ম্যাচটি ছিল আন্তর্জাতিক টি-২০ ক্রিকেটের হাজারতম ম্যাচ। এ ম্যাচে অংশ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই নাম লিখিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এমন একটি ম্যাচে স্বাগতিক ভারতকে হারিয়ে আরেক ঐতিহাসিক জয়ের জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ।
তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে রোববার (৩ নভেম্বর) মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং নৈপুণ্যে স্বাগতিক ভারতকে ৭ উইকেটে হারালো সাকিব-তামিম বিহীন বাংলাদেশ। এ জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল মাহমুদউল্লাহর দল।
টি-২০ ক্রিকেটে এ প্রথমবারের মত ভারতকে হারের লজ্জা দিল বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্ত ভার্সনের হাজারতম ম্যাচে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৪৮ রান সংগ্রহ করে ভারত। জবাবে ৩ বল এবং ৭ উইকেট হাতে রেখেই দুর্দান্ত এক জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ।
দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং বেছে নেয় বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে নেমে ইনিংসের প্রথম বলেই বাউন্ডারি মারেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। পেসার শফিউল ইসলামের একই ওভারের চতুর্থ বলেও বাউন্ডারি আদায় করে নেন রোহিত। এ বাউন্ডারির সাথে সাথে টি-২০ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের মালিক বনে যান তিনি। তবে ওভারের শেষ বলে রোহিতকে লেগ বিফোর ফাঁদে ফেলেন শফিউল। রিভিউ নিয়ে বাঁচতে পারেননি রোহিত। আউট হওয়ার সময় ভারতীয় অধিনায়কের রান ছিল ৫ বলে ৯।
এরপর লোকেশ রাহুলকে নিয়ে রানের চাকা ঘুড়াতে থাকেন আরেক ওপেনার শিখর ধাওয়ান। তবে দু’জনের রান তোলার গতি ছিল বেশ মন্থর। পাওয়ার প্লেতে ১ উইকেট হারিয়ে ৩৫ রান পায় ভারত। পাওয়ার প্লে শেষে পরের ওভারের তৃতীয় বলে ভারত শিবিরে আঘাত হানেন লেগ-স্পিনার আমিনুল ইসলাম। ২টি চারে ১৭ বলে ১৫ রান করে সাজঘরে ফিরেন রাহুল। ধাওয়ানের সাথে দ্বিতীয় উইকেটে ২৬ রান যোগ করেন রাহুল।
রাহুলের বিদায়ে ক্রিজে ধাওয়ানের সঙ্গী হন শ্রেয়াস আইয়ার। ক্রিজে গিয়েই মারমুখী মেজাজে শুরু করেন তিনি। স্পিনার আমিনুলকে দু’টি ছক্কাও মারেন তিনি। পরে বাংলাদেশের মিডিয়াম পেসার সৌম্য সরকারকে বাউন্ডারি মেরে বড় ইনিংস খেলার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন আইয়ার। তবে ১১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে আমিনুলকে আবারও ছক্কা মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনের কাছাকাছি ক্যাচ দেন তিনি।
ক্যাচটি দক্ষতার সাথেই লুফে নেন অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা মোহাম্মদ নাইম। ১৩ বলে ২২ রান করে ফিরেন আইয়ার। তৃতীয় উইকেটে ২৩ বলে দলকে ৩৪ রান উপহার দেন ধাওয়ান-আইয়ার। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে থাকা ধাওয়ান হাফ-সেঞ্চুরির পথেই হাটচ্ছিলেন। তবে ব্যক্তিগত ৪১ রানে রান আউটের ফাঁদে পড়েন ধাওয়ান।
ধাওয়ানের বিদায়ে উইকেটে যান ভারতের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামা শিবম দুবে। বাঁ-হাতি এ ব্যাটসম্যান হতাশ করেছেন। মাত্র ১ রান করে বাংলাদেশের স্পিনার আফিফ হোসেনের শিকার হন দুবে। নিজের বলেই নিজেই ক্যাচ নেন আফিফ। ফলে ১০২ রানে পঞ্চম উইকেট হারায় ভারত। এ অবস্থায় ভারত তাকিয়ে ছিল স্বীকৃত ব্যাটসম্যান ও উইকেটরক্ষক ঋষভ পান্থের দিকে।
তবে বাংলাদেশ বোলারদের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে কারণে ঝড়ো গতিতে রান তুলতে পারেননি পান্থ। ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে পান্থকে থামিয়ে দিয়ে ভারতের রানকে নাগালের মধ্যে রাখার পথ তৈরি করেন পেসার শফিউল। ৩টি চারে ২৬ বলে ২৭ রান করেন পান্থ। পান্থ যখন ফিরেন তখন ভারতের স্কোর ১২০। বল বাকি ছিল ১০টি বল।
বাকি ১০ বলে ভারতের বেশি রান তোলার সুযোগ ছিল না। কারণ, তখন ক্রিজে দুই টেল-এন্ডার ক্রুনাল পান্ডিয়া ও ওয়াশিংটন সুন্দর। কিন্তু ব্যাট হাতে শেষ ১০ বলে ঝড় তুলেন ক্রুনাল-সুন্দর। ২টি করে চার-ছক্কায় ২৮ রান তুলেন তারা। ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৪৮ রানের লড়াই করার পুঁজি পায় ভারত। বাংলাদেশের শফিউল-আমিনুল ২টি করে ও আফিফ ১টি উইকেট নেন।
জয়ের জন্য ১৪৯ রানের লক্ষ্যে প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই বাউন্ডারি মারেন বাংলাদেশের ওপেনার লিটন দাস। কিন্তু পঞ্চম বলেই থেমে যান তিনি। ভারতের পেসার দীপক চাহারের বলে আলগা শটে কাট করতে গিয়ে ক্যাচ দেন লিটন। ৪ বলে ৭ রান করেন এ ডান-হাতি ব্যাটসম্যান।
দলীয় ৮ রানে লিটন আউট হলেও আত্মবিশ্বাসে ছেদ পড়েনি অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা মোহাম্মদ নাইম ও সৌম্য সরকারের। পরিস্থিতির সাথে দ্রুত মানিয়ে নিয়ে দ্রুতই রান তুলতে থাকেন তারা। পাওয়ার প্লে’তে ৪৫ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। তবে ৯ রান পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান নাইম-সৌম্য।
ঠান্ডা মেজাজে দুর্দান্ত খেলতে থাকা নাইম থামেন ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে। স্পিনার যুজবেন্দ্রা চাহালের বলে আউট হওয়ার আগে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ২৮ বলে ২৬ রান করেন নাইম। দ্বিতীয় উইকেটে সৌম্য-নাইম ৪২ বলে ৪৬ রান করেন নাইম।
নাইম বিদায় নিলে ক্রিজে আসেন মুশফিকুর রহিম। সৌম্যর সাথে বোঝাপড়াটা ভালোভাবে করে ফেলেন তিনি। তবে ধীরলয়ে রান তোলার কাজ সাড়ছিলেন মুশফিক-সৌম্য। বলের পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছিলেন দু’জনে। এমন অবস্থায় ১৬তম ওভারে গিয়ে শতরানে পৌঁছায় বাংলাদেশের স্কোর। ফলে শেষ ৪ ওভারে ম্যাচ জয়ের জন্য সমীকরণ কঠিনই হয়ে যায় টাইগারদের। ২৪ বলে ৪৪ রান দরকার পড়ে বাংলাদেশের।
১৭তম ওভারের প্রথম ছক্কা মেরে সমীকরণ কমানোর পথ বের করেন মুশফিক। কিন্তু ঐ ওভারের শেষ বলে সৌম্যর উইকেট উপড়ে ফেলেন ভারতের বাঁ-হাতি পেসার খলিল আহমেদ। ১টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৫ বলে ৩৯ রান করেন সৌম্য। মুশফিকের সাথে সৌম্যর জুটিটি ছিল ৫৫ বলে ৬০ রানের।
সৌম্যকে হারানোর পর শেষ ১৮ বলে ৩৫ রান প্রয়োজন পড়ে বাংলাদেশের। ১৮তম ওভারে চাহালের বলে কট আউটের হাত থেকে বেঁচে যান মুশফিক। তারপরও ২টি বাউন্ডারিতে ঐ ওভার থেকে ১৩ রান তুলেন মুশফিক ও অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। দু’জনে ১টি করে বাউন্ডারি মারেন। জয়ের জন্য শেষ ১২ বলে ২২ রান দরকার পড়ে বাংলাদেশের।
১৯তম ওভারের বল হাতে আক্রমণে আসেন ভারতের পেসার খলিল। প্রথম ২ বল থেকে ২ রান নিলেও তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ বল পর্যন্ত চারটি চার মারেন মুশফিক। অর্থাৎ ঐ ওভারে ১৮ রান পায় বাংলাদেশ। ফলে শেষ ওভারে ৪ রান প্রয়োজন পড়ে বাংলাদেশের। খলিলকে পরপর চারটি চার মেরে টি-২০ ক্যারিয়ারে পঞ্চম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেন মুশফিক।
ম্যাচ হাত থেকে ফসকে যাওয়ায় শেষ ওভারটি দুবের হাতে তুলে দেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত। প্রথম বলে রান না দিলেও দ্বিতীয় বলে ২ রান নেন মাহমুুদউল্লাহ। আর তৃতীয় বলটি ওয়াইড করেন দুবে। স্কোর লাইন হয় সমান। পরের ডেলিভারিতে ছক্কা মেরে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন মাহমুদউল্লাহ।
৮টি চার ও ১টি ছক্কায় ৪৩ বলে অপরাজিত থাকেন ৬০ রান করা মুশফিক। ১টি করে চার-ছক্কায় ৭ বলে অপরাজিত ১৫ রান করেন মাহমুদউল্লাহ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত : ১৪৮/৬, ২০ ওভার (ধাওয়ান ৪১, পান্থ ২৭, আইয়ার ২২, আমিনুল ২/২২)
বাংলাদেশ : ১৫৪/৩, ১৯.৩ ওভার (মুশফিক ৬০*, সৌম্য ৩৯, চাহার ১/২৪)।
ফল : বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা : মুশফিকুর রহীম (বাংলাদেশ)
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ।