পৃথিবীতে নারীদের লড়াইয়ের গল্পটা নতুন নয়। জন্মের পর থেক একজন নারীকে নানান প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে একটা অবস্থান গড়ে নিতে হয়। এখানে কেউ সফল হয়, কেউবা ব্যর্থতার গল্পে হাবুডুবু খায়। যদি খেলাধুলার ক্ষেত্রে নারীদের দিকে দৃষ্টি ফেরানো হয়, তবে দেখা যাবে কেবল লড়াইয়ের গল্প। এরপরও তারা টিকে আছে, লড়াই করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে, বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছে।
বিশ্বমঞ্চে নারীদের পদচারণার ইতিহাস এবার নতুন করে লিখলো কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ। এই আসরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মাঠে খেলোয়াড়দের দিক নির্দেশনা দিবেন ছয় নারী রেফারি। নারীদের এই রেফারিংয়ের ধারাটা শুরু করেছিলেন ব্রাজিলের লিয়া ক্যাম্পোস। যার বাঁশির হুইসেলে সৃষ্টি হয় নতুন এক ইতিহাস। তার দেখানো পথ ধরে এবার আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন আরও ছয়জন নারী।
এই ছ্যয়জন হলেন ফ্রান্সের স্টেফানি ফ্রাপা, রুয়ান্ডার সালিমা মুকাসানগা, জাপানের ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা, ব্রাজিলের নেউসা বাক, মেক্সিকোর কারেন দিয়াস মেদিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথরিন নেসবিট। লিয়া ক্যাম্পোসের জীবনী আমরা অনেকেই জানি। এবার জেনে নেয়া যাক এই ছয়জনের অজানা সব তথ্য।
স্টেফানি ফ্রাপা (ফ্রান্স)
ছোটকাল থেকেই ফুটবল ভালোবাসতেন স্টেফানি ফ্রাপা। তার জের ধরে খেলাটার সঙ্গেই ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক রেফারির তালিকায় যুক্ত হন। ২০১১ সালে প্রথমবার রেফারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এই নারী। ফ্রান্সের তৃতীয় বিভাগ লিগ দিয়ে শুরু। এরপর লিগ টু পেরিয়ে লিগ ওয়ানে রেফারিং করার অনুমতি পান ফ্রাপা।
লিগ ওয়ান ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম নারী রেফারি তিনি। এবার পুরুষ বিশ্বকাপেও প্রথমবারের মতো বাঁশি ও পতাকা হাতে মাঠে বিচরণ করবেন ৩৮ বছর বয়সী এই ফরাসি নারী। ক্যারিয়ারে সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৩টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তিনি। তিনি তিনবার (২০১৯, ২০২০ ও ২০২১) বিশ্বের সেরা মহিলা রেফারির পুরস্কার পেয়েছেন।
সালিমা মুকাসানগা (রুয়ান্ডা)
কাতার বিশ্বকাপে তিন প্রধান নারী রেফারির একজন সালিমা মুকাসানগা। ৩৩ বছর বয়সী মুকান্সানগা প্রথম আলোচনায় আসেন চলতি বছরের জানুয়ারিতে। ক্যামেরুনে অনুষ্ঠিত পুরুষদের আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস দায়িত্ব পালনকারী প্রথম নারী রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফাইনালেও দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
মুকাসানগা পেশাগত জীবনে রেফারিকে বেছে নিলেও তিনি এরচেয়েও মূল্যবান পেশায় যেতে পারতেন। তার বিষয়ে অজানা একটা তথ্য হলো, তিনি গিটওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নার্সিং এবং মিডওয়াইফারিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ছোটকালে তার লক্ষ্য ছিল বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়া। মুকানসাঙ্গা ২০১৭ সালে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোতে বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতায় ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন।
ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা (জাপান)
শৈশবে ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে পারেননি। ২০১৫ সালে প্রথম রেফারি হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা। তিনি ফ্রাপা ও মুকাসানগার মতোই টোকিও অলিম্পিকে দায়িত্ব পালন করেন। ইয়ামাশিতা পুরুষদের এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা পরিচালনাকারী প্রথম মহিলা রেফারি। কাতার বিশ্বকাপে ফ্রাপা ও মুকাসানগার সঙ্গে প্রধান তিন রেফারির একজন হিসেবে দেখা যাবে তাকে।
নেউসা বাক (ব্রাজিল)
শুরুতে পড়াশোনার দিকেই ঝোঁক ছিল নেউসা বাকের। তবে ২০০৫ সালে প্রথমবার তার ভাই আন্দ্রে লুইজের অনুরোধে অপেশাদার ম্যাচগুলোতে রেফারিং করার মাধ্যমে এই পেশার প্রতি ভালো লাগার শুরু হয়। এরপর ২০০৮ সালে তিনি পেশাদার ফুটবলে আত্মপ্রকাশ করেন। তখন একটি ছয় মাসের রেফারিং কোর্সে প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার রেফারিং ক্যারিয়ার।
২০১২ সালের ফিফার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন নেউসা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ২০১৪ সালে প্রথমবারে মতো রেফারিং করেন তিনি। তিনি ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মহিলা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর এবার ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে সহকারী রেফারি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
কারেন দিয়াস মেদিনা (মেক্সিকো)
কাতার বিশ্বকাপে ছয় নারী রেফারির একজন মেক্সিকোর কারেন দিয়াস মেদিনা। তার ক্যারিয়ারের শুরু হয় বেশ নাটকীয়ভাবে। তিনি একসময় কফি শপে কাজ করতেন। সেখানে কাজ করার সময় একদিন স্থানীয় খেলায় মনোনীত রেফারি না আসায় তিনি ম্যাচ পরিচালনা করেন। এরপর থেকেই তার ক্যারিয়ারের শুরু।
তিনি তিনি পুমাস এবং লিওনের মধ্যে মেক্সিকো লিগে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম মহিলা রেফারি। তিনি পুরুষদের অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ সহ একাধিক কনকাকাফ টুর্নামেন্টে কাজ করেছেন। টেক্সাসের হিউস্টনে ২০২০ মহিলা অলিম্পিক বাছাইপর্বের রেফারিং দলেরও অংশ ছিলেন মেদিনা।
খেলার বাইরে অবসরে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে, সিরিজ দেখতে এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে ভালোবাসেন তিনি। রেফারি হিসেবে তার স্বপ্ন হল প্রতিটি খেলা উপভোগ করা, প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময়, পরীক্ষা উপস্থাপন করার সময় বা ম্যাচ পরিচালনা করার সময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
ক্যাথরিন নেসবিট (যুক্তরাষ্ট্র)
ক্যাথ্রিন নেসবিটের রেফারিংয়ে আসার গল্পটা নাটকীয়। শৈশবে তিনি একটা চাকরি করতেন। সেখানে ফুটবল ম্যাচ হতো। ম্যাচ দেখতে দেখতেই খেলাটার প্রেমে পড়ে যান ক্যাথরিন। তবে শুরুতেই রেফারিংয়ে আসতে পারেননি। শুরুটা ২০১৩ সালে। তবে পুরোদমে শুরু হয় ২০১৯ মহিলা বিশ্বকাপের সময়।
ক্যাথরিন নেসবিট উত্তর আমেরিকায় পুরুষদের পেশাদার চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে প্রথম মহিলা রেফারির দায়িত্ব পালন করেন। এবার কাতার বিশ্বকাপে সহকারী রেফারি হিসেবে থাকবেন। নেসবিট রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতে ভালোবাসেন। তিনি দশ বছর বাল্টিমোরের টাওসন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।
স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি