জীবন আর জীবনের গল্পগুলো যেন একটু অদ্ভুদ রকমের। সময়ের বিবর্তনে বদলে যায় জীবনের দৃশ্যপট, বদলে যায় জীবনের গল্পগুলো। আমরা প্রায়শই শুনতাম মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়। সেই স্বপ্নের পথে হাঁটলে শত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়েও নাকি সেই স্বপ্নের গল্পগুলো বাস্ততায় রূপ নেয়। তেমনটাই হয়েছে সোমালিয়ায় জন্ম নেওয়া এক নারীর ক্ষেত্রে।
জাওয়াহির রোবেল, ডাকনাম জেজে। নামটা বেশ অপরিচিত, অপরিচিত হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ তার জীবন, জীবনের গল্প কিংবা স্বপ্নের গল্প নিয়ে খুব বেশি একটা চর্চা হয়নি। তবে এখন নিজেকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তাতে তাকে নিয়ে চর্চা না করে উপায় নেই।
জাওয়াহির রোবেলের জন্মস্থান সোমালিয়া। আপনারা যারা খবরে পাতায় কিংবা টিভি স্ক্রিনে বাইরের দেশের খোঁজ খবর রাখেন তারা হয়তো বেশ ভালোভাবেই সোমালিয়া সম্পর্কে অবহিত আছেন। আফ্রিকা অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক দেশ সোমালিয়া। শান্তি ও সমৃদ্ধিতে যে দেশ ছিল আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড, আজ সেই দেশ এক বিভীষিকার নাম। সোমালিয়ার নাম শুনলেই সবার চোখে ভাসে যুদ্ধ বিগ্রহ আর জলদস্যুদের কথা।
যুদ্ধ বিগ্রহ আর জলদস্যুদের দেশে জন্ম নেওয়া জাওয়াহির রোবেল গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে মাত্র ১০ বছর বয়সে সোমালিয়া ছেড়ে পাড়ি জমান লন্ডনে। ১৬ বছর আগে সোমালিয়া ত্যাগ করা রোবেলের বয়স এখন ২৬ বছর। সোমালিয়ার মতো দেশে জন্মগ্রহণ করেও স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন পেশাদার ফুটবলার হবেন।
তবে সময়ের সাথে পরিবর্তন আসতে চিন্তা-ভাবনার। পরে ভাবতে লাগলেন শুরুর দিকে কিছুদিন ফুটবল খেলে পরবর্তীতে রেফারি হিসেবে কাজ করবেন। যেই কথা সেই কাজ। শুরুর দিকে স্থানীয় ক্লাবগুলোতে রেফারি হিসেবে কাজ করলেও এখন দায়িত্ব পালন করছেন ইংলিশ ফুটবল লিগে।
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি ইংলিশ ফুটবল লিগের প্রথম মহিলা মুসলিম রেফারি হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন। রোবেলের স্বপ্ন , তিনি একদিন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা পরিচালনা করবেন। স্থানীয় ক্লাবে কাজ করে ইংলিশ ফুটবল লিগের মতো জায়গায় কাজ করা পথটা খুব একটা সহজ নয়। তবে যারা তাকে এই সুযোগ দিয়েছে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আমি স্থানীয় ক্লাবগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করি। পরে একদিন একটি বালিকা লিগ চলাকালিন সময়ে কিছু লোকজন বললো, তাদের খেলা পরিচালনার করার জন্য পর্যাপ্ত রেফারি নেই। আমি রেফারি হতে চাই কি-না। আমি রাজি হলাম। আমি ফুটবলকে ভালবাসি, খেলার নিয়মগুলোকেও ভালবাসি। যারা আমাকে এই কাজ করতে সুযোগ দিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ। তারা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।’
বর্তমানে রেফারি হিসেবে কাজ করলেও শুরুর ভাবনাটা ছিল ভিন্ন রকম। যেখানে তিনি ভেবেছিলেন শুরুর দিকে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করবেন, তারপর রেফারি হওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাবেন। সে পরিকল্পনা মাথায় রেখে একটি স্থানীয় ক্লাবে ফুটবলার হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেলেও বাবা-মার বাঁধায় তাতে যোগ দিতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে খেলোয়ার হিসেবে স্থানীয় একটি ক্লাব থেকে প্রস্তাব পাই। কিন্তু তাতে আমার বাবা-মা বাঁধা দেয়। তারা চেয়েছিল আমি যেন অন্য মেয়েদের মতো সাধারণ জীবনযাপন করি। তবে আমার স্বপ্ন ছিল একজন পেশাদার ফুটবলার হওয়া। আর খেলোয়াড়ী জীবন শেষে রেফারি হওয়া। কিন্তু আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে, আমি এখন যা হতে পেরেছি তাতে আমি সন্তুষ্ট।’
পড়াশোনা শেষ হওয়ায় লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সেই সাথে ফিট রাখতে প্রতিদিন ব্যায়ামও করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য আমাকে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হয়। জিমে আমি প্রচুর ঘাম ঝরাই। আমার পড়াশোনা শেষ আর তাই এখন আমার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য যা যা প্রয়োজন আমি এখন তাই করছি।’
তবে খেলা পরিচালনা করতে গিয়ে নানাসময় রোবেল ব্যতিক্রম সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকেই তাকে দেখে অবাক হন। আবার মাঝে মাঝে অনেক খেলোয়াড় তাকে অপমানও করে ফেলেন। রোবেল বলেন, ‘মাঠে খেলোয়াড়েরা আমার হিজাব দেখে অবাক হয়ে যায়। আমার খেলা পরিচালনার প্রথম যেদিন আমি মাঠে যাই, সেদিন রেফারির জামা পরে যাইনি। পরে কর্মরত ব্যক্তির কাছে গিয়ে যখন রেফারির জামা চাইলাম তখন তিনি রীতিমত অবাক হলেন। তিনি বললেন, এটা অসম্ভব। আপনি কি সত্যিই রেফারি?
সময়েল সাথে সাথে এগুলো তিনি মানিয়ে নিয়েছেন। আর এখন সবার অবাক হওয়া দেখে বেশ মজা পান তিনি। তিনি বলেন, ‘তার এমন অবাক হওয়া দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। আমি ভাবতাম, তারা কেন আমাকে দেখে অবাক হবে! তবে এখন আমি মানিয়ে নিয়েছি। এখন বরং তাদের অবাক হওয়া দেখে আমি মজা পাই। মাঝে মাঝে খেলার মাঠে খোলোয়াড়রা আমাকে দেখে বলে, এটাতো পুরুষদের খেলা। তখন আমি তাদের বলি, এটা পুরুষদের খেলা এবং নারীদের খেলা। তুমি এসব না বলে খেলায় মনোযোগ দাও আর গোল করো। তবে খেলা শেষে তাদের অনেকে আমার কাছে ক্ষমা চায়।’
রোবেলের মতে, মানুষের দুর্বলতা ও অন্যদের সাথে তা প্রকাশ করার মাধ্যেই তার শক্তি লুকিয়ে থাকে। রোবেল বলেন, দুর্বলতা প্রকাশ মানেই পৃথিবীর শেষ কথা না। বরং এ থেকে তারা শক্তি পেতে পারে যাতে করে নিজেদের আরো গতিশীল ও শক্তিশালী করতে পারে। কষ্ট ছাড়া পৃথিবীতে কিছু অর্জন করা যায় না। আমি যতটা সম্ভব কমবয়সী মেয়েদের অনুপ্রাণিত করতে চাই।’
[sportsmail24.com এর ওয়েবসাইট এখন sportsmail.com.bd ঠিকানাতেও ব্রাউজ করে পড়তে পারবেন। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস থেকেও খেলাধুলার সকল নিউজ পড়তে পারবেন। ইনস্ট্রল করুন স্পোর্টসমেইল২৪.কমের অ্যাপস