত্যেক ক্রিকেটারকেই ক্যারিয়ারের কিছুটা সময় চোট সমস্যা নিয়ে পার করতে হয়! এখানেও ব্যতিক্রম ছিলেন না রিচার্ড গ্লেসন। ২০২০ সালে কোভিডের আঘাতে ক্রিকেট যখন বন্ধ ওই সময়েই পড়েছিলেন কোমরের চোটে। এর আগে অবশ্য ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে সময় কাটানোর সুযোগও মিলেছিল তার।
কোমরের চোট থেকে পূর্ণ সুস্থ না হয়েই ফিরেছিলেন ক্রিকেটে। তবে সেই ফেরাটা তাকে আবারও মাঠের বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। আবারও মাঠে ফিরতে পারবেন কি-না সেই সন্দেহ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফিরেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে তার সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে তাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি ল্যাঙ্কাশায়ার।
এই নিয়ে গ্লেসন বলেন, “আমি ওই সময় দুই মাস চাকরিহীন ছিলাম। আমি আবারও ক্রিকেট খেলতে পারবো কি-না তা নিয়েই তৈরি হয়েছিল সন্দেহ। তবে ক্রিকেটে ফিরতে পেলে নিজের শতভাগ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।”
তাকে দলে না নেওয়ার পিছনে মূল কারণটাই ছিল ওই চোট! কোমরের এই ধরনের চোট নিয়ে ক্রিকেটাররা ঠিক কতদিন খেলা চালাতে পারবেন তা নিয়েই বরাবরই সন্দেহ থাকে। তবে চোট কাটিয়ে ফেরার পর তাকে আর উপেক্ষা করতে পারেনি ল্যাঙ্কাশায়ার।
মূলত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে করা স্ক্যানের পর গ্লেসন জানতে পারেন শতভাগ সুস্থ তিনি। তার এই সুস্থতার খবরের পরই শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টের জন্য তাকে চুক্তিবদ্ধ করে ল্যাঙ্কাশায়ার। সেই সুযোগটা পেয়েই নিজেকে একেবারে টেনে নিয়েছেন জাতীয় দলের দরজায়। মূলত নিয়মিত ইয়র্কার করতে পারার দক্ষতার কারণে তাকে দলে ভিড়িয়েছিল ওল্ড ট্রাফোর্ডের দলটি।
অবশ্য এবার ইনজুরি মুক্ত হয়ে জাতীয় দলের দরজা নিজের জন্য খুলতে না পারলে হয়তো ক্রিকেটকেই বিদায় জানাতে পারতেন। সেই সম্ভাবনার কথা নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন গ্লেসন। বলেন, “আমি আবারও ফিরে আসবো এমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার মতো পারফর্ম করা তো পরের বিষয় ছিল।”
টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে ১২ ম্যাচে ২০ উইকেট শিকার করে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর তালিকায় এক নম্বরে আছেন গ্লেসন। নির্বাচকরা তাকে আর জাতীয় দলে উপেক্ষা করতে পারেননি, তাকে দলেই ডেকে নিয়েছে। অপেক্ষা শুধু জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার।
জাতীয় দলে অভিষেকের পর অবশ্য এখনই থামার কোনো ইচ্ছা নেই গ্লেসনের। বরং ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে আগস্টে অনুষ্ঠিতব্য দ্য হানড্রেডে দল পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এমনকি টি-টোয়েন্ট ব্লাস্টের দারুণ এই পারফর্মেন্সে সন্তুষ্ট হয়ে চুক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে আশাবাদী ল্যাঙ্কাশায়ারও। তবে দ্য হানড্রেড কিংবা ল্যাঙ্কাশায়ার নয়, এখন ইংল্যান্ডের হয়েই নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ভাবনাটাই ঘুরছে গ্লেসনের মনে।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দেরি করে সাফল্য পাওয়া গ্লেসন অবশ্য শুধু মাঠের খেলা নিয়েই থাকেন না। এর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে মায়ার্সকফ কলেজে ক্রিকেট প্রভাষক হিসেবেও কাজ করছেন। সাথে আছে ইসিবির লেভেল থ্রির কোচিং লাইসেন্স। এমনকি ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতাটাও আছে তার।
তবে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা কিংবা শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেয়ে তার বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করবেন ইংলিশদের। সেখানে রোহিত-কোহলিদের থামিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করবেন, সেটাই তো চাওয়া। হারুক কিংবা জিতুক, এই বয়সে ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নেওয়াটা আসলেই এক বিস্ময়!
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর