তারুণ্যের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়ের গল্প

আরিফুল হক বিজয় আরিফুল হক বিজয় প্রকাশিত: ০৬:১৭ পিএম, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২
তারুণ্যের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়ের গল্প

‘ফাইনাল’ শব্দটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাছে এক দুঃস্বপ্নের নাম। হোক সেটা এশিয়া কাপ, তিনজাতির টুর্নামেন্ট কিংবা কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট। মোটকথা, ফাইনাল নামটা শুনলেই কি এক অজানা ভয় এসে ভর করতো আমাদের ভেতরে, বাহিরে কিংবা সবটা জুড়েই। আমরা সমর্থকরাও তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে থাকতাম মরুর বুঁকে এক ফোটা জলের আশায়। যার শীতলতা ছোট্ট এই দেশটার অনাচে কানাচে হয়ে ছড়িয়ে যাবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার সীমান্ত প্রান্তরে।

কে ছড়িয়ে দিবে সেই শীতলতার পরশ? এই প্রশ্নের জবাবে ভয়ডরহীন মনোভাব নিয়ে হাজির হলো আমাদের ক্রিকেটের একটা প্রজন্ম। সবে কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যেয় পা দেয়া একদল তরুণ। এ দেশের বুঁকে যারা ছড়িয়ে দিলো উনিশের জয়গান। এরা কি পারে না? প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে বারুদ ঢেলে দেয় বাইশগজে, রূপকথার স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তীব্র হুংকারে, শিরায় উপশিরায় টগবগ রক্ত রেখে ঠান্ডা মাথায় হাসিমুখে খুন করতে পারে প্রতিপক্ষকে। এক অদম্য দুর্দমনীয় প্রজন্ম!

sportsmail24শুরুটা হয়েছিল এভাবেই গর্জন তুলে

ক্রিকেট নামক বাইশগজের খেলাটাকে ভালোবেসে অসংখ্য বসন্তের জীবনে কত হেসেছি, কত কেঁদেছি আমরা। স্বপ্নও দেখা তবু ছাড়িনি। অতঃপর সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়ে গেলো এই দলটা। যা পারেনি এই দেশটার ক্রিকেট ইতিহাসে কেউ সেটাই করে দেখিয়েছে কৈশোর পেরোনো ফিনিক্স পাখির দল। প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে দুরন্ত গতিতে মাঠে নেমে গেলো কেউ। বিপদেও দাঁত বের করে হেসে ঠান্ডা মাথায় স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেললেন দলনেতা। এ দেশের বুঁকে উনিশ এসেছিল বলে!

দক্ষিন আফ্রিকার পচেফস্ট্রুম। ফ্লাডলাইটের আলোতে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু কণাগুলোকে রঙ্গিন শিশিরবিন্দু মনে হচ্ছিলো। ঐদিকে অধরা এক স্বপ্নকে রঙ্গিন করতে বাইশগজের সবুজের ক্যানভাসে ব্যাট নামক তুলি হাতে দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুই চিত্রকর। চোখে স্বপ্ন, বুকে সাহস, তবুও দ্বিধা!

বল করলেন ভারতীয় অফস্পিনার অথর্ব অ্যাংকলেকার। কিছুটা বেরিয়ে এসে সেই বলকে ব্যাটের নিপুণ ছোঁয়ায় মাঠের ডিপ মিড অংশ দিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দিলেন রাকিবুল ইসলাম। ব্যস! অন্যপ্রান্তে গ্লাভসে মুষ্টিবদ্ধ হাত সাঁই করে আকাশে ছুঁড়ে দিলেন আরেকজন। স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দে তখন যেনো আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে চাচ্ছেন। ছেলেট্টার নাম আকবর আলী চৌধুরী। এতক্ষণ ধৈর্য্য নিয়ে নিপুণ কায়দায় বাইশগজের ক্যানভাসে চিত্র এঁকে যাওয়া লাল সবুজের ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’।

sportsmail24বিজয়ের উল্লাসে নায়ক আকবর ও পার্শ্বনায়ক রাকিবুল

উপরের কথাগুলো কোনো মোটেও কল্পনা কিংবা খ্যাতনামা কোনো চিত্রকরের শিল্পকর্ম নয়। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা প্রজন্মের বিশ্বজয়ের গল্পের অংশ মাত্র। যা পারেননি বাংলাদেশ ক্রিকেটের শুরুর সারথী মুশফিকুর রহিম থেকে শুরু করে হালের মেহেদী হাসান মিরাজরা। বারবার হোঁচট খেয়েছেন বড় ম্যাচের আতংক 'নার্ভাসনেস' নামক শব্দটার কাছে।

এই নার্ভাসনেসের জন্যই পূরণ হয়নি একটা স্বপ্ন, ছোঁয়া হয়নি একটা সোনালী ট্রফি। অথচ পৌছে গিয়েছিলেন কত কাছে, তবুও ফিরতে হয়েছে ব্যথাতুর হৃদয়ে শূন্য হাতে।এশিয়া কাপ, নিদাহাস ট্রফি, কোনো বড় টুর্নামেন্ট; স্বপ্নটা বারবার নিয়ে গেছে ট্রফি ছুঁয়ে দেখার মঞ্চগুলোর একদম কাছে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার আগেই বিধাতার গল্পে যে লেখা হয়ে গেছে একটা শব্দ 'চির অধরা'!

sportsmail24এই হুঙ্কারের জবাব ছিলো না ভারতীয়দের যুবাদের কাছে

অধরার ভয়টা সেবারও ছিলো! সবই ঊড়িয়ে দিয়েছেন আকবর আলী-মাহমুদুল হাসান জয়রা। বলের আগুনের সাথে চোখে চোখ রেখে আরেক দফা আগুন ছুঁড়েছেন শরিফুল-সাকিবরা, ফিল্ডিংয়ে বাঁজপাখি হয়ে গিয়েছেন জয়-ইমনরা। ঠান্ডা মাথায় চাপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন স্বয়ং দলনেতা আকবর আলী। এই দলটার জন্যই সুকান্ত ভট্টাচার্য্য লিখে গেছেন 'আঠারো বছর বয়স'র কথা।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয় জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ আকবরকে। অল্প বয়সে সিংহাসনে বসা, দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতা মিলিয়ে নিজেকে তিনি চিনিয়েছেন অন্যভাবে। ইতিহাসের পাতায় আজও তিনি 'আকবর দ্য গ্রেট'। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের আকবরও নিজের নাম দিয়েছিল 'আকবর দ্য গ্রেট'। গ্রেট হতে চাওয়ার অদম্য বাসনা থেকেই ছেলেটা যে এই নাম সেটা কেইবা জানতো? জানা হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় পচেফস্ট্রুমের সন্ধ্যায়।

sportsmail24ভারত জয়ের শিরোপা হাতে 'আকবর দ্য গ্রেট'

অল্প টার্গেট, জয় নিশ্চিত। অথচ একটা সময় এসে সেটাকেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলো বাংলাদেশের যুবারা।রণাঙ্গনে নামলেন দলপতি! বাকি পথটা তার লড়াই। আহত এক সৈন্যকে নিয়ে সেনাপতির লড়াই। যত চাপ, ভয়, সংশয় সময়ের সাথে সব উড়িয়ে দিতে থাকলেন ব্যাটের সপাট আঘাতে। এ যেন চির মহান সম্রাট আকবর আবার ফিরে এসেছেন ভারতবর্ষের দুঃস্বপ্ন হয়ে।

সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল পচেফস্ট্রুমে, ফ্লাডলাইটের আলোয় চিকচিক করছিল বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিকণা। তাতে সোনালী ট্রফিটা জ্বলমলে আলো ছড়িয়ে হয়ে উঠলো সুন্দর থেকে সুন্দরতম। প্রথম বৈশ্বিক কোনো শিরোপার সোনালী সুন্দর সেই রং পচেফস্ট্রুম থেকে ছড়িয়ে পড়লো হাজার মাইল দূরের এই বাংলার প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। আঠারো পেরিয়ে সেই উনিশের বারুদঠাসা বিশ্বজয়ের গল্পে আরেকবার বিশ্ব চিনে নিলো লাল সবুজের ছোট্ট এই দেশটাকে। দুর্দমনীয় সোনালী এক প্রজন্মকে।

স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি

[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ‘পাঁচ’ বিদেশি ক্রিকেটার

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ‘পাঁচ’ বিদেশি ক্রিকেটার

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট : গল্পটা লাল-সবুজের জয়িতাদের

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট : গল্পটা লাল-সবুজের জয়িতাদের

এবি ডি ভিলিয়ার্স : বাইশগজের ‘দুঃখী রাজপুত্র’

এবি ডি ভিলিয়ার্স : বাইশগজের ‘দুঃখী রাজপুত্র’