বহু জল ঘোলা করে অবশেষে ইংলিশ ক্লাব চেলসিকে বিক্রি করে দিয়েছেন রাশিয়ান ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২২ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহেই ক্লাব বিক্রির প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবে। দীর্ঘ ১৯ বছর মালিকানায় থাকার পর একরকম বাধ্য হয়েই চেলসিকে বিক্রি করে দিচ্ছেন এই রাশিয়ান ধনকুবের। হাতে গড়া ক্লাবকে নিশ্চয় এতো সহজে হাতছাড়া করতে চাননি! তবে নিয়তিই বাধ্য করেছে ক্লাবকে বিক্রি করে দিতে।
২০০৩ সালে চেলসির মালিকানা বুঝে নেওয়ার পর থেকেই ক্লাবকে ইউরোপের সেরা ক্লাবে পরিণত করতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেননি রোমান আব্রামোভিচ। সফলও হয়েছেন, দলকে সেরাদের কাতারে রেখেই মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছেন আব্রামোভিচ। একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক, দীর্ঘ ১৯ বছরের পথচলায় কিভাবে তিনি চেলসিকে বদলে দিয়েছেন ।
২০০৩ সালে বৃটিশ ব্যবসায়ী কেন বেটসের কাছ থেকে ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসিকে কিনে নেন রোমান। দলকে নিজের মালিকানায় নিয়েই প্রথম দলবদল মৌসুমেই খরচ করেন ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। দলে নিয়ে আসেন জুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন, হার্নান ক্রেসপো এবং ক্লাউডি মিকেলেলের মতো ফুটবলারদের।
চেলসির মালিকানা বদলের সময়ে দলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন ইতালিয়ান মাস্টারমাইন্ড ক্লাদিও র্যানিয়েরি। দল নতুন মালিকানায় আসার পর তার অধীনে ভালো সাফল্যও পেয়েছে চেলসি। তাতে অবশ্য খুশি ছিলেন না মালিক রোমান আব্রামোভিচ। তাই তো চাকরি হারাতে হয় তাকে।
স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ছাড়ার আগে দলকে প্রিমিয়ার লিগের তৃতীয় স্থানে রেখেছিলেন র্যানিয়েরি। এমনকি দলকে তুলেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি-ফাইনালেও।
২০০৪-০৫ মৌসুমের শুরুতেই চেলসিতে র্যানিয়েরির স্থলাভিষিক্ত হন সদ্যই পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোকে লিগ শিরোপা এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো কোচ হোসে মরিনহো। দায়িত্ব নেওয়ার মৌসুমে বেশ সফল হন স্বঘোষিত ‘স্পেশাল ওয়ান’ মরিনহো। ব্লুজদেরকে জেতান লিগ শিরোপা এবং লিগ কাপ। পাঁচ বছর পর আবারও শিরোপা উৎসবে ভাসার উপলক্ষ্য পায় ব্লুজ সমর্থকরা। পাশাপাশি দীর্ঘ ৪৯ বছর পর লিগ শিরোপা জিতে দলটি। তাও কি-না রেকর্ড ৯৫ পয়েন্ট নিয়ে! স্বাভাবিকভাবেই মরিনহোর উপর বাড়তে থাকে প্রত্যাশার চাপ।
শুধু কি তাই, টানা দ্বিতীয় মৌসুমেও লিগ শিরোপা জিতেছিল চেলসি। কিন্তু ইউরোপিয়ান মঞ্চে ব্যর্থ দলটি। পাশাপাশি হাতছাড়া হয়েছিল লিগ কাপের শিরোপা।
এক মৌসুম বিরতি ২০০৬-০৭ মৌসুমে দিয়ে লিগ কাপের শিরোপা পুনরুদ্ধার করে। এছাড়াও নিজেদের ঘরে তোলে এফএ কাপের শিরোপা। টানা তৃতীয়বারের মতো লিগ শিরোপা জয়ের লক্ষ্য থাকলেও ব্যর্থ হয়েছিল চেলসি। পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগেও ব্যর্থ হয় স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের দলটি। ব্যর্থতার দায়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হয় চেলসিতে মরিনহোর প্রথম মেয়াদ।
