আমরা সবাই সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে এতোদিন পড়ে আসছি, চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদী। একই উপমায় যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটকে টেনে আনি তবে প্রশ্নটা কি দাঁড়াবে? বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃখ ‘শেষ বল’। আমাদের ক্রিকেটে এই শেষ বল নিয়ে রীতিমতো একটা দুঃখবিলাসের কাব্য লিখে ফেলা যাবে।
এই দুঃখবিলাসের গল্পে বিশাল একটা জায়গা দখল করে আছে ‘এশিয়া কাপ’। এই এক আসরেই তিন তিনবার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে আমাদের। বেদনার দীর্ঘশ্বাস মিরপুর ছাড়িয়ে পৌছে গেছে বাংলার অজস্র সীমানা প্রান্তরে। বসন্তের দীঘল বাতাসে ঝরা পাতার মতো হু হু করে কাঁদিয়ে গেছে প্রত্যেকটা বাঙ্গালীর অন্তর।
শুধু এশিয়ার আসরই নয়। শেষ বলে হৃদয় ভাঙ্গার গল্পের তালিকাটা খানিকটা দীর্ঘ। এই তালিকায় চোখ রাখলে দেখা মিলবে আন্তর্জাতিক ম্যাচেও শেষ বলে পরাজয়ের উপাখ্যান। তবে আরেকবার দেখে নেই।
৫. এশিয়া কাপ ফাইনাল (২০১২) বনাম পাকিস্তান
২০১২ সালে এশিয়া কাপের আসর বসেছিল ঢাকায়। এই আসরে শুরু থেকেই দুর্দান্তভাবে ছুটতে থাকে টাইগাররা। ভারত এবং শ্রীলঙ্কার মতো এশিয়ার দুই পরাশক্তিকে হারিয়ে ফাইনাল খেলাটা চাট্টিখানি কথা নয়। তদুপরি সে সময় ভারত-শ্রীলঙ্কা সোনালী সময়ের একঝাঁক তারকা ঠাসা দল। ভারতের শচীন থেকে শুরু করে লঙ্কানত্রয়ী ‘দিলশান-জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা’ সবাই ই ছিল। এদের ছাপিয়ে ফাইনালের মঞ্চে উপনীত হয় বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ হিসাবে পেয়েছিল পাকিস্তানকে। এরপরের দৃশ্যপটটা খুব সুখকর নয়!
২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালের পর সাকিবদের কান্না
ফাইনালে তামিম ও সাকিবের হাফসেঞ্চুরিতে জয়ের পথেই ছিল বাংলাদেশ। তবে এই পথে খানিকটা কাঁটা রেখে গিয়েছিলেন নাজিমউদিন। আর তাতেই শেষ ওভারে এসে বিদ্ধ হলো টাইগাররা। শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল সাত রান। সাতটি রান অথচ কত দীর্ঘ পথ। সেই পথের ক্লান্ত পথিক হয়ে রইলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। নিতে পারলেন কেবল পাঁচ রান। তাতেই রচিত হলো বেদনার এক মহাকাব্য। সাকিবকে জড়িয়ে ধরে মুশফিকের সেই কান্না আজও হয়ে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিক দৃশ্য!
৪. টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ (সুপার টেন, ২০১৬) বনাম ভারত
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে হাস্যকর এবং নিদারুণ পরাজয়ের তালিকায় এই ম্যাচটাও গেঁথে থাকবে সবার অন্তরে। ম্যাচ জেতার আগেই মুশফিকুর রহিমের সেই বুনো উল্লাস কিংবা চতুর ভারতীয় দলনেতা ধোনীর লোভের ফাঁদে পরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের আত্মহুতি। সবই মুখে মুখে গল্পের মতো রয়ে গেছে।
মুশফিক রিয়াদের বোকামির পর ভারতের বিজয় উল্লাস
শেষ ওভারে বাংলাদেশের জেতার জন্য দরকার ছিল ১১ রান। উইকেটে দুই পরীক্ষিত ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বোলিংয়ে হার্দিক পান্ডিয়া। তখন খুব আহামরি কিছু ছিলেন না হার্দিক। মুখোমুখি হও্য়া হার্দিকের দুই বলে টানা দুটি চার হাঁকালেন মুশফিক। এরপরই শুরু করলেন উল্লাস। অথচ তখনো জিততে দরকার ২ রান। আনন্দের অতিশায্য হোক আর যাই হোক, পরের তিন বলে একটি রানও নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আর তাতেই রচিত হলো শেষ বলে হারের আরেকটি করুণ গল্প।
৩. শেষ ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি সিরিজ (২০১৮) বনাম আফগানিস্তান
আফগানিস্তান তখন বিশ্ব ক্রিকেটে এশিয়ার পরাশক্তি হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে। সেই বছরের শুরুতে তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে বাংলাদেশকে হারিয়ে চমকে দেয় তারা। তৃতীয় ম্যাচে লজ্জাজনক হোয়াইটওয়াশ এড়াতে মাঠে নামে বাংলাদেশ। অথচ রচিত হলো শেষ বলে আরেকটি পরাজয়!
বাংলাদেশকে প্রথমবার ধবল্ধোলাই করার পর আফগানদের উল্লাস
শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৯ রান। বল করতে আসেন রশিদ খান। তার প্রথম বলে আউট হয়ে ফিরে যান মুশফিক। ৫ বলে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৯। এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে কেবল ৭ রানই তুলতে পারেন রিয়াদ আর আরিফুল। তাতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের কাছে হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ।
২. নিদাহাস ট্রফি ফাইনাল (২০১৮) বনাম ভারত
শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা দিবস হিসাবে তিন দেশ নিয়ে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল নিদাহাস ট্রফি। স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালের মঞ্চে উপনীত হয় বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ ভারত। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের হিসাব চুকিয়ে দেয়ার মোক্ষম সুযোগ। ২০ ওভারে ১৬৬ রানের সংগ্রহও দাঁড় করিয়েছিল টাইগাররা।
নিদাহাস ট্রফিতে ভারতের উল্লাস, বাংলাদেশের সব হারানোর বেদনা
জবাব দিতে নেমে শেষ দুই ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ৩৪ রান। কিন্তু ১৯তম ওভারে ২২ রান দিয়ে কার্যত ম্যাচটাই ভারতের হাতে তুলে দেন রুবেল হোসেন। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিলো ৬ বলে ১২ রান। সৌম্য সরকার চেষ্টাটাই করেছিলেন কেবল। ম্যাচটি নিয়ে এসেছিলেন শেষ বলে। সমীকরণ দাঁড়ায় ১ বলে ৫ রান! দীনেশ কার্তিক যখন ছক্কা মেরে সমীকরণের সমাধান করে ফেলেছেন, জায়ান্ট স্ক্রীণে ভেসে উঠেছিল সাকিবের সেই হতাশামাখা মুখ। যার অর্থ বাংলাদেশ ক্রিকেটে আর কোনো রূপকথা নেই।
১. এশিয়া কাপ ফাইনাল (২০১৮) বনাম ভারত
আরেকটি ফাইনাল এবং আরেকবার ভারত। একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘দানে দানে তিন দান’। এই ম্যাচে তিন দানই পূর্ন করলো ভারত। অথচ লিটনের সেঞ্চুরির পর বড় রানের স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ। মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় সেই রান টেনেটুনে কোন রকমে দুইশো‘র (২২২) ঘর পার করে টাইগাররা।
২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে আরেকবার পরাজয়
৫০ ওভারে ২২৩ রান। খুব কঠিন কিছু না। আর দলটা যেহেতু ভারত, সুতরাং ডাল ভাতের মতোই ব্যাপার। কিন্তু সেটা হতে দিলেন না মাশরাফি নামের লোকটা। বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্বে ম্যাচ নিয়ে গেলেন শেষ ওভারে। ৬ বলে ৬ রানের মাপা হিসাব। বল হাতে অফস্পিনার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। রিয়াদ ছয়টি বল করলেন বটে! তাতে শেষ বলে সমীকরণ দাঁড়ালো ১। লেগবাইতে ১ রান তুলে নিয়ে আরেকবার বাংলাদেশকে শেষ বলের বিষাদ উপহার দিলেন কেদার যাদব।
স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি
[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]