ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) মানেই ভবিষ্যত তারাদের উত্থান মঞ্চ। প্রতি আসরেই নিজেদের ভবিষ্যত তারাদের খুঁজে পায় ভারত। ১৫তম আসরেও সেই একই পথে হাটছে আইপিএল। এবারের আসরে প্রথম নজর কাড়লেন আয়ুশ বাদোনি। নিজের আইপিএল অভিষেকে ৪১ বলে ৫৪ রানের ইনিংসে নজর কেড়েছেন ২২ বছর বয়সী এই তরুণ তুর্কি।
পারফর্ম করলে আইপিএল নাকি মুহুর্তেই ক্রিকেটারদের তারকাখ্যাতি এনে দেয়। এর প্রমাণ উমরান মালিক, চেতন সাকারিয়া আর টি নটরাজনরা। পারফর্মেন্সের জেরে তারকাখ্যাতি পাওয়া এইসব ক্রিকেটারদের পথেই হাটছেন আয়ুশ বাদোনি।
আইপিএলের ১৫তম আসরের মেগা নিলাম থেকে মাত্র ২০ লাখ রুপিতে অনভিজ্ঞ আয়ুশ বাদোনিকে দলে ভেড়ায় লক্ষ্মৌ সুপার জায়ান্টস। দল পাবেন কি না এই নিয়ে সন্দিহান থাকা আয়ুশ দলের অভিষেক ম্যাচেই খেলতে নামেন নিজের প্রথম আইপিএল ম্যাচ। আর প্রথম দিনই দলের বিপদের সময় মাঠে নেমে খেলেছেন ঝড়ো ইনিংস। প্রতিপক্ষ দলে থাকা রশিদ খান, লুকি ফার্গুসনরা যেন বনে গিয়েছিল পাড়ার ক্রিকেটের বোলার।
৪ দশমিক ২ ওভারে দলীয় ২৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে লাক্ষ্মৌ সুপার জায়ান্টস যখন ধুকছিল সেই সময় মাঠে আসেন আয়ুশ বাদোনি। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ৫ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে মাঠে নামা আয়ুশ প্রথম ম্যাচে কি করতে পারবেন তা নিয়ে কিছুটা হলেও সন্দিহান ছিল ক্রিকেট নেটিজেনরা। কিন্তু ক্রিকেট নেটিজেনদের সেই সমালোচনার কোনো সুযোগই দেননি আয়ুশ।
বরং অভিজ্ঞ দীপক হুদার সাথে ৬৮ বলে গড়েন ৮৭ রানের জুটি। যেখানে বাদোনি ৩০ বলে করেছিলেন ৩৫ রান। অবশ্য ইনিংসের শুরুর দিকে এতোটা বিধ্বংসী ছিলেন না আয়ুশ। প্রথম ২২ বলে তার ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১৩ রান।
এরপরেই শুরু হয় তার ব্যাটিং ঝড়! গুজরাট অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়ার কোটার শেষ ওভার থেকে ১৫ রান তুলে নেন। এই ওভারে তিনবার বল সীমানার ওপারে আছড়ে ফেলেন আয়ুশ। হার্দিকের পর টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ের শীর্ষ বোলার রশিদ খানকেও ছাড় দেননি। তার করা গুগলি বল স্লগ সুইপ করে গ্যালারিতে পাঠান।
ব্যক্তিগত ৪০ রানে থামতে পারতেন আয়ুশ। তবে ভাগ্যদেবতা এদিন তার পক্ষেই ছিল। লুকি ফার্গুসন ক্যাচ ছাড়লে বেঁচে যান তিনি। পরে অবশ্য এই কিউই বোলারকে ছক্কা হাকিয়ে অভিষেকেই হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন আয়ুশ বাদোনি।
আইপিএল ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক ম্যাচে ৬ বা তার নিচে নেমে হাফ সেঞ্চুরি করার রেকর্ড নিজের করে নেন আয়ুশ বাদোনি। শুধু তাই নয়, আইপিএলে তার চেয়ে কম বয়সে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন মাত্র দু’জন। তারা হলেন শ্রীবস্ত গোস্বামী এবং দেবদূত পাদ্দিকাল।
অভিষেকেই নজর কাড়া আয়ুশ ভারতে ঘরোয়া ক্রিকেটের খুব পরিচিত কোনো নাম না। দিল্লি রাজ্য দলের হয়ে মোশতাক আলি ট্রফিতে খেলেছেন মোটে পাঁচ ম্যাচ। যার মধ্যে চার ম্যাচেই আবার ব্যাট হাতে মাঠে নামার কোনো সুযোগই পাননি আয়ুশ। এক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে করেছিলেন মাত্র ৮ রান।
ভারতের ডোমেস্টিক সার্কিটের মতো দিল্লির রাজ্য ক্রিকেটেও অজানা এক নাম ছিলেন আয়ুশ বাদোনি। এরপরেও তাকে দলে নিয়ে আসার কৃতিত্ব লাক্ষ্মৌ সুপার জায়ান্টসের মেন্টর গৌতম গম্ভীরের। শুধু দলে নিয়ে আসেননি প্রথম ম্যাচে আয়ুশ বাদোনিকে প্রথম ম্যাচে সুযোগও দিয়েছেন গৌতম গম্ভীর। অভয় দিয়েছিলেন প্রথম ম্যাচে ব্যর্থ হলেই তাকে একাদশের বাইরে নিবেন না। সেই সাহসেই প্রথম ম্যাচেই চিনিয়েছেন নিজের জাত।
আইপিএলের ১৫তম আসরের মেগা নিলামের আগে আরও দুইবার নিজের নাম নিলামে তুলেছেন তার নাম থাকলেও তাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো দলই। নিলামে দল না পাওয়ার পর কয়েকটি আইপিএলের দলে ট্রায়ালও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পছন্দ করেনি কোনো দল। শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যের শিকে ছিড়েছে লাক্ষ্মৌ সুপার জায়ান্টসে।
আইপিএলের আগে লাক্ষ্মৌ দলে যোগ দিয়ে অবশ্য নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন আয়ুশ বাদোনি। দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচেই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন এই তরুণ তুর্কি। আর সেই দারুণ পারফর্মেন্সের কারণেই তাকে একাদশে খেলানোর ঝুঁকি নেয় ফ্রাঞ্চাইজিটি। শুধু তাই নয়, ঝড়ো ব্যাটিংয়ে অভিজ্ঞ ক্রুনাল পান্ডিয়ার আগে তাকে ক্রিজে পাঠিয়েছিল লাক্ষ্মৌ টিম ম্যানেজমেন্ট। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন।
ভারতীয় ক্রিকেটে এই প্রথমবারের মতো অবশ্য আলোড়ন তোলেননি আয়ুশ। এর আগে ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের আলোড়ন তুলেছিলেন। সেবার যুব এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ২৮ বলে ৫২ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন বাদোনি। এই পারফর্মেন্সে নজর কেড়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়ের। তবুও নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে খেলতে যেতে পারেননি বাদোনি।
যুব বিশ্বকাপে যেতে না পারার ব্যর্থতার পর নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন। প্রাথমিক স্কোয়াডে থাকলেও বার বারই তাকে ফেরত পাঠিয়েছিল দিল্লি দল। শেষ পর্যন্ত ২০২১ সৈয়দ মোশতাক আলি ট্রফিতে দিল্লির হয়ে তার অভিষেক ঘটে। তবে অভিষেকের পর পাঁচ ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন আর ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন এক ম্যাচে। সুযোগ পেয়ে অবশ্য ৮ রানের বেশি করতে পারেননি।
দিল্লির স্বনামধন্য কোচ তরক সিনহার কাছে ক্রিকেট দীক্ষা তার। বলা হয়, দিল্লির ক্লাব ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তরক সিনহার। আর সেই গুরুর শিষ্য হয়েও দিল্লি দল তাকে বারবার উপেক্ষা করেছে।
গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে দারুণ এই ইনিংসের পর নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব পুরোটাই টিম ম্যানেজমেন্টের উপরই দিয়েছেন আয়ুশ বাদোনি। বলেন, ‘গৌতম (গম্ভীর) ভাই আমাকে সমর্থন দিয়েছে। সে আমাকে বলেছে নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে। বলেছে, দলের পরিস্থিত অনুযায়ী খেলার দরকার নাই। এ জন্য সিনিয়র ক্রিকেটাররা আছে।’
অভিষেক ম্যাচে মাঠে নামার আগে বেশ ভীত ছিলেন আয়ুশ বাদোনি। জানান তার সেই অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, ‘কালকে (ম্যাচের আগের দিন) রাতে ঘুমাতে পারিনি। মাঠে নামার সময়ও বেশ ভয় লাগছিলো। মাঠে নামার পর প্রথম চার মারার পর আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। মনে হয়েছে, আমি পারি এবং যোগ্য।’
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর