২০১৮ সালের জুন মাসের ১০ তারিখ। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিনারা একাডেমি ওভাল। নারীদের এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির ফাইনালের মহারণ। নারী ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ! হ্যাঁ, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। বাংলাদেশের নাম শুনে যে কারোরই চমকে ওঠার কথা।
তখন নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা সুখকর নয়। সেই দলটাই ফাইনালের মঞ্চে! যাক, ঐ মঞ্চ অবধিই। ট্রফিটা তো আর ছোঁয়া হবে না। কারন প্রতিপক্ষ দলটা যে ভারত! অথচ হিসাবের খাতাও মাঝেমধ্যে গড়মিল হয়, পাশার দানও উল্টে যায়। কত অসম্ভবও সম্ভব হয় প্রকৃতির নিয়মে। হলোও তাই!
বাংলাদেশের ইনিংসের উনিশতম ওভারের শেষ বল। আগের বলেই আউট হয়ে গেছেন এতোক্ষণ আশার আলো জ্বালিয়ে রাখা অলরাউন্ডার রুমানা আহমেদ। শেষ বলে প্রয়োজন দাঁড়ায় ২ রান। বোলিং প্রান্তে ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রীত কর। ব্যাট হাতে স্ট্রাইক প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জাহানারা আলম।
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা সাফল্য এশিয়া কাপ জয়
বল করলেন হারমানপ্রীত, সপাটে ব্যাট চালালেন জাহানারা। বল ছুঁটছে ডিপ মিডের দিকে, জাহানারা ছুটছেন স্বপ্ন ছোঁয়ার দিকে। অপরপ্রান্ত থেকে সাঁই সাঁই করে এ প্রান্তে ছুটছেন অধিনায়ক সালমা খাতুন। বল কুড়িয়ে সজোরে থ্রো করলেন ভারতীয় ফিল্ডার। বিধিবাম! নার্ভারনেসে আটকে গেলেন ভারতীয় কিপার তানিয়া। ততোক্ষণে দুইবার প্রান্ত বদল করে ফেলছেন দুই বাংলাদেশী ব্যাটার। এরপর ইতিহাস।
ইতিহাস গড়ার আনন্দে দুই হাত মেলে ভোঁ দৌড় দিলেন জাহানারা। ডাগআউট থেকে ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসছেন বাকিরা। একসাথে উল্লাসে মেতে উঠলো বাঘিনীর দল। সেই দৃশ্য টিভির ফ্রেমের গন্ডি ছাড়িয়ে পৌছে গেলো ৬৪ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট ভূ-খন্ড বাংলাদেশে। এশিয়া জয়ের আনন্দ কাঁপিয়ে দিয়ে গেল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর কোনো বড় কোনো ট্রফি লাল সবুজের ঘরে আসলো। যে ট্রফি হয়ে গিয়েছিল দূর আকাশের তারা, সে ট্রফি ছুঁয়েছেন সালমারা, আমাদের জয়িতারা।
এশিয়া কাপ জিতে দেশে ফেরার পর বরণ করে নেয়া হয় নারী ক্রিকেট দলকে
যাদের হাত ধরে এই আনন্দের ফোয়ারা তাদের এই পর্যন্ত আসার রাস্তাটা ঠিক কেমন ছিলো? মোটেই মসৃণ নয় বরং কন্টকপূর্ন পথ ধরে এগিয়েছেন। অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলেছেন। দেশের প্রতিনিধিত্ব করা একদল নারী হয়েও নিশ্চয়তা পাননি সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধার। এছাড়াও কতশত ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সংগ্রামের গল্পজুড়ে আমাদের এই নারীরা সেটা জানেই বা কতজন? কতজন জানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা একদল বাঘিনীর জীবন মঞ্চে লড়াইয়ের গল্প? টিকে থাকার গল্প? জয়িতা হবার গল্প?
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের শুরু থেকেই দলের সাথে আছেন সালমা খাতুন। তার শুরুর পথটা মোটেই মসৃণ কিংবা সহজ ছিল না। খুলনা বিভাগের রূপসা উপজেলার মিলকী দেয়াড়া গ্রাম। সালমা খাতুনের নানাবাড়ী। বাকি দশটা গ্রামের মতো এই গ্রামেও পূর্ব আকাশে ভোরের সূর্য উঁকি দেয়, প্রকৃতি জেগে ওঠে। কৃষকেরা মাঠের পানে ছুঁটে যায় জীবিকার তাগিদে, ঘরের মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাংসারিক কাজে।
সালমার ক্রিকেটের শুরুটা এভাবেই
এই গ্রামেই বেড়ে ওঠা সালমা খাতুনের। বাকি দশটা মেয়ে যখন স্কুলের পানে ছুটছে কিংবা দারিদ্র্যতার বেড়াজালে পড়ে সংসারের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। সালমা তখন থ্রি পিসের ওড়না কোমরে গুজে মাঠে নেমে যেতেন ব্যাট-বল হাতে। খেলতেন মামাদের সাথে, পাড়ার ছেলেদের সাথে। এজন্য গ্রামের মানুষদের কটু কথা থেকে বাকি দশটা মেয়ের মতো রেহাই পাননি সালমাও। তবে দমে যাননি।
২০০৬ সালে গঠিত হলো বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। দলের প্রথম ব্যাচেই ছিলেন সালমা। সেই শুরু, এরপর দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ দলকে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মুকুটও পড়েছিলেন বেশ কিছু দিন। গত এক দশকে সালমা খাতুন হয়ে উঠলেন একটা চরিত্র, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের ‘ব্র্যান্ড’! শুধু নিজ এলাকা কিংবা দেশের গন্ডি নয়। বাইরেও নিজেকে মেলে ধরেছেন ‘অদম্য সালমা’!
ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন দলের নিউক্লিয়াস, তার হাতেই মানায় এই ট্রফি।
আরেকজন লেগস্পিন অলরাউন্ডার রুমানা আহমেদ। এশিয়া কাপ জয়ে যার ভূমিকা ছিলো অনস্বীকার্য। ছোটবেলায় টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে ক্রিকেটকে রুমানার ভালো লেগে যায়। তারপর ভাইদের সমর্থন পেয়ে ব্যাট-বল নিয়ে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় নেমে পড়েন। বাবা সমর্থন দিলেও মা চাইতেন না মেয়ে ক্রিকেটার হোক। কিন্তু মেয়ের আগ্রহ দেখে আর নিষেধ করতে পারেননি তিনিও।
এরপরের পথটাও সহজ ছিল না রুমানার জন্য। কঠোর পরিশ্রম আর চেষ্টায় আজকের রুমানা আহমেদ। শুরুতে যেমনটা হয়, ছেলেদের দল তাঁকে নিত না। কিন্তু মেয়েদের দল কোথায়? তারপর ২০০৮ সালে জানতে পারেন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের কথা। শুরুতে অফস্পিন করতেন। পরে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নকে দেখে হয়ে যান লেগ স্পিনার। ব্যস! সেই থেকে মেয়েটি হয়ে গেল টাইগ্রেসদের ভরসা।
বাংলাদেশের হয়ে এভাবেই উড়তে চেয়েছেন রুমানা
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট বলতেই চোখের সামনে সবার আগে ভেসে উঠে জাহানারার ছবি। বাংলাদেশের পতাকাটা কয়েক ভাঁজ করে মাথায় বেঁধে তার দৌড়ানোর দৃশ্য। মাপা রানআপ, অসাধারণ ফলো থ্রু, নিখুঁত লাইন লেংথ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রমীলা ক্রিকেট দলের পেস বোলিং ইউনিটের নেতৃত্ব যার হাতে।
বাবা-মা তথা পরিবার থেকে ক্রিকেটের ব্যাপারে পর্যাপ্ত উৎসাহ পেলেও প্রতিবেশি কিংবা বাইরের লোকজনের কারণে মুদ্রার ওপিঠ দেখতে সময় লাগেনি জাহানারার। শুনতে হয়েছে কটু কথা। একটা মেয়ে কেন ক্রিকেট খেলবে, সেটা নিয়ে নাকি তার বাবা-মায়ের কাছেও অভিযোগ এসেছে অসংখ্য। ছেলেদের সাথে অনুশীলন করতে গিয়ে অনেক সময় হেয়-প্রতিপন্ন হয়েছেন। কিন্তু জাহানারা তাতে দমে যাননি, নিজের ভেতরে লালিত সুপ্ত ইচ্ছার বলেই আজ বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অন্যতম কান্ডারি।
শুরু থেকেই জাহানারার হাতে দলের পেস ইউনিটের গুরুদায়িত্ব
ফারজানা হক পিংকি। বাড়ি গাইবান্ধা শহরের একোয়াস্টেট পাড়ায়।। ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় পিংকির ক্রিকেটে আগমন। ২০০৮ সালে জেলাভিত্তিক সেরা খেলোয়াড় বাছাইয়ের জন্য বিকেএসপি থেকে গাইবান্ধা জেলা ক্রীড়া সংস্থায় চিঠি আসে। সে চিঠির জবাবে পিংকির নাম পাঠানো হয়। তারপর পিংকিকে বিকেএসপি থেকে মনোনীত করা হয়। বিকেএসপিতে পুনরায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে যান ফারজানা হক পিংকি। সেখান থেকেই নারী ক্রিকেট দলের শুরুর সারথি হিসাবে পিংকির পথ চলা শুরু।
পরের নামগুলো লিখতে গেলে একটা মহাকাব্য লেখা হয়ে যাবে। মহাকাব্যকে একটা গন্ডির মধ্যে আটকানোর সাধ্যি আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের নেই।। এই দলটাই তো আমাদের ক্রিকেটে একটা মহাকাব্যিক অধ্যায়। শামীমা সুলতানা কিংবা শারমিন সুপ্তারা একেকটা জ্বলজ্বলে তারা। এদের মাঝে নবদিগন্তের আলো নিয়ে হাজির রিতু মনি, মুর্শিদা খাতুন, সোবহানা মোস্তারি, সুরাইয়া আজমীমরা।
বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিবেন নিগার সুলতানা জ্যোতি
সবশেষের নামটা নিগার সুলতানা জ্যোতি। উইকেটের পিছন দিকটা সামলানোর পাশাপাশি ব্যাট হাতে ভরসার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন যিনি। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পেরিয়ে তাসমান সাগরপাড়ের উদ্দেশ্য যে দলটা উড়াল দিলো। এই দলটার গুরুদায়িত্ব জ্যোতির কাঁধে। সদাহাস্য মেয়েটা আলোকবর্তিকা হাতে লাল সবুজের জ্যোতি হয়ে উঠুক আরেকবার।
বাঘিনীদের অর্জনের পাল্লাটা নেহাত কম ভারী নয়। নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দুইবার চ্যাম্পিয়ন, মূল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ, এশিয়ান গেমসে দুইবার রৌপ্যপদক অতঃপর এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব। এবার দেশকে বিশ্বকাপের মহামঞ্চে নিয়ে যাওয়া। এর মাঝে নারীদের আইপিএল, বিগব্যাশের মতো টুর্নামেন্টেও জাহানারা রুমানাদের অংশগ্রহণ। কি নেই নারীদের অর্জনের ভান্ডারে? এ যেন সর্বজয়ী জয়িতাদের দল।
এভাবেই চলতে থাকুক লাল-সবুজের জয়িতাদের উল্লাস
আদিকাল থেকেই 'নারী' শব্দটা পৃথিবীতে অবহেলিত। হোক সেটা যেকোনো ক্ষেত্রে। কিন্তু সময়ের সাথে সেই ধারাটা বদলে গিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছুটছে স্বপ্নচারিনীদের দল। যে ধারাটা এদেশের বুঁকে অগ্নিকণার ন্যায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। যে ধারাটা প্রত্যেক নারীর অন্তরে গেঁথে দিয়েছিলেন নারী জাগরনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। সেই ধারাটা ধরে এই বঙ্গদেশেই আলোর মশাল হাতে ছুটে চলেছেন আমাদের জাহানারা-সালমা-জ্যোতিরা। সেই আলোতে এবার আলোকিত হোক তাসমান সাগরপাড়!
স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি
[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]