পঞ্চমবারের মতো যুব বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলেছে ভারতীয় দল। ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ পারফর্ম করে নজর কেড়েছেন ভারতীয় অলরাউন্ডার রাজ বাওয়া। ইংল্যান্ডকে হারাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনিই। এরপর থেকেই তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে হৈচৈ। পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়েই এসেছিলেন ক্রিকেটে, মান রেখেছেন নিজের পরিবারের।
পাহাড় ঘেরা হিমাচল প্রদেশের শহর ধর্মশালা থেকে আসা এক ক্রিকেটার রাজ বাওয়া। অন্যদের মতো ক্রিকেটের জন্য তাকে পোড়াতে হয়নি অনেক কাঠ-খড়। বরং, খেলাধুলায় পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিলেন। আর ভালোভাবেই সেই চ্যালেঞ্জ উতরে গিয়েছেন রাজ আঙ্গদ বাওয়া।
১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিক দিকে একটু নজর ফেরানো যাক, গ্রেট বৃটেনকে হারিয়ে হকিতে স্বর্ণপদক জিতেছে ভারত। ভারতের হয়ে জয়সূচক গোলটি করেছিলেন টারলোচান বাওয়া। তার গোলেই অলিম্পিক মঞ্চে বেজেছিল ভারতের জাতীয় সঙ্গীত।
ভাবতে পারেন, রাজ পাওয়ার উত্থান গল্প বলতে ৭৪ বছর আগের অলিম্পিকে ভারতের স্বর্ণপদক জয়ের ঘটনা টেনে আনাটা অপ্রাসঙ্গিক। না, মোটেও অপ্রাসঙ্গিক বা ভিত্তিহীন নয়। ভারতকে স্বর্ণপদক জেতানো টারলোচান বাওয়া যে রাজ বাওয়ার দাদা।
ক্যারিবিয়ানে যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে বল হাতে ইংলিশদের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়া রাজ বাওয়া শুধু তার দাদার গল্পটার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। সেদিন দাদা টারলোচান বাওয়া, ইংলিশদের স্বপ্ন ভেঙেছিলেন। ৭৪ বছর পর একই কাজ করেছেন নাতি রাজ আঙ্গদ বাওয়া। বল হাতে পাঁচ উইকেট আর ব্যাট হাতে ৩৫ রান, এতেই ফাইনালের নায়ক হয়েছেন হিমাচলের এই তরুণ।
অথচ ইংলিশদের আশাহত করা রাজ আঙ্গদ বাওয়ার নাকি শুরুর দিকে ক্রিকেটের প্রতি মনোযোগই ছিল না। তার ধ্যান ধারনা জুড়ে ছিল পাঞ্জাবি গান এবং নাচ। কিন্তু ১১-১২ বছর বয়সে হঠাৎই বদলে যেতে থাকে তার ধ্যান-ধারণা, নাম লেখান ক্রিকেটে।
ক্রিকেটে নাম লেখালেও ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না রাজ বাওয়া। বরং নিজের মনের আনন্দের খোরাক যোগানোর জন্য ক্রিকেট খেলতেন তিনি। ক্রিকেটার হওয়ার জন্য ক্রিকেট খেলার চর্চার শুরু আরও বছর দুয়েক পরে।
তার আগে পরিচয় হওয়া যাক, রাজ বাওয়ার বাবা সুখিন্দর বাওয়ার সাথে। বাবা টারলোচান বাওয়ার মতো খেলাধুলাকেই জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সুখিন্দর। ক্রিকেট এবং হকি দুইটাই খেলতেন। তবে শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার হিসেবে ক্রিকেটকেই বেছে নিয়েছিলেন সুখিন্দর।
ক্রিকেটকে হিসেবে বেছে নিলেও বড় করতে পারেননি ক্যারিয়ার। বাদ সেধেছিল ইনজুরি, আগায়নি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার। বরং খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনে কম বয়সেই নাম লিখিয়েছিলেন কোচিং পেশায়। ক্রিকেটার হিসেবে নাম না হলেও কোচ হিসেবে তিনি একজন কিংবদন্তিতুল্য। সুখিন্দরের শিষ্য ছিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং।
জাতীয় দলে না খেললেও বয়সভিত্তিক দলে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সুখিন্দর বাওয়া। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম যুব বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের প্রতিনিধি ছিলেন।
রাজ বাওয়ার গল্পে ফেরা যাক। ক্রিকেট খেললেও আগে কখনই বাবার সাথে স্টেডিয়ামে যাননি ছেলে রাজ বাওয়া। এ কারণেই একদিন ছেলেকে সাথে করে ধর্মশালায় খেলা দেখতে যান সুখিন্দর বাওয়া। এরপর থেকেই বাবার সাথে নিয়মিতই স্টেডিয়ামে যাতায়াত শুরু করেন। এতেই বদলে যায় রাজ বাওয়ার জীবনের মোড়। বাবাকে জানিয়ে দেন, ক্রিকেটেই নিজের ভবিষ্যত গড়তে চান তিনি। ক্রিকেট কোচ বাবাও হতাশ করেননি রাজকে। ক্রিকেটার হওয়ার জন্য পূর্ণ সমর্থন করতে থাকেন।
ভারতের যুব দলে রাজ বাওয়া ডাক পেয়েছিলেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে। কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রাজকে তার বাবা বলেছিলেন ব্যাটার হতে, সাথে ডানহাতি অফ স্পিন করবেন। হবেন একজন স্পিনিং অলরাউন্ডার। বাবার কথা মেনেও ছিলেন রাজ বাওয়া। ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যাট হাতে রানের ফুলঝুড়ি ফুটিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎই সিদ্ধান্ত বদল করে বসেন রাজ। জানান, পেস বোলিংয়ে মনযোগী হবেন।
বাবা সুখিন্দর সিং এতে আর না করেননি। ছেলের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। ছেলেকে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেন। রাজ বাওয়াও দেখাতে থাকেন নিজের ক্রিকেটীয় প্রতিভা।
শুধু ক্রিকেট নয়, পড়াশুনাতেও বেশ নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন রাজ। মাধ্যমিকের গন্ডি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে সব সময় প্রথম সারির ছাত্রদের তালিকায় ছিলেন রাজ বাওয়া।
স্কুল শেষে বাবার ক্রিকেট একাডেমিতে নিজের কিট বাক্স নিয়ে খেলতে যেতেন রাজ। সেখানেই দেখা হয় ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডার যুবরাজ সিংয়ের সাথে।
নিজের খারাপ সময়ে সবসময়ই সুখিন্দর বাওয়ার শরণাপন্ন হতেন যুবরাজ। সেখানেই সুখিন্দরের অন্য ছাত্রদের মতো রাজও পান যুবরাজের সান্নিধ্য।
তখন থেকেই ভারতের যুবরাজের অনেক বড় ভক্ত হয়ে উঠেন রাজ বাওয়া। শুধু তাই নয়, যুবরাজের দ্বারা এতটাই বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, ডানহাতি ব্যাটিং ছেড়ে বামহাতে ব্যাট করা শুরু করেন রাজ। ক্যারিয়ারে পরে অবশ্য বাঁহাতি ব্যাটার হয়েই উঠেছেন।
ভারতীয় যুব দলে সুযোগ পেয়ে বেঁছে নিয়েছেন ১২ নম্বর জার্সি। কারণ, নিজের আইডল যুবরাজও সিংও যে পড়তেন ১২ নম্বর জার্সি।
২০১১ সালে দীর্ঘ ২৮ বছর অপেক্ষার পর ভারতকে ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্বাদ দিয়ছিলেন যুবরাজ সিং। এত বছর অপেক্ষা নয়, তবে রাজের দূর্দান্ত অলরাউন্ড পারফর্ম্যান্সে রেকর্ড পঞ্চমবারের মতো শিরোপা জিতেছে ভারতীয় যুবারা। ঠিক যেন নিজের আইডলকেই অনুসরণ করে সামনের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন রাজ বাওয়া। হয়তো জাতীয় দলেও নিজেকে এইভাবেই প্রমাণ করবেন।
যুব বিশ্বকাপের ফাইনাল মঞ্চে পারফর্ম করলেও এখনও নিজের ছেলে প্রস্তুত ভাবছেন না সুখিন্দর বাওয়া। তিনি জানান, রাজকে করতে হবে আরও পরিশ্রম। শুধু তাই নয়, বলের গতি বাঁড়াতে গিয়ে যেন খেই হারিয়ে না ফেলেন সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে চান সুখিন্দর।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করতে চাই, কম বয়সেই যেন ওর শরীরের উপর যেন অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। তাকে বলের গতি বাঁড়াতে হবে আর সে যেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলতে পারে।’
বিশ্বকাপ জয়ের সাথে সাথেই ছেলেকে জাতীয় দলের মতো বড় মঞ্চে দেখতে চান না সুখিন্দর বাওয়া। বরং ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) কিংবা রঞ্জি ট্রফিতে পারফর্ম করলে তবেই জাতীয় দলের জার্সিতে ছেলেকে দেখতে চান।
বলেন, ‘ও (রাজ বাওয়া) জানে জাতীয় দলে খেলা সবারই লক্ষ্য। তবে আইপিএল এবং রঞ্জিতে পারফর্ম করে তবেই জাতীয় দলে খেলুক সে। এর আগে নয়।’
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর
[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]