নব্বই দশকের কথা। তখন শীতের মৌসুমে সিদ্ধেশ্বরী ক্রিকেট ক্লাব মাঠে নিয়মিতই প্রাকটিস সেশন হতো। সেখানে অনুশীলন করতেন খালেদ মাহমুদ সুজন, মোহাম্মাদ রফিকরা। তাদের প্রাকটিসের সময় কয়েকটা কিশোর মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতো। কখনো কখনো খুশি মনে বল কুড়িয়ে এনে দিতো।
এদের মধ্যে একটা ছেলেকে নিয়মিতই দেখা যেতে লাগলো। একদম রুটিনমাফিক ঠিক সময়ে সে হাজির হয়ে যেতো। সুজনরা ভাবলেন, হয়তো শখের বশেই আসে। কিন্তু নাহ! দেখা গেলো যে, এক মৌসুম শেষে পরের মৌসুমেও ছেলেটা নিয়মিত মাঠ আসছে, আনন্দের সাথে বল কুড়াচ্ছে। যেন ব্যাপারটা বেশ মজার।
ছেলেটার বয়স আর কত হবে? এই বছর দশেকের কাছাকাছি! একদিন সুজন মজার ছলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি ক্রিকেটার হতে চাও?’। ছেলেটা আগ্রহের সাথে বলে উঠলো সে লেগস্পিন পারে। দেখতে চাইলে করে দেখাতে পারবে। এরপর ছেলেটা নেটে কার মুখোমুখি হয়েছিলো জানেন? ইমরান হামিদ পার্থ।
তৎকালীন সময়ের স্পিনারদের ত্রাস! একদম ছাল-বাকলা তুলে ফেলতেন। পিটিতে তক্তা বানানো যাকে বলে আর কি! অতটুকুন ছেলে তাকে বল করবে, ব্যাপারটা যেমন বিস্ময়ের তেমনি আগ্রহের। যথারীতি বল করলো ছেলেটা। তবে পার্থ পরাস্ত হলেন! এমন ছেলেকে কেউ হাতছাড়া করতে চায়? সুযোগ পেয়ে গেলেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত অমরজ্যোতি ক্লাবে। কত ক্রিকেটারের পাঠশালা এই অমরজ্যোতি ক্লাব।
ছেলেটার আসল পরিচয় বোলার। ব্যাটিংয়ের জায়গা হলো লেট অর্ডারে। ভবিষ্যতে তার আসল কাজ যে ব্যাটিং হবে সেটা জানান দিতেই কিনা একদিন ৮ নম্বরে নেমে বাহারি শটের পসরায় দু'চোখে স্রেফ শীতলতার পরশ বইয়ে দিয়েছিলেন। তখনই তাকে নিয়ে চারদিকে শুরু হলো ফিসফিস, ‘কে এই ছেলে?’
ছেলেটার পরিচয় জানতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো বছর সাতেক। ২০০১ সালে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার সিংহলিজ স্পোর্টস গ্রাউন্ডে ব্যাট হেলমেট উচিয়ে লম্বা চুল নাচিয়ে ছোট খাটো গড়নের ছেলেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমার নাম আশরাফুল, মোহাম্মাদ আশরাফুল’! বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘আশার ফুল’
তখনকার দিনে আমাদের ক্রিকেটে ওই মানের ব্যাটসম্যানের জন্ম হয়নি। যে কিনা স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে প্রতিটা শটে লাল চেরিটা গুলির বেগে বাউন্ডারী পার করবেন। ঠিক তখনই ছোটখাটো গড়নের আশরাফুলের আগমন। দেখলে মনে হতো ভাঁজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। চেহারায় একটা মায়াবী আভাও স্পষ্ট।
অভিষেকেই চামিন্ডা ভাস, মুত্তিয়া মুরালিধরণ আর সনাৎ জয়াসুরিয়াদের চোখে চোখ রেখে স্রেফ আছড়ে ফেলছেন বাউন্ডারী লাইনে। ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আশরাফুল সেদিন জানান দিয়েছিলেন, তিনি হারিয়ে যেতে নয় বরং জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা হতে এসেছেন। জ্বলেছেন বটে, তবে একটা গন্ডির ভেতর!
সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিভা নাকি খুব বিরল। সেই বিরল প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন আশরাফুল। লংকানদের মাঠে টানা দুই সেঞ্চুরীর পর ভারতের সাথে সেই মহাকাব্যিক ১৫৮ রান। তখনকার দিনে বিশ্বসেরা ভারতের বোলিং অ্যাটাককে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন অতটুকুন ছেলে। সাধারণ জনগণ থেকে সাংবাদিক মহলের চোখেমুখে বিস্ময়। সকালের পত্রিকায় সেই বিস্ময় শোভা পেত বড় বড় অক্ষরে, ‘আশার ফুলে স্বপ্ন বিশাল!’
সেই রাতে বাকি দশটা রাতের মতোই ঘুমিয়ে পড়েছিলো টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। হঠাৎ একটা খবরে চৌষট্টি হাজার বর্গমাইলের ঘুম উধাও। ভূমিকম্পের ন্যায় চারদিকে ছড়িয়ে গেলো সে খবর, বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়াকে টেনে মাটিতে নামিয়ে এনেছে স্বয়ং লাল সবুজের সারথিরা। ঘুমকাতুরে চোখ কচলে অনেকেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিল, ‘স্বপ্ন নাকি সত্যি?’। সুদূর কার্ডিফ থেকে আশরাফুল নামক এক রাজপুত্র ব্যাট হেলমেট নাচিয়ে জবাব দিয়েছিলেন, ‘স্বপ্ন নয় সত্যি’। রূপকথার জন্মটা যে তার ব্যাটের ফুলঝুরিতেই।
সেদিন কার্ডিফের আকাশ-বাতাস থেকে প্রতিপক্ষের উইকেটকিপার অব্দি মাতোয়ারা হয়েছিল আশরাফুল বন্দনায়। কিপিং পয়েন্টে যেতে যেতে গিলির সেই হাততালি আর পন্টিংয়ের হতাশাময় চোখমুখই বলে দিচ্ছিলো সব। বলে দিচ্ছিলো লাল সবুজের মহাকাব্যিক সেই রূপকথার গল্প। যে রূপকথার বাঁকে বাঁকে কেবল চোখে ভাসে আশরাফুলের নান্দনিক স্কুপ, ড্রাইভ, পুল শর্টে ভরা এক মহাকাব্যিক ইনিংস।
বসন্তের শেষ বিকেলের বাতাসে নাকি কিছুটা বিষাদ মেশানো থাকে। সেই বাতাসে হু হু করে দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে ওঠে সবুজে সবুজে ছেঁয়ে যাওয়া পত্রপল্লবও। একদিন হুট করে আশরাফুলের জীবনেও ঝাপ্টা দিয়ে গেলো সেই বাতাস। তাতে পত্রপল্লবের মতো কেঁপে উঠলো মহাকাব্যিক সব ইনিংসে মোড়ানো ক্যারিয়ার।
সেদিন হু হু করে কেঁদে উঠেছিলেন মোহাম্মাদ আশরাফুল। বদলে গিয়েছিল পত্রিকার হেডলাইন। বড় বড় অক্ষরে ছাঁপা হলো স্পট ফিক্সিংয়ের মতো ভয়াবহ অপরাধের প্রতিবেদন। ঠিক যেভাবে একদিন ছাপা হয়েছিল আশার ফুলের স্বপ্নের কথা। দৃশ্যপটটাই ছিলো কেবল ভিন্ন। সেদিন বসন্তের বিষাদ বাতাস ঝাপ্টা দিয়ে গিয়েছিল ভক্ত সমর্থকদের অন্তরেও। তাতেই বের হয়ে এলো বুঁকচেরা দীর্ঘশ্বাস, ‘হায়, আশার ফুল!’
এরপরের গল্পটা স্বেচ্ছায় প্রতিভার অপচয়, আক্ষেপ আর একরাশ আফসোসে ঠাঁসা। আমাদের মহানায়ক হয়ে গেলেন লাল সবুজের ট্র্যাজেডির খলনায়ক! বসন্তের বাতাসে কেঁপে ওঠা কার্ডিফ, নটিংহাম কিংবা গায়ানা হয়ে রইলো নিষ্প্রাণ। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ধ্রুবতারার গল্প লিখতে এসে আশরাফুল লিখে গেলেন বিশাল এক ট্র্যাজিডির গল্প। যে গল্পের উপসংহারে কার্ডিফ থেকে গায়ানার মহাকাব্যে আশরাফুল হয়ে রইলেন সুবাস ছড়িয়েও ঝরে পড়া ‘আশার ফুল!’
স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি
[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]