কাতার বিশ্বকাপের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে আগ্রহ আর উত্তেজনা। সবার চোখ ফুটবলের মহামঞ্চের মহারণে। ভাবনায় কেবল মেসির সেই জাদুকরী ড্রিবলিং, রোনালদোর দূর পাল্লার বুলেট শট কিংবা এমবাপের চিতার গতি। নেইমারেও স্বপ্ন দেখছেন ব্রাজিলিয়ানরা। সবার চোখ এদের দিকে ত্থাকলেও বিশ্বমঞ্চে ধ্রুবতারার মতো পায়ের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারেন কয়েকজন কিশোর।
কাতারের মাটিতে আলো ছড়াতে পারেন এমন দশ বিস্ময় কিশোরের দিকে চোখ রাখবো আমরা। এই তালিকায় পেদ্রি থেকে শুরু করে আছেন ‘মেক্সিকান মেসি’ও। আর কে কে আছে দেখে নেওয়া যাক।
ফেলিক্স আফেনা-গ্যান (ঘানা, ১৯ বছর)
বিশ্বকাপে বিস্ময়কর কিশোরদের একজন ফেলিক্স আফেনা গ্যান। বয়স মাত্র ১৮। অথচ এই বয়সেই জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেলেছেন দুটি ম্যাচ। মজার ব্যাপার হলো দেড় বছর আগেও স্কুল ফুটবল খেলতেন ফেলিক্স। আর এখন তিনিই কিনা ঘানার জার্সি গায়ে খেলবেন বিশ্বমঞ্চে। বিদ্যুৎ গতি, বল দখলের ক্ষমতা, দূর-পাল্লার বুলেট শটে বেশ পারদর্শী এই কিশোর।
ফেলিক্সকে নিয়ে ঘানার হেড কোচ অটো অ্যাডো বলেন ‘সে একটি হীরা। ওর বয়স মাত্র ১৯ বছর এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সে এত সৃজনশীল, তার ক্ষিপ্রতা দুর্দান্ত এবং রক্ষণাত্মকভাবেও সে তার সেরাটা দেয়।’
জুড বেলিংহাম (ইংল্যান্ড, ১৮ বছর)
জুড বেলিংহামকে তুলনা করা হয় প্যাট্রিক ভিয়েরা ও স্টিভেন জেরার্ডের সাথে। যারা গত ৩০ বছরে মাতিয়ে রেখেছিলেন ইংল্যান্ডের মাঝমাঠ। সেরা দুইজন মিডফিল্ডারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। রয় কিনও একাধিক অনুষ্ঠানে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মিডফিল্ডারের বেশ প্রশংসা করেছেন। ইংল্যান্ডের কোচ গ্যারেথ সাউথগেট বিশ্বাস করেন যে, মাঠের যেকোনো পাশেই দুর্দান্ত খেলতে পারবেন বেলিংহাম।
ইংল্যান্ডের ১৪০ বছরের ইতিহাসে বেলিংহাম একমাত্র খেলোয়াড় যে কিনা ১৭ বছর বয়সেই পুরো ৯০ মিনিট খেলেছেন। পরবর্তীতে তিনি উয়েফা ইউরোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। যদিও পরে পোল্যান্ডের ক্যাকপার কোজলোস্কি ছয় দিন পরই তার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন।
বেলিংহামকে নিয়ে রয় কিন বলেন, ‘এই ছেলেটা সবার জন্যই ভীতিকর। তিনি দেখতে একজন বক্সারের মত দেখতে। সে বেশ শক্তিশালী একটা ছেলে। গ্যারেথ অবশ্যই ওর যত্ন নিচ্ছে। ও একটি আশ্চর্যজনক প্রতিভা।’
মার্সেলো ফ্লোরেস (মেক্সিকো, ১৮বছর)
অনেকের শুনে আশ্চর্য লাগতে পারে যে, শীর্ষ কোনো ক্লাবের হয়ে এখনো মাঠে না নেমেও জাতীয় দলের হয়ে এক ম্যাচ খেলে ফেলেছেন ১৮ বছরের এক কিশোর। অবাক হলেও বাস্তব, এই কিশোরের নাম মার্সেলো ফ্লোরেস। কাতার বিশ্বকাপে মেক্সিকোর সবচেয়ে জুনিয়র খেলোয়াড়। তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে মেক্সিকো কোচ টাটা মার্টিনো তাকে উপাধী দিয়েছেন ‘এল জেফেসিটো’ বা ‘দ্য লিটল চিফ’।
মার্সেলোর ডাকনাম ‘মেক্সিকান মেসি’। ইতোমধ্যেই তার প্রতি নজর দিয়েছে বার্সেলোনা ও পিএসজি। মার্সেলোর লক্ষ্য সেরা খেলোয়াড় হওয়া। এই কিশোর বলেন ‘আমি বিশ্বকাপে ভালো করতে চাই। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হতে চাই।’
মার্সেলোকে নিয়ে মেক্সিকোর কোচ টাটা মার্টিনো বলেন, ‘সে একটি বিশাল প্রতিভা। সে খুব দক্ষ এবং সে সবসময় বল নিতে চায়। তার মতো খেলোয়াড় পাওয়া মেক্সিকানদের জন্য খুবই রোমাঞ্চকর।’
গাভি (স্পেন, ১৭ বছর)
স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার আঁতুড়ঘর লা মাসিয়ার কথা কারও অজানা নয়। মেসির মতো জাদুকর তো এখান থেকেই উঠে এসেছেন। গাভি লা মাসিয়ারই পণ্য। বয়স মাত্র ১৭। এই বয়সেই বলের উপর অনবদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যতিক্রমী পাসিং এবং ড্রিবলিং মিলিয়ে দুর্দান্ত এক প্যাকেজ হয়ে উঠছেন এই কিশোর।
এল ক্লাসিকোর ৮০ বছরের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় গাভি। ফেব্রুয়ারিতে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে গোল করে তিনি লা লিগায় গোল করা দ্বিতীয়কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হন। তার আগে আছেন রাউল।
গাভীকে নিয়ে স্পেনের কোচ লুইস এনরিক বলেন, ‘সে বেশ দর্শনীয়। সে এমনভাবে খেলে যে দেখলে মনে হয় স্কুলের উঠোনে বা বাড়ির উঠোনে খেলছে। সে জাতীয় দলের বর্তমান ও ভবিষ্যত।’
ইউনুস মুসা (আমেরিকা, ১৯ বছর)
ইউনুস মুসাকে ইংল্যান্ডের করে নিতে আবেদন করেছিলেন সাউথগেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে সায় দেয়নি। কেনই বা দিবে? স্বর্ণ হাত ছাড়া করতে চায় কে? যুক্তরাষ্ট্র দলের মিডফিল্ডের ডানদিকে কোচের ভরসা এই কিশোর। স্প্রিন্টারের মতো গতি আর বৈদ্যুতিক ঝলকের ড্রিবলিংয়ে ছিটকে ফেলতে পারেন যে কাউকে। চলতি বছরের মার্চে মেক্সিকোতে দুর্দান্ত খেলে দলকে এনে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের টিকিট।
তাকে নিয়ে আম্রিকার কোচ গ্রেগ বারহাল্টার বলেন, ‘ওকে থামানো যেকোনো দলের জন্যই বড় সমস্যা। সে প্রতিনিয়ত ডিফেন্সে ড্রাইভ করেন। সে খুব দ্রুত, চটপটে এবং বল তার পায়ের কাছে রাখে।’
জামাল মুসিয়ালা (জার্মানি, ১৯ বছর)
জার্মানি তাদের পাইপলাইন শক্তিশালী করতে কয়েক বছর ধরেই বয়সভিত্তিক দল থেকে খেলোয়াড় বাছাই করছিল। তাদের বাছাই করা জহুরি হলো জামাল মুসিয়ালা। দুর্দান্ত ড্রিবলিং, ক্লান্তিহীন খেলা কিংবা রাসিং শট মিলিয়ে বিশ্বকাপে দুর্দান্ত জার্মান মেশিন হয়ে উঠতে পারেন জামাল। মাঠের দুই পাশে মিডফিল্ডার দারুণ খেলেন তিনি। ইতোমধ্যেই বায়ার্ন মিউনিখের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন এই কিশোর।
জামালকে নিয়ে সাবেক জার্মান কোচ জুলিয়ান নাগেলসম্যান বলেন, ‘তার অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্দান্ত ফিনিশিং গুণ রয়েছে। বল ড্রিবলিংয়ে সে অবিশ্বাস্য আক্রমণাত্মক। তার একটি দারুণ ক্যারিয়ার রয়েছে।’
পেদ্রি (স্পেন, ১৯ বছর)
পেদ্রি সম্ভবত ফুটবলে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিশোর। দুর্বোধ্য ড্রিবলিং আর প্যালাশিয়াল পাসিং তাকে বার্সেলোনা এবং স্পেনের নায়ক করে তুলেছে। পেদ্রির বল দখলের ক্ষমতা ক্রমাগত তাকে লিওনেল মেসির মতো। অনেকে তাকে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার সাথেও তুলনা করে। পেদ্রি ১৮ বছর ২১৫ দিন বয়সে ইউরোতে ওয়েইন রুনির রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হওয়ার রেকর্ড গড়েন।
বার্সেলোনার কোচ জাভি পেদ্রিকে নিয়ে বলেন,’সে আমাকে অনেক আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা যদি একটি খাঁটি প্রতিভা সম্পর্কে কথা বলি, তবে পেদ্রি বিশ্বের সেরা।’
রিকার্ডো পেপি (আমেরিকা, ১৯ বছর)
যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন খেলোয়াড় হলেন রিকার্ডো পেপি। বল ধরে রাখতে, অন্যদের খেলায় আনতে বিরতিহীন চলতে তার জুরি মেলা ভার। বুন্দেসলিগায় অগসবার্গে তার সাম্প্রতিক পারফর্ম্যান্স তাকে বিশ্বকাপ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। সবাই আদর করে ডাকে ‘এল ট্রেন’ বা ‘দ্য ট্রেন’ বলে। সে কেন তবে থেমে থাকবে?
সাবেক আমেরিকান খেলোয়াড় হিথ পিয়ার্স বলেন, ‘রিকার্ডো পেপি সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা প্রাকৃতিক ফিনিশার। তার গোল লেভানডোভস্কির মতোই। সে পিচের সব জায়গা থেকে প্রতিটি উপায়ে গোল করে।’
লুকা রোমেরো (আর্জেন্টিনা, ১৭ বছর)
দশ বিস্ময় কিশোরের তালিকায় এখনো জাতীয় দলের জার্সিতে না খেলা একমাত্র খেলোপ্যাড় লুকা রোমেরো। ২০২০ সালেলাল লিগার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামেন রোমেরো। তার খেলা দেখে লিওনেল স্কালোনি তাকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে ডাকেন।
বাঁ-পায়ের দুর্দান্ত ড্রিবলিং আর পাসে অনবদ্য হয়ে উঠেছেন রোমেরো। তাকে প্রায় লিওনেল মেসির সাথে তুলনা করা হয়। গত মাসে আর্জেন্টিনার প্রশিক্ষণে দুর্দান্ত খেলে সবার নজর কেড়েছিল এই কিশোর। কাতারেও মেসিদের সাথে দেখা যাতে পারে এই কিশোরকে।
ফ্লোরিয়ান উইর্টজ (জার্মানি, ১৮ বছর)
বায়ার লেভারকুসেনে খেলা এই স্ট্রাইকারের স্বপ্ন বিশ্বকাপে খেলা। তার জন্য নিজেকে প্রমাণ করেছেন ফ্লোরিয়ান। তার খেলা দেখে জার্মানি কোচ হ্যান্সি ফ্লিক তাকে কাতারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
জার্মান কোচ হ্যান্সি ফ্লিক বলেন, ‘ফ্লোরিয়ান অসামান্য এক খেলোয়াড়। তিনি খেলতে ভালোবাসেন, খুব সৃজনশীল চিন্তাধারা তার। সে আমাদের জন্য পারফেক্ট প্যাকেজ হতে পারেন।’
স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি