সময়টা ২০০০-২০০১ সাল, দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে ভারত বনাম জিম্বাবুয়ের টেস্ট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল বছর বার-তের বছরের এক বালক। বীরেন্দ্র শেবাগ আর যুবরাজ সিং-এর খেলা দেখে তাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য স্টেডিয়ামের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
সময় খুব দ্রুত গড়ায়। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ দিল্লির সে স্টেডিয়ামেই নতুন একটি প্যাভিলিয়ন যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান অধিনায়কের নামে নামকরণ করা হয়েছে সেটির। দলের বাকি সদস্যদের উপস্থিতিতে অধিনায়ক স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে নিজ নামের প্যাভিলিয়নটি উদ্বোধন করেন।
সে দিনের সেই তের বছরের বালকটি আজ ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, বিরাট কোহলি। তার নামেই সেদিন প্যাভিলিয়নের নাম ‘বিরাট কোহলি প্যাভিলিয়ন’ নামকরণ করা হয়। কে জানতো, যে স্টেডিয়ামে এসেছিল একটি অটোগ্রাফের জন্য সেই স্টেডিয়ামেই হবে তার নামে প্যাভিলিয়ন। ক্রিকেট বিধাতা হয়তো এমনি চেয়েছিলেন!
দিল্লিতে জন্ম, বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। ভারত দলের জার্সি গায়ে ছেলেকে দেখার ইচ্ছে ছিল তার। সে ছেলেটি মাত্র তিন বছর বয়সেই হাতে তুলে নেয় ক্রিকেট ব্যাট। এ জন্যই তার মা বলেছিলেন, ওর জন্মই হয়েছিল ক্রিকেটের জন্য। কোহলির মায়ের ওই কথায় দুটি চরণ না লিখলেই নয়;
দিল্লি রাজ্যের কোহলি পরিবারে জন্মগ্রহণ যখন করলে তুমি,
ক্রিকেট যেন তখনই বলেছিল তোমাকে,
মাঝমাঠই যে তোমার মাতৃভূমি!
কোহলির বয়স যখন আঠারো তখন হারাতে হয় প্রিয় বাবাকে। বাবার মৃত্যুর দিনই ছিল তার রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ। ১৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের কর্ণাটকের সাথে রঞ্জি ট্রফির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছেলেটা ম্যাচ শেষে ৪০ রানে অপরাজিত আর সামনে কর্ণাটকের পেস আক্রমণ সামলে কীভাবে ফলোঅন বানানো যায়, হয়তো ছেলেটাও ভাবতেছিল। কিন্তু হঠাৎ ভোর ৩টায় একটা ফোন আর একটা সংবাদ; যে সংবাদ একটা সাধারণ ছেলেকে টলিয়ে দেওয়ার পক্ষেই যথেষ্ট।
পেসের আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার বাবা মাত্র ৫৪ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। একদিকে ছেলেটার বাবার মৃত্যু সংবাদ, অন্যদিকে দলের রান ১০৫/৪, ম্যাচ জেতাতে ছেলেটার ক্রিজে থাকা জরুরি। তবে টিমের বাকিরা হয়তো ভেবেছিল ছেলেটা আর ক্রিজে আসবে না। পরের দিন সকাল, চোখে সদ্য পিতৃ হারার যন্ত্রণা নিয়ে ছেলেটা কোচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার আমি খেলছি তো?’
ক্রিজে নেমে ছেলেটার ৯০ রানের এক ইনিংস ফলোঅন বাঁচিয়ে দিল দলকে। সে দিন বাবার শোকে মাঠ ছেড়ে চলে যায়নি বরং পিতা হারানোর শোক বুকে নিয়ে ৯০ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ শেষে বাবার শেষকৃত্য অংশগ্রহণ করেছিন কোহলি। ক্রিকেটের প্রতি যার এত ডেডিকেশন, ক্রিকেট তাকে ছাড়ে কী বুজে!
সেই ছেলেটি এখন ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। ক্রিকেটকে ঘিরে সে, ক্রিকেট তাকে ঘিরে। রেকর্ড ভাঙা-গড়ায় এখন তার নিয়মিত কাজ। প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে অন্যন্য উচ্চতায়। রান, সেঞ্চুরি, এভারেজ সবকিছু যেন তারই বন্দনা গায়। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ওয়ানডে ক্রিকেটে ১১ হাজার রানের গন্ডি পার করা কোহলি তার সমসাময়িকদের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে।
ব্যাটিংয়ে যেন সে মুক্তা ছড়ায়। ক্রিকেট মাঠ যদি হয় রং-তুলির ক্যানভাস, তাহলে বিরাট কোহলি হলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, যে প্রতিটি কাভার ড্রাইভ, এক্সট্রা কাভার ড্রাইভ, ফ্লিকের মাধ্যমে মাঠের মধ্য আঁকেন মোনালিসা। তার কাভার ড্রাইভের প্রেমে পরেনি এমন ক্রিকেটপ্রেমী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
গত একদশকে কোহলি ছাড়িয়ে গেছেন সকলকে, হয়েছেন ক্রিকেটের একদশকে (২০১০ সালে) সবচেয়ে বেশি (২০ হাজার রান) রানের মালিক। যা অতীতের পন্টিং, ক্যালিস, টেন্ডুলকারদের একদশকে অর্জন করা রানের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, অতীতে কোন ক্রিকেটারই একদশকে এতো রান করতে পারেননি।
ক্রিকেটের এক পঞ্জিকা বর্ষে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহের তালিকায় আছেন তিন নম্বরে। এক মাত্র প্লেয়ার হিসেবে করেছেন পরপর দুই বছর (২০১৭-১৮ সাল) ২৭০০+ রান। এদিকে আইপিলের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রান (৯৭৩) সংগ্রহক এবং সবার আগে পাঁচ হাজার রানের ক্লাবে প্রবেশ।
এখন পর্যন্ত তার সেঞ্চুরির সংখ্যা সত্তর। ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪৩ এবং টেস্টে ২৭। ওয়ানডেতে কোহলির ৪৩ সেঞ্চুরির মধ্যে ৩৬টিতেই ভারতের জয় এসেছে। এর মধ্যে রান তাড়া করতে গিয়ে করেছেন সর্বাধিক ২৬টি সেঞ্চুরি। যার জন্য তাকে চেজিং মাস্টার বলেও ডাকা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি কন্ডিশনে সেঞ্চুরি, ইংল্যান্ডে সুইং অনুকূল কন্ডিশনে সেঞ্চুরি, অস্ট্রেলিয়ার বাঘা বাঘা পেস আক্রমণের সামনে সেঞ্চুরি, আর বাকি আছে কী? শামীম চৌধুরীর ভাষ্যমতে, সেঞ্চুরি তার কাছে ‘ডাল-ভাত’।
তবে শচীনের সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি ধরতে হলে এখানও পাড়ি দিতে হবে অনেক দূর। নামটা কোহলি বলেই এমন আশা করি, প্রতিনিয়ত যে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তার কাছ থেকে একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে সেই আশাও রাখতে পারি।
ক্রিকেটের যেকোন এক ফরম্যাটে ৫০+ এভারেজেরের প্লেয়ার খুঁজলে পাওয়া যাবে ৮৪/৮৫ জন। যেকোন দুই ফরম্যাটে ৫০+ এভারেজের প্লেয়ার খুঁজলে পাওয়া যাবে ৩ জন। তবে তিন ফরম্যাটেই ৫০+ এভারেজের প্লেয়ার খুঁজলে একটেই নাম আসবে, সেটি হলো- বিরাট কোহলি। পরিসংখ্যান যাকে নিয়ে কথা বলে, যে নিজে পরিসংখ্যান তৈরি করে, তাকে বিশ্লেষণ করার চাইতে উপভোগ করা শ্রেয়।
মাঠের কোহলি আর ব্যক্তি কোহলি যেন সম্পূর্ণ আলাদা জগতে বিচরণ করেন। সবার চোখে অ্যারোগেন্ট কোহলিই দর্শকদের বুলিং থেকে স্মিথকে রক্ষা করে জিতে নেয় ‘আইসিসি স্পিরিট অফ ক্রিকেট অ্যাওয়ার্ড’। আবার কখনো প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের চিকিৎসার জন্য মাঠ ডেকে পাঠান নিজেদের ফিজিওকে। এর থেকে ভালো স্পোর্টসম্যানশিপ কী হতে পারে, আমার জানা নেই।
তারপরও তার আগ্রাসন নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বলবো, সবাই যে লারা, দ্রাবিড় হবে এমনটি কোথায় লিখা আছে? থাক না কিছু প্লেয়ার বিরাট কোহলিদের মতো। ক্রিকেট নামের এই জেন্টেলম্যানস গেমটাকে যে তাদের মধ্যে দিয়েই পরিপূর্ণতা পায়।
এতক্ষন যে মানুষটার কথা বললাম সে মানুষটির আজ (৫ নভেম্বর) জন্মদিন। ৩২ বছরে পা রাখলেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। ভারতীয় ক্রিকেটের এ পোস্টার বয়কে জানাই জন্মদিনের বিশেষ শুভেচ্ছা, ‘শুভ জন্মদিন বিরাট কোহলি’।
লেখক : রাব্বি খান
[sportsmail24.com এর ওয়েবসাইট এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও ব্রাউজ করে পড়তে পারবেন। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস থেকেও খেলাধুলার সকল নিউজ পড়তে পারবেন। ইনস্ট্রল করুন স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস ]