রি-ক্রিয়েটিভো : স্প্যানিশ ফুটবলের পতাকাবাহক

পার্থ প্রতীম রায় পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২২
রি-ক্রিয়েটিভো : স্প্যানিশ ফুটবলের পতাকাবাহক

ডিসেম্বর, ২০০৬! রিয়াল মাদ্রিদকে তাদের ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল স্পেনের ছোট্ট শহর উয়েলভার একটি ক্লাব। নাম রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা। এ হারের পর স্প্যানিশ গণমাধ্যম রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসের সবচেয়ে ‘বাজে ম্যাচ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। অবশ্য রিয়ালের তুমুল সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ এ ম্যাচে রিয়ালের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তখনকার সময়ের সেরা তারকা রোনালদো নাজারিও, ডেভিড বেকহাম, রবিনহোদের মতো তারকারা। রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভাকে ঠিক যতটা ছোট করে দেখা হয়েছিল, ঐতিহাসিকভাবে রিয়ালের থেকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ লস ব্ল্যাঙ্কোসদের হোচট খাওয়ানো এ ক্লাবটি।

বরাবরই ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা ট্রফি বিবেচনায় সবসময়ই স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসে সবার আগে আসে রিয়াল মাদ্রিদের নাম। অতিরিক্ত হিসেবে রিয়ালের উপর সবসময়ই ছিল স্প্যানিশ রাজ পরিবারের ছায়া। এ কারণেই স্পেনের ফুটবল কর্তৃত্ব মানেই রিয়াল মাদ্রিদের নাম। কিন্তু স্পেনজুড়ে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেনি গ্যালাক্টিকোরা, এর একমাত্র দাবিদার রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা। কারণ তারাই যে স্পেনের প্রাচীনতম ফুটবল ক্লাব।

স্পেনে ফুটবল চর্চার শুরু সেই ১৮৭৪ সাল কিংবা তার আগে। নির্দিষ্ট করে বললে  প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৮৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু। স্পেনের আন্দালুসিয়ান অঞ্চলের ছোট শহর উয়েলভা। সেখানকার একটা জায়গা আইবেরিয়ান পেনিনসুলা, সেখানেই প্রথম আয়োজিত হয় স্পেনের ইতিহাসের প্রথম ফুটবল ম্যাচ।

আজকে ঘোষণা দিলাম, আর কালকেই তো আর ম্যাচ আয়োজন করা সম্ভব না! এ ম্যাচের পিছনেও থাকে বিভিন্ন ইতিহাস। মূলত এ ম্যাচ আয়োজনের পিছনে ছিল বৃটেনে পড়াশুনা করা স্প্যানিশরা। একসময় শুধু বৃটেনজুড়েই ছিল ফুটবলের আধিপত্য, এজন্য বলা হয়ে থাকে ফুটবলের জনক বৃটিশরা। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই স্পেনের মাটিতে ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের প্রচেষ্টা চালায় বৃটেন ফেরত স্প্যানিশরা।

সে সময় স্পেনে চলছিলো কার্লিয়েস্ট যুদ্ধ পরবর্তী সময়। সে যুদ্ধ থামাতে কাজ করেছিল প্রচুর বৃটিশ সৈনিক। একই সাথে উয়েলভা শহরের রিও টিন্টো মাইনিং কোম্পানিতে চলছিল পাথর উত্তোলনের কাজ। রিও টিন্টো বৃটিশ কোম্পানি হলেও পাথর উত্তোলনের কাজ করছিল স্প্যানিশ শ্রমিকরা। মূলত উয়েলভা শহরের সাথে বাইরের যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য চলছিল রেল লাইন তৈরির কাজ। এ উদ্দেশ্যেই উত্তোলন করা হচ্ছিলো পাথর।

sportsmail24

স্থানীয় টুর্নামেন্ট জিতে রিক্রিয়েটিভোর উল্লাস

এ দুই কারণ মিলিয়ে উয়েলভা শহরে তৈরি হয়েছিল প্রচুর বৃটিশ নাগরিকের আনাগোনা। শেষমেষ সেই বৃটিশ এবং স্থানীয় স্প্যানিশ নাগরিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় মাঠে গড়ায় স্পেনের ইতিহাসের প্রথম ফুটবল ম্যাচ। এ ম্যাচে বৃটিশ সৈনিকদের প্রতিপক্ষ ছিল রিও টিন্টো মাইনিং কোম্পানির স্প্যানিশ শ্রমিকরা। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের ফলাফল বৃটিশদের পক্ষেই গিয়েছিল।

যেসব স্প্যানিশ নাগরিক ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের পক্ষে কাজ করেছিল তারা বেশিরভাগই ছিল প্রবাসী। তাদের প্রায় সবাই বৃটিশ যুক্তরাজ্যে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে থাকতেন। আর সেখানেই তারা ফুটবলের সাথে নিজেদের পরিচিত ঘটান।

মূলত এখান থেকেই শুরু হয় স্পেনে ফুটবলের যাত্রা। এখান থেকেই ধীরে ধীরে সাধারণের কাছে পরিচিত হতে থাকে ফুটবল। ১৮৮৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর রিও টিন্টো মাইনিং কোম্পানির ম্যানেজারের উৎসাহে তৈরি হয় উয়েলভা রিক্রিয়েশন ক্লাব। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা। আর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সেখানে ফুটবল খেলার প্রচলন করেন বৃটিশ মালিকাধীন কোম্পানির শ্রমিকরা। আর এইভাবেই স্পেনের আন্দালুসিয়ান অঞ্চলে ফুটবলের প্রসার ঘটতে শুরু করে। ফুটবল ছাড়া অন্য খেলার সাথে জড়িত না হওয়ায় রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভাকে স্পেনের সর্বপ্রাচীন ফুটবল ক্লাব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

অবশ্য উয়েলভা রিক্রিয়েশন ক্লাবের আগে প্রতিষ্ঠিত হয় স্প্যানিশ ফুটবলের শীর্ষ লিগ লা লিগার জনপ্রিয় ক্লাব অ্যাথলেটিক বিলবাও। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাব ফুটবলের সাথে জড়িত থাকলেও তখন তাদের কোনো সাংগঠনিক রুপরেখা ছিল না। ১৯০১ সালে ক্লাবটি পায় তাদের সাংগঠনিক রুপ। আর তখন থেকেই ক্লাবটি পরিচিতি লাভ করতে থাকে। আর ১৯১৪ সাল থেকে প্রতিযোগিতামূলক ফটবলে নাম লেখায় অ্যাথলেটিক বিলবাও।

প্রতিষ্ঠার প্রায় চার মাস পর স্পেনের ইতিহাসের প্রথম আনুষ্ঠানিক ফুটবল ম্যাচে মুখোমুখি হয় রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা এবং সেভিয়া এফসি। রিক্রিয়েটিভো প্রতিষ্ঠার পাওয়ার প্রায় মাসখানেক পর নির্দিষ্ট করে বললে ১৮৯০ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় স্পেনের আরেকটি আন্দালুসিয়ান ক্লাব সেভিয়া।

সেভিয়া এবং রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভার মধ্যকার ম্যাচটি ছিল মূলত আমন্ত্রণমূলক। তবুও এটাকেই দেওয়া হয় স্পেনের প্রথম আনুষ্ঠানিক ফুটবল ম্যাচের স্বীকৃতি।

sportsmail24

স্পেনের ইতিহাসের প্রথম ফুটবল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল রিক্রিয়েটিভো এবং সেভিয়া

এ ম্যাচের পরই স্পেনের দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে (আন্দালুসিয়ান অঞ্চলটি মূলত স্পেনের দক্ষিণ অঞ্চল) বাড়তে থাকে ফুটবলের জনপ্রিয়তা। ফুটবলের প্রসার এতোটাই বেশি ঘটে যে আঞ্চলিক পর্যায়ে আয়োজিত হতে থাকে একের পর টুর্নামেন্ট। 

টুর্নামেন্টগুলোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা। সব টুর্নামেন্টেই শিরোপায় চোখ রেখেই লড়াই করে যেত রিক্রিয়েটিভো। শুধু তাই নয়,  বেশিভাগ টুর্নামেন্টেরই চ্যাম্পিয়ন স্পেনের প্রথম এই ফুটবল ক্লাব।

ফুটবলের জোয়ার বাড়তে থাকলে ১৯১৪ সালে শুরু হয় স্পেন ফুটবলের জাতীয় পর্যায়ের লিগ। যদিও ১৯২৯ সালে এ লিগের নাম পরিবর্তত হয়ে করা হয় লা লিগা। স্থানীয় পর্যায়ে একের পর এক সাফল্য পেলেও জাতীয় পর্যায়ে কোনোভাবেই নিজেদের অবস্থান পাকা করে নিতে পারছিল না রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা। আর কখনই সেটা পেরে উঠেনি এই আন্দালুসিয়ান ক্লাবটি।

অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে ১৯৪০ সালে স্প্যানিশ দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে উন্নীত হয় রিক্রিয়েটিভো। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিভাগ লিগে স্থায়ী হলেও তখনও তাদের কাছে অধরা হয়ে ছিল শীর্ষ লিগটি। উল্টো ১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো রেলিগেশনের ঝামেলার পড়ে তৃতীয় বিভাগে অবনমিত হয় রিক্রিয়েটিভো। 

অনেক ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো স্প্যানিশ শীর্ষ লিগ লা লিগায় উন্নীত হয় রিক্রিয়েটিভো। ততদিনে লা লিগায় জমে উঠেছে রিয়াল-বার্সার আধিপত্য। সাথে যুক্ত হয়েছে প্রায় একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত সেভিয়া-অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের মতো ক্লাবগুলো। তবে উত্থান-পতনের এ যাত্রা ধরে রেখেই লা লিগায় উন্নীত হয় ক্লাবটি। তবে প্রথমবার লা লিগায় খেলার মৌসুমেই প্রথম বিভাগে নেমে যায় তারা।

প্রথম-দ্বিতীয় বিভাগ, করেই একের পর এক মৌসুম কাটাচ্ছিলো রিক্রিয়েটিভো। লা লিগায় প্রথমবারের মতো খেলার ১২ বছর পর ১৯৯০ সালে রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভাকে তৃতীয় বিভাগে খেলতে দেখা যায়। অবশ্য পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারাটাই তাদের তৃতীয় বিভাগে নেমে যাওয়ার মূল কারণ। 

তৃতীয়-দ্বিতীয় বিভাগ হয়ে ২০০২ সালে আবারও লা লিগায় নাম লেখায় রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা। খুব সম্ভবত রিক্রিয়েটিভোর ইতিহাসের সবচেয়ে সাফল্যময় একটি মৌসুম ছিল এটি।

প্রথমবারের মতো স্প্যানিশ ফুটবলের কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে ক্লাবটি। কিন্তু ফাইনাল ভাগ্য ডি উয়েলভার পাশে ছিল না। স্যামুয়েল ইতোর রিয়াল মায়োর্কার কাছে ৩-০ গোলে হেরে শিরোপা হাতছাড়া করে ক্লাবটি। কোপা দেল রে-তে সাফল্য পেলেও আবারও নিচের ধাপে নেমে যায় রিক্রিয়েটিভো।

তিন বছর পর ২০০৬-০৭ মৌসুমে আবারও লা লিগায় ফেরে ক্লাবটি। রিক্রিয়েটিভোর ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচটি ছিল এ মৌসুমেই। স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদকে ৩-০ ব্যবধানে তাদের ঘরের মাটেই হারিয়েছিল রিক্রিয়েটিভো। তবে ম্যাচ জয়ের আনন্দ যে উপভোগ করতে পারেননি ফুটবলার কিংবা সমর্থকদের কেউই।

রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে ইতিহাসের জন্ম দেয় রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভা

রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে এ ম্যাচের আগে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিল ক্লাবটির সমর্থকরা। সান্তিয়াগো ব্যানার্ব্যুতে এ ম্যাচ দেখতে আসার পথে বাস দূর্ঘটনার শিকার হয় সমর্থকদের বহনকারী বাসটি।

এ দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান অনেকেই। এমনকি অনেকেই হয়ে পড়েন পঙ্গু। তাই তো রিয়ালকে হারিয়েও আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভাসতে পারেনি উয়েলভা শহরের লোকজন।

এরপরে আবারও নিচের লিগে নেমে যায় উয়েলভা। এরপর আর কখনই লা লিগার মঞ্চে উয়েলভাকে খেলতে দেখা যায়নি। নিচে নামতে নামতে এখন তৃতীয় বিভাগে খেলছে ক্লাবটি।

স্পেনের সবচেয়ে প্রাচীন ক্লাব হয়েও ফুটবল মাঠে শিরোপা কিংবা বড় দলে পরিণত হতে না পারার আক্ষেপ নিশ্চয় আছে। তবে এ আক্ষেপ থাকলেও বেশ সমৃদ্ধশালী ইতিহাসে পরিপূর্ণ রিক্রিয়েটিভো। স্প্যানিশ ফুটবল প্রসারে তাদেরকে ভুলে যাওয়ার কোনো পথ নেই। যতদিন বেঁচে থাকবে স্প্যানিশ ফুটবল, স্মরনীয় হয়ে থাকবে রিক্রিয়েটিভো ডি উয়েলভার নাম।  

স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর

[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্টল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]



শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

১২ বছরের বালিকার হাতে স্কটল্যান্ডের জার্সির ডিজাইন

১২ বছরের বালিকার হাতে স্কটল্যান্ডের জার্সির ডিজাইন

ইব্রাহিম হামাদতৌ : টেবিল টেনিসের এক বিস্ময়

ইব্রাহিম হামাদতৌ : টেবিল টেনিসের এক বিস্ময়

অলিম্পিকে তাইওয়ান কেন চাইনিজ তাইপে?

অলিম্পিকে তাইওয়ান কেন চাইনিজ তাইপে?