ব্রাজিলের নাম শুনলেই মাথায় আসে সাম্বার তালে ফুটবল নিয়ে কারিকুরি দেখানো পেলে-রোনালদো কিংবা হালের নেইমারের কথা। ফুটবলের জনপ্রিয়তা এতোটা বেশি-নতুন শিশু জন্মালে কোন ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলবে, সেই চিন্তা-ভাবনা কাজ করে। তবে পুরো ব্রাজিলের এই চিত্রটাই বদলে গিয়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিনাস গেরেইসে। এই রাজ্য ফুটবলের নয়, জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘ভদ্র লোক’-এর খেলা খ্যাত ক্রিকেট।
ফুটবলের গোলপোস্ট বানিয়ে খেলার বদলে ক্রিকেট ব্যাট হাতে বলকে সীমানার ওপারে পাঠাচ্ছে, এমন দৃশ্য চোখে পড়বে এই ভাবনাটাই কখনো আসেনি ক্রিকেট সমর্থকদের মনে। ব্রাজিলের মাঠে এই নিয়মিত দৃশ্যের অবতারণা করেছেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার ম্যাট ফেদারস্টোন। তার একাগ্র চেষ্টাতে মিনাস গেরেইসে দেখা মিলছে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা।
২০০০ সালে এক ব্রাজিলিয়ান নারীকে বিয়ে করে দেশটিতে স্থায়ী হন ইংলিশ ক্রিকেটার ম্যাট ফেদারস্টোন। দেশটিতে স্থায়ী হওয়ার পরই ফুটবলের দেশে ক্রিকেটকে পরিচিত করার কাজ শুরু করেন সাবেক এই ক্রিকেটার।
কাজ শুরুর সময় তার স্ত্রী জানিয়েছিলেন, “তুমি কি পাগল? এখানকার লোকজন কোনোভাবেই ক্রিকেট বুঝবে না।”
স্ত্রীর বাধাতেও থামেনি ফেদারস্টোনের কাজ। লক্ষ্যে অটুট থেকে ক্রিকেটকে চেনাতে শুরু করেন। কাজ শুরু করে বোঝেন, ক্রিকেট শেখাতে হলে ফুটবলের পাশাপাশি হকি, রাগবি এবং সেইলিংয়ের সাথে লড়াই করতে হবে।
ফেদারস্টোন অবশ্য নিজের এই উদ্যোগে ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে পাশে পেয়েছিলেন। তাদের সাথে যৌথ উদ্যোগে শুরু করেন ‘সিক্সটি থ্রি (63) যুব প্রকল্প’। এই প্রকল্পের অধীনে ছেলেদের নয়, বরং নারীদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে কাজ শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে ব্রাজিলিয়ান নারী ক্রিকেট দলের বেশিরভাগই এসেছেন এই প্রকল্প থেকে।
শুরুতে ফেদারস্টোনকে পাগল ভাবলেও তার দারুণ কর্মদক্ষতায় মিনাস গেরেইসের রাজধানী পাকোস দি কালদাসে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। এখন তো ফুটবলকে ছাড়িয়ে ক্রিকেটই ওই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।
ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার পিছনে ফেদারস্টোনের কর্মদক্ষতারই প্রশংসা করেছেন পাকোস দি কালদাসের মেয়র সার্জিও জেভেদো। বলেন, “তার ক্যারিশমাটিক চরিত্র ক্রিকেটকে এই অঞ্চলে জনপ্রিয় করে তুলেছে। (ব্রাজিলের) একমাত্র এই অঞ্চলেই ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয়।”
ব্রাজিলে ছেলেদের মধ্যে এখনো সম্ভব না হলেও নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে ক্রিকেট। এমনকি ছেলেদেরকে এখনো পেশাদার চুক্তির না দিলেও ইতিমধ্যেই মেয়ে দলের ক্রিকেটাদের কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায় নিয়ে এসেছে ব্রাজিল ক্রিকেট (বিসি)। যেকোনো খেলায় ব্রাজিল প্রথম দেশ যারা কি-না পুরুষ দলের আগে নারী দলকে কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায় নিয়ে এসেছে।
বর্তমান সফলতার আগে ব্রাজিলের নারীদের ক্রিকেট বোঝাতে ফেদারস্টোনকে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে দলটির অধিনায়ক রবার্তা মোরেত্তি অ্যাভেরির কণ্ঠে। ব্রাজিলিয়ান নারীদের দলনেতা জানান, শুরুতে তিনি ক্রিকেট কি সেটাই বোঝেননি।
বলেন, “প্রথমবার দেখে আমার মোটেও ভালো লাগেনি। আমি কিছুই বুঝিনি। তবে এতোটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, স্থানীয় খেলা টোকোর সাথে মিল আছে।”
ব্রাজিলের রাস্তায় ক্রিকেটের মতোই একটি খেলা দেখা যায়, যা কি-না ক্রিকেটের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও নিয়ম কানুন পুরোটাই বেসবলের মতো। টোকোর সাথে মিল থাকায় অ্যাভেরির ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ব্রাজিল ক্রিকেটের সিক্সটি থ্রি (63) যুব প্রকল্পের অধীনে খেলা শেখা শুরু করেন।
শুরুতে ক্রিকেট জনপ্রিয় না হলেও আস্তে আস্তে বাড়ছে খেলাটির জনপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয়তা বেশ বিস্ময় তৈরি করেছে মেরোত্তি অ্যাভেরির চোখে, “যেভাবে ক্রিকেট আগাচ্ছে, তা বিস্ময়কর। আমরা এটাকে বিনোদনের জন্য অন্যতম মাধ্যম করে তুলেছি।”
পাকোস ডি কালদাসের নারীদের উন্নয়নের পিছনেও ভূমিকা রেখেছে ক্রিকেট। এমনটাই মনে করেন দলটির ১৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডার লাওরা কারদোসো। বলেন, “ক্রিকেট না খেললে আমার পাসপোর্টই হতো না। আমি দুবাই, আফ্রিকা কিংবা ইউরোপে ঘুরতে পারতাম না। স্বাভাবিক জীবন যাপণ করাই কঠিন হতো। এর জন্য ক্রিকেটকে ধন্যবাদ।”
ব্রাজিলের ক্রিকেটে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, তার প্রমাণ মেলে দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের বাজেট দেখেও। শুরুতে বোর্ড চালানোর জন্য বাৎসরিক ৫ হাজার মার্কিন ডলার পেলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারে।
শুধু কি তাই, ব্রাজিলজুড়ে ক্রিকেটারদের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫ হাজার। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই পাকোস ডি কালদাস শহর থেকে এসেছেন। ব্রাজিলিয়ান নারী ক্রিকেটাররা তাদের পাওয়া সুযোগ সুবিধার পূর্ণ ব্যবহারও করছেন। আইসিসি র্যাঙ্কিং কিংবা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে তাদের পারফর্মেন্সই সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করে।
আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে ২৮তম স্থানে আছে ব্রাজিল আর দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশীয় সেরার টুর্নামেন্টে পাঁচবারের মধ্যে চারবারই শিরোপা উঠেছে ব্রাজিলিয়ান নারীদের ডেরায়।
একটু ভিন্ন তথ্য দিয়ে শেষ করি, ব্রাজিলে ক্রিকেটে জনপ্রিয়তা এখন দেখা গেলেও ল্যাতিন আমেরিকায় ক্রিকেট শুরু হয়েছিল সেই ১৯- শতকে। আফ্রিকা থেকে আসা দাসপ্রথার মাধ্যমে সাম্বার দেশে নজর কেড়েছিল ক্রিকেট। তবে ‘ভদ্র লোক’-এর খেলা হিসেবে পরিচিত ক্রিকেট তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি সমাজ ব্যবস্থার কারণে। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের খেলাধুলায় জনপ্রিয়তার ওই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ফুটবল। এমনকি ইতিহাস ঘাটলে দেখা মিলবে ল্যাতিন আমেরিকায় প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের বিভিন্ন টুর্নামেন্টের।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর