প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

পার্থ প্রতীম রায় পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ০৩:৩৭ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২২
প্রতিভার নিদারুণ অপচয় এক গুরাভ

পৃথিবীর এক নিষ্ঠুর নিয়তি! আজকে যে রাজা, কাল সে ফকির। কত জনের জীবনে এই রকম ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠে না। আর যাদের কথা জানা যায়, তাদেরকে নিয়ে আক্ষেপের কোনো কমতি থাকে না আমাদের।

আসুন, আজকে এক ক্রিকেট প্রতিভার কথা বলি, যিনি কিনা ছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের থেকেও প্রতিভাবান। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন! শচীনের থেকেও বেশি প্রতিভাবান। স্যার রামাকান্ত আচরেকারের প্রিয় শিষ্য কে? এ প্রশ্নের উত্তরে যে কেউ উত্তর দিয়ে বসবেন শচীন টেন্ডুলকার। না, শচীন টেন্ডুলকার রামাকান্ত আচরেকারের প্রিয় শিষ্য ছিলেন না, ছিলেন সেরা শিষ্য। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, কে তাহলে রামাকান্ত আচরেকারের প্রিয় শিষ্য? এই প্রশ্নের উত্তর হলো অনিল গুরাভ।

নিশ্চয় মনে প্রশ্ন জেনেছে, কে এই অনিল গুরাভ?

শচীন টেন্ডুলকার এবং অনিল গুরাভ, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল ছিল তাদের দুই জনের বড় ভাইয়ের নামই ছিল অজিত। এক অজিত গড়ে তুলেছেন শচীনকে, আরেক অজিত অনিলকে নামিয়ে দিয়েছেন নিচে।

অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলাকালীন সময়ে রামাকান্ত আচরেকার তার দুই শিষ্য শচীন টেন্ডুলকার এবং বিনোদ কাম্বলিকে গুরাভের ব্যাটিং দেখতে বলেছিলেন। যেন তারা গুরাভকে দেখে কিছু শিখতে পারে। 

কিন্তু অসম্ভর প্রতিভাবান হয়েও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন অনিল গুরাভ।

একদিন অনিলের খেলা দেখতে দেখতে শচীন এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি এই প্রতিভাবানের ব্যাট নিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাজুক শচীন অনিলকে সেই কথা বলতে পারেননি। ওয়ানখেড়ে স্টেডিয়ামের স্কোরার রমেশ পরভকে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন শচীন।

তার সেই কথা অনিলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন রমেশ পরভ। তখন অনিল জানান, শচীন যদি পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে পারে তাহলেই তাকে এই ব্যাটটা দিয়ে দিবেন। শচীন ঠিকই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ব্যাটটা নিজের করে নিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারজুড়ে অসংখ্য স্মরণীয় ব্যাটের ভিড়েও গুরাভের কাছ থেকে পাওয়া ব্যাটটিকে আলাদা করে রেখেছেন শচীন টেন্ডুলকার।

ক্যারিয়ারের শুরুতেই মুম্বাইয়ের ভিভ রিচার্ডস নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন অনিল গুরাভ। মুম্বাই অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলাকালীন নজর কেড়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দুনিয়ার। স্বয়ং সুনীল গাভাস্কারের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তার খেলা দেখে সকলেই বলেছিল মুম্বাই থেকে একমাত্র অনিল গুরাভই বিশ্বকে জয় করতে পারবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি আর মুম্বাইয়ের ধাপই পেরোতে পারেননি।

এই সেই অনিল গুরাভ! যার কিনা ব্যাট হাতে বিশ্বকে জয় করার কথা ছিল। অথচ তিনি কিনা এখনও মুম্বাইয়ের কুখ্যাত বস্তিতে পড়ে আছেন। 

কেন অনিল গুরাভ হয়ে উঠতে পারেননি মুম্বাইয়ের স্যার ভিভ রিচার্ডস? এই প্রশ্নের উত্তর হলো অজিত। না, শচীনের ভাই অজিত নন, তিনি হলেন অনিল গুরাভের ভাই অজিত গুরাভ। মুম্বাইয়ের কুখ্যাত আন্ডারওয়ার্ল্ডের বড় সন্ত্রাসী ছিলেন অজিত গুরাভ।

প্রতিদিনই অজিতের নামে মুম্বাই পুলিশের কাছে ব্যাংক ডাকাতি, খুন, রাহাজানির অভিযোগ জমা হতো। আর কিছু দিন পরপরই অজিতের এ কর্মকান্ডের কারণে অনিল এবং তার মাকে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হত। এমনকি কোনো গুরুত্বপূর্ন ম্যাচের মাঝখানেও অনিলকে থানায় নিয়ে যাওয়া হতো। কখনো কখনো একাধিক দিন থানায় কাটিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই থাকতেন না তিনি। এভাবেই হারানোর পথে এগিয়ে যান অনিল।

এটাই কি একমাত্র কারণ? না শুধু এই কারণেই হারিয়ে যাননি অনিল। হারিয়েছেন নিজের দোষের কারণেও। আর সেটি হলো প্রচুর ক্ষ্যাপ খেলে বেড়াতেন তিনি। কোচ আচরেকারের নিষেধ সত্ত্বেও নিজের ক্ষ্যাপ খেলা বন্ধ করতে পারেননি তিনি। বড় ভাইয়ের কারণে আর্থিকভাবে ভেঙে পড়লে নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিতেই ক্ষ্যাপ খেলার দিকে নজর দেন অনিল।

বড় ভাইয়ের কারণে নিত্যদিনের এই অপমানে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন অনিল গুরাভ। তাই তার হাতে ব্যাটের বদলে উঠেছিলো মদের বোতল। এরপর আর এই মদের নেশা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেননি। আর নিজেকে মদের নেশা থেকে বের করে আনতে না পারার জন্য আস্তে আস্তে ব্যাট-প্যাড গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে পড়েন অনিল। আর পড়ে থাকেন মুম্বাইয়ের সেই বস্তিতেই যেখানে আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজত্ব করতো তার ভাই অজিত।

ক্রিকেটে অনেক খ্যাতি পাওয়ার পরও অনিল গুরাভকে কখনো ভোলেননি শচীন টেন্ডুলকার। ১৯৯০ সালে কোনো এক জায়গায় তাদের মধ্যে দেখা হয়। সেই ভিড়ের মধ্যেও অনিলকে চিনতে ভুল করেননি শচীন। ভিড়ের মধ্য থেকে অনিলকে নিজের কাছে ডেকে নেন তিনি। তাকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণও জানান, কিন্তু কখনো সেদিকে পা বাড়াননি অনিল।

এমনকি পরবর্তীতে কখনো শচীনের সাথে দেখা করারও চেষ্টা করেননি তিনি। দেখা হওয়ার সময় শচীনের কাছে ব্যাটটি ফেরত চেয়েছিলেন অনিল গুরাভ। কিন্তু সেটি ফেরত দেননি শচীন টেন্ডুলকার, কারণ হিসেবে জানান, এটাই আমার ক্যারিয়ারের একমাত্র উপার্জিত ব্যাট।

অনিলের বয়স এখনো পঞ্চাশের উপরে। ঘরের কোণে এখনো পড়ে আছে তার খেলোয়াড়ি জীবনের অনেক নির্দশন। অনেক ট্রফি এবং পুরাতন খবরের কাগজ, যেগুলোর মাধ্যমে ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এই প্রতিভাবানের গল্প। কিন্তু সেগুলো হয়তো কারোর কাছেই আর বিশ্বাসযোগ্য নয়।

অনিলের ভাবনা, বড় হতে গেলে শুধু প্রতিভা নয়, দরকার উপযুক্ত পরিবেশেরও। পরিবেশের অভাবেই বড় হতে না পারা এই প্রতিভাবান চান আর কখনোই এইভাবে হারিয়ে না যাক আর কোনো প্রতিভা।

স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর

[আমরা এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ইনস্ট্রল করুন আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস ]


বিষয়ঃ

শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

১২ বছরের বালিকার হাতে স্কটল্যান্ডের জার্সির ডিজাইন

১২ বছরের বালিকার হাতে স্কটল্যান্ডের জার্সির ডিজাইন

অলিম্পিকে তাইওয়ান কেন চাইনিজ তাইপে?

অলিম্পিকে তাইওয়ান কেন চাইনিজ তাইপে?

ইব্রাহিম হামাদতৌ : টেবিল টেনিসের এক বিস্ময়

ইব্রাহিম হামাদতৌ : টেবিল টেনিসের এক বিস্ময়

অলিম্পিকেও ছিল ক্রিকেট, কারা জিতেছিল স্বর্ণ

অলিম্পিকেও ছিল ক্রিকেট, কারা জিতেছিল স্বর্ণ