৩৪ বছর বয়স, এক মাস পরেই হবে ৩৫! আর কতদিনই বা খেলবেন! এখনো বল নিয়ে চিতা বাঘের মতো দৌড়ান। মাঠের এক পাশ থেকে যখন অন্য পাশে বল নিয়ে ছোটেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের পাগলপ্রায় অবস্থা হয়ে যায়। আর কতদিনই বাঁ ছুটবেন! কার কথা বলছি? হয়তো বুঝেই গেছেন, হ্যাঁ, তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার আর্জেন্টাইন খুদে যাদুকর লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
আর্জেন্টিনার আকাশী-নীল জার্সিতে ভালো খেলতে না পারার অপবাদ তার সারাজীবনের সঙ্গী। যে দেশের জন্য নিজেকে প্রতিটি মুহুর্তে নিংড়ে দিয়েছেন সেখানেও তার পিন্ডি চটকানো হয়েছে সর্বক্ষণ! তবে সময় তো পাল্টায়!
যে দলটা টানা তিন ফাইনাল হেরেছে সেই দলটাই এক বছরের মধ্যে দুইটা শিরোপা জিতলো। জাতীয় দলের হয়ে সব জেতা মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জেতেননি বলে নিন্দুকেরা আলোচনা ভারী করতো। সেই মেসি এক বছরেই দুইটা আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পেলেন।
কোপা আমেরিকা ফাইনালে টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করেছিলেন। হেরে কেঁদেছেন, সেটা নিয়েও ট্রল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টানা তিন ফাইনাল হারার পর চাপে ভেঙে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় দলে মেসি ঠিকমতো খেলেন না এই অভিযোগ তো ছিলই।
সেই আর্জেন্টিনা, যে দলটাকে ‘আর জেতেনা’ বলে ট্রল করা হতো। সেই দলটা তিন বছর ধরে অপরাজিত। দলটার নেতৃত্বে পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার এক যাদুকর। যে কিনা জাতীয় দলের হয়ে একটা শিরোপা জেতার জন্য নিজের সব কিছু বিসর্জন দিতেও রাজি ছিল। দলের প্রত্যেকটা তরুণ খেলোয়াড় যাকে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে।
ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন দলকে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে মহাদেশের ফুটবল লড়াইয়ের শিরোপা ধরে রেখেছে আর্জেন্টিনা। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে ম্যারাডোনার হাত ধরে এসেছিল যে শিরোপা সেটা অক্ষত থাকলো মেসির হাতেই।
ইতালির বিপক্ষে মেসি কোনো গোল করেননি। তবুও ম্যাচ সেরার পুরষ্কারটা তিনিই জিতেছেন। কিভাবে সম্ভব? ৩ গোলের ম্যাচে কোনো গোল না করেই ম্যাচ সেরা? হ্যাঁ সেরা। আপনি এতটুকু অবাক হবেন না যদি পুরো ম্যাচটা দেখে থাকেন। দেড় ঘন্টায় ইউরোপ চ্যম্পিয়নদের বিপক্ষে মেসি দেখিয়েছেন বল পায়ে তিনিই এখনো বিশ্বসেরা। এই আর্জেন্টিনা দলে অভিভাবক মেসি ঠিক কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন সেটারও এক ছটাক মঞ্চায়ন হয়ে গেলো এই ম্যাচে।
বাংলাদেশ সময় রাত ১২.৪৯ মিনিটে ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইউরোপের মুখোমুখি ল্যাতিন আমেরিকা। পুরো বিশ্বের চোখ ওয়েম্বলির মাঠটার দিকে। আর্জেন্টিনা ভক্তরা একই সাথে অধীর অপেক্ষায় আবার একটু উৎকণ্ঠাও উঁকি দিচ্ছে বৈকি! যাই হোক অনেকের মতেই ধারে ভারে এগিয়ে থাকা ইউরোপিয়ান দলের মুখোমুখি হচ্ছে আর্জেন্টিনা। নিজেদের সেরা সময় ফিরে আসছে এটা বিশ্বকে দেখানোর জন্য তথাকথিত ইউরোপিয়ান দলের বিপক্ষে একটা জয় তো মেসির দলের দরকারই ছিল।
তবে গত রাতে মেসির দল শুধু জেতেইনি আর্জেন্টিনা দলের পরিবর্তনও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ইতালিকে এতুটুক জায়গা দেয়নি ঘুরে দাঁড়ানোর। নিন্দুকেরা বলেন ল্যাতিন আমেরিকা দল আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে পারে না! ইতালি কাল সেটা ভালোভাবেই টের পেয়েছে!
এক মেসিকে ঠেকাতেই ইতালি যেভাবে হিমশিম খেয়েছে তাতে কাতার বিশ্বকাপের বাকি দলগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ারই কথা। এক মাস পর যার বয়স হবে ৩৫ তাকে কোনোভাবেই ফাউল ছাড়া থামাতে পারেনি ইতালির কোনো ডিফেন্ডার। অবশ্য আপনি আবার বলতে পারেন, এটা আবার নতুন কি! আসলেই তো! নতুনই তো নয়ই তবে এরকম মেসিকে প্রত্যেকদিন দেখতেও আপনার নিশ্চয়ই বিরক্ত লাগার কথা নয়।
মেসি কাল ইতালির গোলপোস্টে আটটি শট নিয়েছেন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন আটটি। তার দল আর্জেন্টিনা নিয়েছে ১৪টি! তাইলে কি দাঁড়ালো? ইতালির গোলপোস্টে আর্জেন্টিনার নেওয়া শটের সাতান্ন শতাংশই এসেছে মেসির পা থেকে। দাপট বোধহয় একেই বলে! ক্লাব ফুটবলে মেসির পিএসজি সতীর্থ গোলরক্ষক দোন্নারুমা অসাধারন কয়েকটি সেইভ না দিলে হয়তো একাধিক গোলেরও দেখা পেতেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।
আর্জেন্টিনার প্রথম গোলটা যেভাবে হলো, সেখানে লাওতারো মার্টিনেজের অবদান শুধুই শেষ টোকাটা! ইতালির বক্সে বাঁ পাশ থেকে যেভাবে কাট আউট করে মার্টিনেজকে দিলেন তাতে ওখান থেকে গোল না করতে পারলে মার্টিনেজের জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ হতো! ইতালির চারজন ডিফেন্ডার তাকে টেনে হিচড়ে কোনোভাবেই থামাতে পারেননি। গোলের পর তাদের মুখ দেখেও মনে হচ্ছিল, আসলেই মেসিকে থামাতে তাদের কাছে কোনো উত্তরই ছিল না।
খেলার শেষ হওয়ার কিচুক্ষণ আগে মাঝ মাঠের নীচ থেক বল পায়ে হরিন শিকারে ছোটা বাঘের মত ইতালির বক্সে গিয়েছিলেন, দৃশ্যটা দেখে থাকলে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন আপনি। ভাগ্য সহায় ছিল না, গোল পাননি তবে মেসির পা থেকে ছোটা বল মুহূর্তেই গোল করে ইতালির কফিনে শেষ পেরেকটা পুতে দেন সদ্যই মাঠে নামা পাওলো দিবালা।
পিএসজিতে মাত্র কয়েক দিন আগের মেসিকে মেলান তো কালকের রাতের আর্জেন্টিনার মেসির সঙ্গে! কে বলবে এই মৌসুমে ফর্মে নেই তিনি! কে বলতে পারে, পিএসজিতে ভালো খেলতে না পারার ঝাল হয়তো ইতালির উপর দিয়েই মেটালেন তিনি।
পুরো সময়টাতে মেসির পায়ে বল গেলেই ইতালিয়ান ফুটবলারদের মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় বোধহয় এরাই! ওরা বুঝতেই পারছিল না কিভাবে কি করবে, কিভাবে থামাবে এই যাদুকরকে! অবশ্য ওরা কেন, মেসিকে থামানোর মন্ত্র তো পৃথিবীর কারোরই জানা নেই!
আজ্জুরিদের বিপক্ষে কার রাতটাই ছিলো মেসিময়। ৯২ শতাংশ পাস একুরেসি, ৪টা নিশ্চিত গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। আর্জেন্টিনার তিন গোলের দুই গোলেই সহায়তা ছিল তার।
বড় ম্যাচে মেসি পারেন না, চাপে ভেঙে পড়েন কথাগুলো আরও কি শুনতে হবে তাকে? হয়তোবা না হয়তো বা হ্যাঁ! তবে কাল রাতে মেসি যা করেছেন ইতালি সহজে ভুলতে পারবে না!
ক্যারিয়ারে ইতালির বিপক্ষে ফাইনালিসিমা ছিল মেসির ৪৫তম ফাইনাল। যেখানে ৪০ ম্যাচেই শিরোপা জিতেছে মেসির দল। এই ৪৫ ম্যাচে মেসির গোল এবং এ্যাসিস্টের সংখ্যা ৪৬! অবিশ্বাস্য? সাতটা ব্যালন ডি’অরের মালিক মেসির পুরো ক্যারিয়াটাই তো অবিশ্বাস্য রেকর্ডে ভরপুর!
এইসব স্ট্যাট দেখে আসলে আপনি বুঝতে পারবেন না, মেসি কাল কি করেছেন ওয়েম্বলিতে। আপনি যদি খেলা দেখে থাকেন তাহলে অবশ্যই বুঝবেন, মেসির কালকের পারফর্মেন্স ভাষায় বর্ণনা করা একরকম অসম্ভব!
ওয়েম্বলিতে মেসি কখনো হারেননি, আর্জেন্টিনা কখনো জেতেনি। কাল ম্যাচ শুরুর আগে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল এটিই! অধিনায়ক মেসি নিজের রেকর্ডকে অক্ষত রাখার পাশাপাশি নিজের দলের অপ্রত্যাশিত রেকর্ডও মুছলেন! সত্যিকারের নেতারা তো এমনই হয়!
মেসি বন্দনা করতে এখন শব্দের খুব অভাব দেখা যাচ্ছে। এক যুগের বেশি সময় ধরে একটা লোক ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করছেন, প্রতিনিয়ত এক একটা উপমা ব্যবহার করতে হয়েছে! এখন দেখা যাচ্ছে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারই শেষের পথে।
সে শব্দ শেষ হয় হোক! আপনি ছুঁটতে থাকুন মেসি। বল পায়ে আপনার ছোটা যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটির একটি। মেসি নিজে কি জানেন এটা? না জানলেও সমস্যা নেই। আমরা জানলেই হচ্ছে। মেসি শুধু ফুটবল মাঠে বল পায়ে মোনালিসা আঁকতে থাকুক! তাতেই বরং চলবে, নাকি?
স্পোর্টসমেইল২৪/এসকেডি