রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপে চমক জাগিয়ে শিরোপা জিতেছিল ফ্রান্স। আর ফরাসিদের এই জয়ের সবচেয়ে বড় অবদান অভিবাসী ফুটবলারদের। তাদের কল্যাণেই দীর্ঘ দুই দশক পর বিশ্বসেরার মুকুট নিজেদের দখলে নিয়েছিল ফরাসিরা। কাতার বিশ্বকাপেও দেখা মিলতে পারে অভিবাসীদের জয়ধ্বনি। অবশ্য বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেই এক দফা নিজেদের জয়ধ্বনি শুনিয়েছেন অভিবাসী ফুটবলাররা। তাদের পায়ের জাদুতেই দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে দেখা মিলবে কানাডার নাম।
১৯৮৬ থেকে ২০২২, দীর্ঘ ৩৬ বারের পথচলায় আটবার বিশ্বকাপ খেলতে না পারার বেদনা সঙ্গী হয়েছে কানাডিয়ানদের। তবে নবমবারের চেষ্টায় সেই দূর্ভেদ্য বাছাইপর্ব পেরিয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ খেলবে কানাডা।
বিশ্বকাপ মঞ্চে কানাডার খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পিছনে কার অবদান বেশি? এই প্রশ্নের উত্তরে কোচ কিংবা ফুটবলারদের নামই উচ্চারিত হবে। কিন্তু এর আগে দেশটির অভিবাসন নীতিকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। তা না হলে যে, বিশ্বকাপ খেলতে পারার স্বপ্ন অধরাই থেকে যেতে পারতো।
১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের অধীনে অভিবাসীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ‘অপারেশন লাইফলাইন’ চালু করে কানাডা। সেই নীতিতে প্রায় তিন লাখ অভিবাসীকে নিজ দেশের নাগরিকত্ব দেয় উত্তর আমেরিকার এই দেশটি। এর সুফল পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ক্রীড়াক্ষেত্রে কানাডার উত্থানের গল্প শোনাচ্ছে এই অভিবাসীরাই। অন্যান্য খেলার মতো এবার সেই পথে যোগ দিয়েছে ফুটবলও।
কানাডা ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা আলফানসো ডেভিস। ২২ বছর বয়সী এই লেফট ব্যাক, নিজের সময়ের অন্যতম সেরা হিসেবেও বিবেচিত হন। তার মতো কানাডা জাতীয় দলের বেশিরভাগ ফুটবলারের পূর্ব পুরুষ এসেছেন অন্য দেশ থেকে। কানাডার অভিবাসী নীতিতে পেয়েছেন দেশটির নাগরিকত্ব। আর তাদের উত্তরসূরিরাই এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন কানাডার।
লাইবেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আলফানসো ডেভিসকে নিয়ে দেশটি ছেড়ে পালিয়ে আসেন তার বাবা-মা। ঘানা-আলবার্টা হয়ে তাদের ঠিকানা হয় কানাডা। স্বপ্নের দেশ কানাডাতে এসে নিজেকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলেন আলফানসো।
১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের সহযোগিতায় তিন লাখ অভিবাসীকে নিজ দেশের নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিল কানাডা। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০৬ সালে আড়াই লাখ অভিবাসীকে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিজ দেশের নাগরিকত্ব দেয় কানাডিয়ান সরকার। আর সেই সময়ই কানাডার নাগরিকত্ব পান আলফানসো ডেভিস এবং তার বাবা-মা।
একই রকম ঘটনা কানাডার গোলরক্ষক মিলান ব্রোজানেরও। আফ্রিকার কোন দেশ থেকে আসেননি ব্রোজান। লুকা মদ্রিচ-ইভান রাকিটিচদের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন কানাডায় পাড়ি জমান ব্রোজানের পরিবার। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়ার ব্রোজেন এখন কানাডার সেরা গোলরক্ষক।
কানাডার অধিনায়ক আতিবা হুচিনসন, স্যামুয়েল আবেকুগবে, আইকে উগবে, স্টিফেন এইসটাকুইও, রিচি লারেয়ার মতো সব তারকা ফুটবলারদের পরিবারই এসেছে অন্য কোনো দেশ থেকে। কানাডিয়ান অভিবাসী ফুটবলারদের বেশিরভাগই পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে পেয়েছেন দেশটির নাগরিকত্ব।
এতো অভিবাসীদের ভিড়ে কানাডিয়ান ফুটবলারদের ভুলে গেলেও চলবে না। তাদের ভিড়ে নিজেদের জাত চিনিয়েছেন লিয়ান ফ্রেসার, স্কট কেনেডি, ওয়েন হারগ্রেভস। তারা কেউই অভিবাসীদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত নন। বরং, কানাডার সামগ্রিক ফুটবল সাফল্যেই খুশি তারা।
দীর্ঘ ৩৬ বছর পর কানাডার বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন কোচ জন হার্ডমেন। এই ইংলিশ কোচ বারবারই জানিয়েছেন, কানাডাকে সাফল্যে এনে দিতে তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল অভিবাসী ফুটবলাররাই। শুধু ফুটবল নয়, কানাডার ক্রীড়া ক্ষেত্রের প্রায় পুরোটাই নিজেদের দখলে নিয়ে রেখেছেন এই অভিবাসীরাই।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, কানাডাজুড়ে অ্যাথলেট, কোচ এবং ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে নিয়োজিত আছেন প্রায় দুই হাজার ৮৫৫ জন। পাশাপাশি খেলাধুলার তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছেন ১৬ হাজার ৭৫ জন। কানাডার খেলাধুলার সাথে জড়িত ২০ শতাংশই অভিবাসী। যাদের হাত ধরেই কানাডা দেখছে নিয়মিত সাফল্য।
ফুটবলের বাইরে কানাডাকে অন্যান্য খেলাতে বড় সাফল্য এনে দিয়েছেন স্প্রিন্টার ডনোভান বেইলি। যিনি কি-না কানাডার হয়ে দুইবার অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছেন। এছাড়াও শীতপ্রধান কানাডাতে আইস হকির উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছেন জেরার্ল্ডিন হিনি। নর্থ আয়ারল্যান্ড থেকে কানাডায় এসে বসতি গড়েছিলেন এই অ্যাথলেট।
বিয়ানকা আন্দ্রেসকিউ, প্রথম কানাডিয়ান নারী হিসেবে জিতেছেন টেনিসের গ্র্যান্ডস্লাম শিরোপা। তার শরীরে বইছে ইউরোপিয়ান দেশ রোমানিয়ার রক্ত। টেনিসের আরেক কানাডিয়ান তারকা ডেনিস শাপোভোলভের পূর্ব পুরুষ এসেছে ইহুদি বেষ্টিত ইসরায়েল থেকে।
২৭ মার্চ, ২০২২ টরেন্টোর বিএমও স্টেডিয়ামে জ্যামাইকাকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ৩৬ বছর পর ফুটবলের বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের নিয়ে যায় কানাডা। এরপরেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই গেয়ে উঠে “ওহ! কানাডা”। বয়ে যায় খুশির জোয়ার।
ফুটবলের এই সাফল্যের পর, অনেক কানাডিয়ানই আর চান না অভিবাসীদের জন্য সীমিত করা হোক সুযোগ। কারণ স্থানীয়রা ভাবতে শুরু করেছেন অভিবাসীরা তাদের জন্য বোঝা নন, বরং বহির্বিশ্বে দেশের সাফল্যে রাখছেন ভূমিকা।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর