এই ইংল্যান্ডকে কি আপনি কিভাবে বর্ণনা করবেন! কোনোভাবেই কি বর্ণনা করা সম্ভব হবে কি! হয়তো হবে বা হয়তো হবে না! কিন্তু ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ বলেন, আর ক্রিকেটপ্রেমী হন এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এই ইংল্যান্ড দল টেস্ট ক্রিকেটের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে বা দিচ্ছে।
টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করতে প্রত্যেক দলেরই মনে একটা জুজু কাজ করে! অনেকেই হয়তো প্রথমে জয়ের লক্ষ্যে খেললেও মাঝ পথে সে লক্ষ্য থেকে সরে আসে। তখন আবার ড্র-এর জন্য খেলে।
তবে জনি বেয়ারস্টো, জো রুটদের ইংলিশ দলকে দেখে বাকি দলগুলোর মানসিকতায় প্রভাব পড়বে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। টেস্ট ক্রিকেটের নতুন যুগে পথ দেখাচ্ছে ইংল্যান্ড, বাকিদের সময় তাদের অনুসরণ করার, যদিও না করলেও কিছু বলবে না কেউ!
২০২১ সালে ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের পাঁচ ম্যাচের সিরিজ শুরু হয়েছিল। করোনা বাধায় চার ম্যাচ খেলে তখন সিরিজ শেষ না করেই দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। বাকি থেকে যাওয়া এক ম্যাচে শুক্রবার (১ জুলাই) এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড।
এজবাস্টনে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচে বর্ণবাদের অভিযোগ
জনি বেয়ারস্টো ও জো রুটের দাপটিয় সেঞ্চুরিতে ভারতের বিপক্ষে ৩৭৮ রান তাড়া করে সাত উইকেটে জিতেছে ইংল্যান্ড। ইতিহাসে ইংলিশদের এটাই সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড। একই সাথে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা সিরিজে সমতা ফিরিয়েছে ইংলিশরা।
এর আগের সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম, অধিনায়ক বেন স্টোকসের অধীনে নতুন যুগ শুরুর বার্তা দিয়েছিল ইংল্যান্ড। প্রথম সিরিজেই প্রতিআক্রমণ করে নিজেদের যে আগমনী বার্তা দিয়েছিল সেটা ভারতের বিপক্ষেও বজায় রাখার কথা বলেছিলেন অধিনায়ক বেন স্টোকস।
অধিনায়কের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন দলের বাকি ইংলিশ সদস্যরা। প্রথম ইনিংসে যদিও ভারতের বিপক্ষে ১৩২ রানে পিছিয়ে থেকেই অলআউট হয়েছিল ইংল্যান্ড। এমনকি তৃতীয় দিন শেষে ভারতের থেকে বেশ অনেকখানিই পিছিয়ে ছিল স্বাগতিকরা।
কিন্তু চতুর্থ দিনের শুরুতেই ভারতকে অল্পতেই অলআউট করে ম্যাচে ফেরে ইংলিশরা। যদিও ইংলিশদের সামনে ৩৭৮ রানের বড় লক্ষ্য ছুড়ে দিয়েছিল সফরকারীরা। যদি পরিসংখ্যান দেখেন, তাহলে এই লক্ষ্যটা ইংল্যান্ডের জন্য পাহাড়সমান! কারণ এর আগে সর্বশেষ সর্বোচ্চ ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৫৯ রানের বেশি লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছিল তারা।
কিন্তু বর্তমান ইংল্যান্ড দলের জন্য কোনো রান তাড়া করাই যে অসম্ভব নয়। এই সিরিজের আগে ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা তিন ম্যাচে ২৫০ রানের বেশি লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছে ইংল্যান্ড।
৩৭৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে দুই ওপেনারের সৌজন্যে আক্রমণাত্মক শুরু পেয়েছিল ইংল্যান্ড। শুরু থেকেই সাড়ে চার করে রান তুলে ভারতীয় বোলারদের আগাম বার্তা দিয়েই রেখেছিলেন ইংলিশ দুই ওপেনার জ্যাক ক্রাউলি ও অ্যালেক্স লিচ।
৪৯ বছরের পুরোনো রেকর্ডে ভাগ বসালেন ঋষভ
তবে ইনিংসের মাঝে আচমকা ধাক্কা খেয়েছিল ইংলিশ শিবির। মাত্র তিন রানের ব্যবধানে তিন উইকেট হারায় তারা। তখন হয়তো ভারতীয় দল ভেবেছিল এই বুঝি ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া গেলো!
তবে তাদের জন্য যমদূত হয়ে উইকেটে সেটে গিয়েছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে রান ম্যাশিনে পরিণত হওয়া ইংলিশ ব্যাটার জো রুট ও জনি বেয়ারস্টো। দুজনে মিলে ভারতীয় বোলারদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেঙে চুরমাড় করে দিয়েছেন।
চতুর্থ দিনে দুজনের ব্যাটিংয়ে সামনে রীতিমতো অসহায় লেগেছে ভারতীয় বোলারদের। অবশ্য তাদেরই বা দোষ কি! ইংলিশ ব্যাটারদের সামনে সাম্প্রতিক সময়ে যে কোনো বোলারই নিজেকে হতাভাগা মনে করতে পারেন!
দুজনে মিলে চতুর্থ দিনের শেষ ৩৩ ওভারে রান তুলেছেন ১৫০। তৃতীয় দিন শেষে ম্যাচটাকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে আজ না জিতলেই বরং অঘটন মনে হতো।
চতুর্থ দিনে সিরিজ বাঁচাতে, ম্যাচ জিততে এবং ইতিহাস গড়তে ইংলিশদের প্রয়োজন ছিল ১১৯ রান। যেটা এই ইংলিশ দলের কাছে সামান্যই বটে!
হলোও তাই! চতুর্থ দিনে প্রথম সেশনেই কাজ সেরে ফেলেছেন দুই ব্যাটার। যদি মন পড়া যেত তাহলে হয়তো ভারতীয় বোলারদের মন পড়ে বলে দেওয়া যেত তারা এটাই ভাবছেন, ‘কেন আজ মাঠে আসলাম।’
ভাবার কারণ হচ্ছে জো রুট ও জনি বেয়ারস্টো নামের দুই ইংলিশ ব্যাটার। জো রুট তো রীতিমতো ভারতের বোলারদের পাড়ার বোলার বানিয়ে ছেড়েছেন। জনি বেয়ারস্টোকে সঙ্গে নিয়ে বুমরাহ, শামীদের নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলেন।
সাদা পোশাকে রঙিন পোশাক আরও নির্দিষ্ট করে বললে এদিন যেন টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমেছিলেন দুই ইংলিশ ব্যাটার।
নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান ম্যাচ ফি দিবে নিউজিল্যান্ড
৩১৬ বলে ২৬৯ রানের জুটি গড়েছেন রুট ও বেয়ারস্টো। দুজনে যেন রান করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন এই ম্যাচে। দুইজনের পাল্লায় ভুক্তভোগী হয়েছেন ভারতের বোলাররা। তারা যেন এদিন বুঝতেই পারছিলেন না ঠিক কোন জায়গায় বল করলে থামানো যাবে দুই ইংলিশ ব্যাটারকে!
দুজনেই চতুর্থ দিন শেষ করেছিলেন অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরি তুলে। আজ সকালেই ভারততের বোলারদের পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে দুজনেই সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন। ৭১ বলে প্রথম হাফসেঞ্চুরি করা রুট সেঞ্চুরি করেন ১৩৬ বলে। তাকে বল করলেই সেটা অবলীলায় রানে পরিণত করছিলেন তিনি।
অন্যপ্রান্তে এই অবিশ্বাস্য জুটির আরেক পিলার জনি বেয়ারস্টো গতকাল হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন ৭৫ বলে, আজ সেঞ্চুরি করেছেন ১৩৮ বলে।
নতুন কোচের অধীনে ইংলিশ ব্যাটারদের মানসিকতা ঠিক কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তার বাস্তব প্রমাণ জো রুট। সারাজীবন ক্রিকেটিয় ব্যাকরণ মেনে ব্যাটিং করা রুট এখন সাদা পোশাকে প্রায় প্রতি ম্যাচেই রিভার্স সুইপ খেলছেন! শুধু খেলছেনই না বলটাকে অবলীলায় উড়িয়ে ফেলাচ্ছেন মাঠের বাইরে।
এমনকি আজকের জয়ের শেষ রানটাও এসেছে রিভার্স সুইপেই। ৭৬তম ওভারে রবীন্দ্র জাদেজার বলে রিভার্স সুইপে ঠিকমতো টাইমিং করতে না পারলেও একটা সিংগেল ঠিকই এসেছে। আর তাতেই ইংল্যান্ড একই সাথে সিরিজ বাঁচিয়েছে, ম্যাচ জিতেছে এবং ইতিহাস গড়েছে।
এদিকে প্রথম ইনিংসে বড় লিড নিয়ে হারের তালিকায় আরও একটি ম্যাচ যোগ হলো ভারতের। এর আগে ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গলে প্রথম ইনিংসে ১৯২ রানের লিড নিয়েও হেরেছিল তারা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩২ রানের লিড নিয়েও হারটা এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকছে।
তবে আরেকটি লজ্জার তালিকায় এই ম্যাচ প্রথম স্থানেই জায়গা পেয়েছে। ১৯৭৭ সালে পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৩৯ রানের টার্গেট দিয়েও ম্যাচ হেরেছিল ভারত। এবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৭৮ রান টার্গেট দিয়ে সেই রেকর্ডের উপরে এই ম্যাচকে নিয়ে গেল তারা।
স্পোর্টসমেইল২৪/এসকেডি