'ভুলক্রমে বাংলাদেশে জন্মেছেন তিনি'- মোনেম মুন্নাকে নিয়ে এ কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। নিশ্চয় এতো ভাবনা চিন্তা করে তিনি এ কথা বলেননি। নিজের প্রিয় শিষ্যের খেলা দেখেই বলেছিলেন। কথাটার যথার্থতা প্রমাণ করে দিয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম । মনে রাখেনি দেশসেরা ডিফেন্ডার মোনেম মুন্নাকে। ইউরোপে একজন মোনেম মুন্না হলে হয়তো সারাবিশ্বই তাকে প্রতি মুহূর্তেই মনে রাখতো, কিন্তু আমরা মনে রাখতে পারিনি।
আশির দশকের শুরুতে পাইওনিয়ার লিগ দিয়ে ফুটবলে আসেন মোনেম মুন্না। একই দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের হয়ে তার উত্থান। মুক্তিযোদ্ধার হয়ে ২য় বিভাগ খেলে দলকে প্রথম বিভাগে তোলার পাশাপাশি নিজেও নাম লেখান প্রথম বিভাগে। মুক্তিযোদ্ধার হয়ে প্রথম বিভাগে এক মৌসুম খেলেই দল বদলে পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। সেখানেও অবশ্য এক মৌসুমের বেশি স্থায়ী হতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা, ব্রাদার্স হয়ে রেকর্ড চুক্তিতে আবাহনীতে পাড়ি জমান। টাকার অঙ্কটা নেহাতই কম নয়, বিশ লাখ। তখনকার সময়ে বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের ফুটবলের রেকর্ড বেতনে আবাহনীতে এসেছিলেন। আর সেখানেই কেটেছে তার ক্যারিয়ারের সেরা ও স্বর্নালী সময়।
আবাহনীতে থাকাকালীন ঢাকার মাঠের পাশাপাশি কাঁপিয়েছেন কলকাতার মাঠ। আবাহনী ছেড়ে দুই মৌসুম খেলেছিলেন কলকাতার ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলে। ঢাকার দর্শকদের মতো কলকাতার দর্শকদেরও মন জয় করেছিলেন।
গোলের খেলা ফুটবলে একজন গোলদাতার নাম যতটা পরিচিত হয়, ঠিক তততাই আড়ালে থাকে রক্ষণ দূর্গ সামলানো খেলোয়াড়ের নাম। কিন্তু সেখানেই ব্যতিক্রম ছিলেন মোনেম মুন্না। রক্ষণ দূর্গের নেতা হয়ে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন মোনেম মুন্না। তাই তো কলকাতার অলিতে গলিতে কান পাতলে এখনো ভেসে আসে মোনেম মুন্নার নাম।
ক্লাব ফুটবলে উজ্জ্বল মোনেম মুন্না জাতীয় দলেও ছিলেন স্বপ্রতিভায় মহিমান্বিত। ১৯৮৬ থেকে টানা ১১ বছর লাল-সবুজের জার্সিকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ফুটবলে বাংলাদেশকে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ এনে দিয়েছিলেন অধিনায়ক মুন্না। অধিনায়ক ও রক্ষণ, সব দিক থেকেই সেরা ছিলেন মুন্না। অবশ্য রক্ষণের মুন্নাকে অতিক্রম করার সাহস কয়জন ফুটবলারেরই বা হয়েছে। ক্রিকেটের বাণিজ্যের আগে বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া তারকা ছিলেন মোনেম মুন্না।
মাঠের তারকা মোনেম মুন্না মাঠের বাইরেও ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। তার সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়েছিল বিখ্যাত প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার। মুন্নাকে বানিয়েছিল নিজেদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
রক্ষণ দূর্গ সামলানো মোনেম মুন্না ছাড়া বাংলাদেশের ফুটবলে আর একজনই সুপারস্টার এসেছিলেন। তিনি হলেন কাজী সালাউদ্দিন। তবে মুন্নার কাছে সালাউদ্দিন কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যাবেন। সালাউদ্দিন যে খেলতেন আক্রমণ ভাগকে নেতৃত্ব দিয়ে হয়েছিলেন জনপ্রিয়। রক্ষণ দূর্গ সামলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যাওয়াটা ছিল এক বিস্ময়কর। আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড়দের ফুটবল শৈল্পিকতাকে আটকে রেখে হয়েছিলেন জনপ্রিয়।
গোল আটকানোতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না মোনেম মুন্না, দুর্দান্ত সব ফ্রি কিক নেওয়ার কাজটাও বেশ ভালো করতেন তিনি। এছাড়াও রক্ষণ থেকে আক্রমণ সাজিয়ে আনার কাজটাও বেশ ভালোই জানা ছিল তার।
ছবি সৌজন্যে- সুকান্ত সেনশর্মা
আবাহনীতে থাকা অবস্থায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গলকে প্রতিনিধিত্ব করেন মোনেম মুন্না। ঢাকায় এক প্রীতি ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে কলকাতার ক্লাব ইস্ট বেঙ্গল। আসলামের গোলে ইস্ট বেঙ্গল হারলেও তাদের ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডারের খোঁজ পেয়ে যান। কলকাতার ক্লাবে খেলার সেই চুক্তি ফেরাতে পারেননি মুন্না। নাম লেখান ইস্ট বেঙ্গলে।
কলকাতার মাঠে ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে খেলার সময় মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল ডার্বি পাশে সরিয়ে সবার দৃষ্টিতে থাকতো এক মোনেম মুন্না। কলকাতার দর্শকদের এতোটাই মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন, তার অনুশীলন দেখার জন্য ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের মাঠে জমতো হাজারো ভিড়।
ইস্ট বেঙ্গল থেকে আবাহনীতে ফিরে এসে ১৯৯৮ সালে ফুটবল ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান মুন্না। খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানলেও আবাহনীকে ছাড়েননি তিনি। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে প্রিয় ক্লাবে থেকে যান।
খেলোয়াড়ী জীবনকে বিদায় জানানোর পরের বছর, ১৯৯৯ সালে কিডনির সমস্যায় পড়েন মুন্না। এরপর আর কখনও সুস্থ হতে পারেননি তিনি। ২০০০ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলেও সুস্থ হতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান প্রিয় মোনেম মুন্না।
মৃত্যুর পর আর কোনো খোঁজ রাখেনি কেউ। হারিয়ে গেছেন মোনেম মুন্না, তার স্মৃতি রক্ষার্থে নেই কোনো নূন্যতম প্রচেষ্টা। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মোনেম মুন্না শুধু একটি নামের বাইরে আর কিছুই নয়। অথচ তিনি হতে পারতেন আমাদের প্রাতস্মরনীয় এক ফুটবল কিংবদন্তি।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর
[sportsmail24.com এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও। খেলাধুলার ভিডিও-ছবি এবং সর্বশেষ সংবাদ পড়তে ব্রাউজ করুন যেকোন ঠিকানায়। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে ইনস্ট্রল করে নিতে আমাদের অ্যাপস ]