‘নারী’ শব্দটার বানান কিংবা উচ্চারণ খুবই ছোট। সেকেন্ডের নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। অথচ একজন নারীর জীবনের গল্প কিংবা লড়াইয়ের ইতিহাস এক শব্দ তো দূরের কথা, মহাকাব্যের বিশাল মলাটেও বন্দি করার সাধ্যি কারও নেই। যুগ যুগ ধরে এই ধারা বহমান। যেকোনো ক্ষেত্রেই নারীকে এগিয়ে যেতে হয় প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে। কেউ হারে, কেউ জিতে, কেউ ইতিহাসের পাতায় হয়ে থাকে জয়িতা। এমনই একজন নারী লিয়া ক্যাম্পোস। যার বাঁশির প্রথম হুইসেলে ফুটবলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক ইতিহাস।
সময়টা ১৯৪৫। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রাজিলের মিনাস গেরাইসের একটি ছোট শহর আবেতেতে লিয়া ক্যাম্পোসের জন্ম। বুঝতে শেখার পর থেকেই ফুটবলটা খুব টানতো লিয়াকে। তবে তার মা-বাবা চাইতেন মেয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক। মা বাবার চাওয়া মতো লিয়া অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমনিকি চাকরিও পেয়ে গেছিলেন। তবে ফুটবলের প্রতি টানটা ছাড়তে পারেননি। সময়ের সঙ্গে সেটা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকলো।
একদিন লক্ষ্য ঠিক করে ফেললেন ফুটবলার হবেন। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললেন। কারণ তখন ব্রাজিলে মেয়েদের খেলাধুলা নিষিদ্ধ ছিল। ফুটবলের খুব কাছাকাছি থাকার একটাই উপায়, রেফারি হয়ে যাওয়া। অগত্যা সেটাই করলেন লিয়া। রেফারি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৭ সালের শুরুতে আট মাসের একটি রেফারিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যান। তখনও লিয়া জানতেন না তার সামনের পথ কতটা কঠিন আর দুর্গম!
যথারীতি আট মাসে কোর্স সম্পন্ন হলো। লিয়া তখন বাঁশিতে হুইসেল দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ঠিক ওই সময়ই তার সামনে হাজির হলো ব্রাজিলের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ! একজন মেয়েকে কেন তারা লাইসেন্স দিবে? নারীদের ফুটবল খেলাই যেখানে নিষিদ্ধ, রেফারিং সেখানে দিবাস্বপ্ন! তবে লিয়া দমলেন না। এখান থেকেই শুরু হলো তার নতুন লড়াই। প্রতিপক্ষ ব্রাজিলিয়ান ক্রীড়া সংস্থার (সিবিডি) প্রধান হ্যাভেলাঙ্গে।
১৯৪১ সালে ব্রাজিলে একটি আইন পাশ হয়েছিল। আইন অনুসারে, ব্রাজিলের মহিলারা বেশ কয়েকটি খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। যার মধ্যে একটি ছিল ফুটবল। তবে মহিলারা রেফারি হতে পারবেন কিনা সেই বিষয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। হ্যাভেলাঙ্গে জানান, রেফারিংয়ের ক্ষেত্রেও নারীদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কারণ হিসাবে অদ্ভুত একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন হ্যাভেলাঙ্গে। তার ভাষ্য ছিল, নারীদের শরীর পুরুষদের খেলায় রেফারিং করার জন্য উপযুক্ত নয়। তাছাড়া মাসিকের কঠিন ঝামেলা!
তবে লিয়া থেমে যাননি। দীর্ঘ সময় হ্যাভেলাঙ্গে এবং ব্রাজিলের ক্রীড়া আধিকারিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করতেন লিয়া। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ম্যাচে মহিলা ফুটবলাররাও খেলতেন। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, মহিলা ফুটবলাররা ম্যাচ খেলায় এবং লিয়া সেই ম্যাচে রেফারিং করায় কমপক্ষে ১৫ বার গ্রেফতার হতে হয়েছিল তাকে। লড়াইয়ে কাউকে পাশে পাননি এই নারী। অবশেষে লড়াইয়ে নতুন শক্তির দেখা পান লিয়া। তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন এমিলিও মেদিসি।
১৯৭১ সালের কথা। এমিলিও মেদিসি তখন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি। তার সামনে দাঁড়াতেও ভয় পেতেন সবাই। কিন্তু লিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিতব্য মহিলাদের বেসরকারি বিশ্বকাপে রেফারি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় লিয়াকে। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না লিয়া। মেদিসির সাথে দেখা করে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলার পর সাহায্য করার আশ্বাস দেন রাষ্ট্রপতি।
এরপর হ্যাভেলাঙ্গের সঙ্গে দেখা করে লিয়াকে রেফারিং করার অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ দেন মেদিসি। সেই নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা হ্যাভেলাঙ্গের ছিল না। কেইবা চায় সেধে গিয়ে বাঘের মুখে ধরা দিতে? ব্যস, এরপরই ব্রাজিলে নারীদের জীবনে শুরু হয় নতুন দিগন্ত। যে দিগন্তের সুর্য হয়ে আলো ছড়িয়েছেন লিয়া ক্যাম্পোস।
ক্যারিয়ারে প্রায় ৯৮টি ম্যাচে রেফারিং করেছেন লিয়া। ম্যাচগুলোতে রেফারিং করার সময়েও একাধিক ‘ভিন্ন’ ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তবে থেমে যাননি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছেন। যে কারণে আজ তিনি নারী রেফারিদের কাছে তো বটেই, বিশ্বের সকল নারী ফুটবলারদের কাছে হয়ে আছেন লড়াইয়ের এক মূর্ত প্রতীক। যে শক্তির আদর্শকে ধারণ করে বিশ্বজুড়ে উড্ডয়ন হয়েছে নতুন দিনের গল্প।
স্পোর্টসমেইল২৪/এএইচবি
[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]