মরিনহোর বিদায়ের পর ২০০৭-০৮ মৌসুমে চেলসির প্রশাসনে আসে বড় রদ-বদল। স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান আভ্রাম গ্রান্ট। এছাড়াও কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্রাজিলকে পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা জেতানো কোচ লুইস ফেলিপ স্ক্যালোরি। বিশ্বকাপজয়ী কোচ হওয়ায় তার উপর ছিল প্রত্যাশার চাপ।
কিন্তু এই প্রত্যাশার চাপ সামলে চেলসিকে সাফল্য এনে দিতে তুমুলভাবে ব্যর্থ স্ক্যালোরি। সাত মাস পরেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি মেলে তার। এই ব্রাজিলিয়ানের দায়িত্ব ছাড়ার মৌসুমেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ক্লাবটি। তবে ফাইনালে ইংল্যান্ডের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বাঁধা পেরিয়ে শিরোপা ছোয়া দূরত্ব থেকেই ফিরে আসতে হয় চেলসিকে।
স্ক্যালোরির বিদায়ের পর অন্তবর্তীকালীন দায়িত্বে আসেন রাশিয়ান গুস হিডডিংক! তার অধীনে চেলসিতে আসে এফএ কাপ শিরোপা। পাশাপাশি তৃতীয় স্থানে থেকে লিগ শেষ করায় পায় চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার টিকিট।
২০০৮-০৯ মৌসুমে স্ক্যালোরির স্থলাভিষিক্ত হন ইতালিয়ান মাস্টারমাইন্ড কার্লো আনচেলত্তি। তার অধীনে প্রথম মৌসুমে দারুণ সফল ছিল স্ট্যামফোর্ট ব্রিজের দলটি। দায়িত্ব নিয়েই ক্লাবকে জেতান প্রিমিয়ার লিগ আর এফএ কাপ শিরোপা।
প্রথম মৌসুমে পাওয়া সফলতা আর ধরে রাখতে পারেননি আনচেলত্তি। তাই ২০১০-১১ মৌসুমে চেলসির ট্রফি কেসে যুক্ত হয়নি নতুন কোনো শিরোপা। স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থতার দায়ে চাকরি হারান এই ইতালিয়ান।
আনচেলত্তির বিদায়ের পর তরুণ আন্দ্রে ভিলাস বোয়াসের হাতে দায়িত্ব তুলে দেন আব্রামোভিচ। পোর্তোকে লিগ শিরোপার পাশাপাশি ইউরোপা লিগ জিতিয়ে নজর কেড়েছিলেন ভিলাস বোয়াস। অবশ্য তাকে কোচ হিসেবে নিয়োগের সময় তুমুল সমালোচনায় পড়েছিল ইংলিশ ক্লাবটি। কারণ ভিলাস বোয়াস যে বয়সে একদমই তরুণ, এছাড়াও তার ছিল না কোনো পর্যায়ের পেশাদার ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতা। তিনি চেলসির মতো বড় ক্লাবে কতটুক সফল হবেন তা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। বহু সমালোচনা উপেক্ষা করে তার হাতেই দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন রোমান আব্রামোভিচ।
সমালোচকদের শঙ্কাই সত্যি পরিণত হয়েছিল। নয় মাস পর তাকে চেলসির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। এই সময়ে তার অধীনে খেলা ম্যাচগুলোর অর্ধেক সংখ্যক ম্যাচেই হেরেছিল চেলসি।
মৌসুমের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে দলের এই বিপদে হাল ধরেন ক্লাব কিংবদন্তি রবার্তো ডি মাত্তেও। এর আগে অবশ্য ভিলাস বোয়াসের সহকারি হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি।
এই মাত্তেওর অধীনেই চেলসিতে আসে প্রথম কোনো ইউরোপিয়ান শিরোপা। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা ঘরে তোলে চেলসি। তাও কি-না ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে তাদের ঘরের মাঠে হারিয়ে!
তবে পূর্বসূরি আন্দ্রে ভিলাস বোয়াসের মতো মাত্র নয় মাস পরেই চাকরিচুত্য হন মাত্তেও। কারণ, চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব বিদায় নিয়েছিল দলটি। মাত্তেওর উত্তরসূরি হিসেবে আসেন রাফায়েল বেনিতেজ। তার অধীনে অবশ্য ইউরোপা লিগের শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় দলটি। রোমান আব্রামোভিচের অধীনে এটি ছিল চেলসির দ্বিতীয় কোনো ইউরোপিয়ান শিরোপা জয়।
এই ২০১২-১৩ মৌসুম শেষে দ্বিতীয় দফায় স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ফেরেন মরিনহো। দায়িত্ব নিয়েই ২০১০ সালের পর প্রথমবারের মতো চেলসিকে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতারন। কিন্তু ২০১৫-১৬ মৌসুমের মাঝপথে খেলোয়াড়দের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ড্রেসিংরুমে নিজের কর্তৃত্ব হারান এই পর্তুগিজ। আবারও সুখস্মৃতিহীন এক বিদায় দেখে চেলসি। দ্বিতীয়বারের মতো চাকরি হারিয়ে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ছাড়েন মরিনহো। এই মৌসুমেই আব্রামোভিচের আমলে প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে খারাপ ফল করে চেলসি। প্রিমিয়ার লিগে দশম স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করে ব্লুজরা। এই কারণে ইউরোপা লিগেও খেলার সুযোগ মেলেনি ব্লুজদের।
মরিনহোর বদলি কোচ অ্যান্তেনিও কন্তে! প্রথম মৌসুমে দলের হাতে তুলে দেন প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। আর দ্বিতীয় মৌসুমে এফএ কাপ। দলকে একটি শিরোপা জেতালেও প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষ চারে রাখতে না পারায় চাকরি হারান কন্তে।
কন্তের স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক ইতালিয়ান মারিসিও সারিকে। তিনি অবশ্য চাকরি হারাননি। নিজ দেশের ক্লাব জুভেন্টাসের ডাকে এক মৌসুম পরেই চাকরি ছেড়ে দেন।
প্রথম মৌসুমেই অবশ্য দলকে জিতিয়েছিলেন ইউরোপা লিগ। এটি ছিল চেলসির ক্লাব ইতিহাসে তৃতীয় ইউরোপিয়ান ট্রফি। প্রিমিয়ার লিগে চেলসিকে রেখেছিলেন চার নম্বরে।
সারি চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন চেলসি কিংবদন্তি মিডফিল্ডার ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। তার অধীনে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে নতুন ফুটবলারদের দলে ভিড়িয়েছিল ক্লাবটি।
কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয়ের পরও সাফল্য এনে দিতে পারেননি ল্যাম্পার্ড। প্রিমিয়ার লিগে দলের অবস্থান ঠেকেছিল নবম স্থানে। মৌসুমের মাঝপথেই চাকরি হারান ল্যাম্পার্ড।
মৌসুমের মাঝপথে চেলসির হাল ধরেন টমাস টুখেল। দলকে লিগ টেবিলের নবম স্থান থেকে তুলে নিয়ে চতুর্থ স্থানে। নিশ্চিত করেন পরবর্তী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা।
এছাড়াও টুখেলের জাদুর কাঠিতে বদলে যায় চেলসির ভাগ্যও। অর্ধেক মৌসুমে দায়িত্ব নিয়েই দলকে এনে চেলসির দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা।
আর পরের মৌসুমের শুরুতে চেলসির ট্রফি কেসে টমাস টুখেলে যুক্ত করেন উয়েফা সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপ। হয়তো দলকে প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ চারে রেখেই মৌসুম শেষ করবেন।
হয়তো টমাস টুখেলের অধীনে আরও ভালো করতে পারতো চেলসি। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের কারণে চেলসির উপর আসা নিষেধাজ্ঞার কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে ইংলিশ ক্লাবটি। তবে শেষ পর্যন্ত কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে ক্লাবটি। আর চেলসিতে টমাস টুখেলের নিজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মৌসুমেই শেষ হলো রোমান আব্রামোভিচের যুগ।
চেলসিতে রোমান আব্রামোভিচের ১৯ বছরের সময়কালে দায়িত্ব পালন করেছেন ১২ জন কোচ। ১২ জন কোচের মধ্যে চারজন কোচ দলকে এনে দিতে পারেননি কোনো শিরোপা। বাকি আট কোচের অধীনে এসেছে এক কিংবা একাধিক শিরোপা। রোমান আব্রামোভিচ দলের মালিকানায় আসার আগে চেলসির ট্রফি কেসে ছিল মাত্র ১৫ টি শিরোপা। আর রোমান আব্রামোভিচের এই সময়কালে চেলসি জিতেছে ২১ টি শিরোপা। নিশ্চিত করেই এই রাশিয়ান ধনকুবেরকে ছাড়া শূন্যতা অনুভব করবেন চেলসির সমর্থকরা।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর