ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশের যুবারা। টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। বোলারদের দুর্দান্ত নৈপুন্যের পর অধিনায়ক আকবর আলির অপরাজিত ৪৩ রানের সাথে ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমনের ৪৭ রান বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত বিশ্ব মঞ্চে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরায়।
রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে অনুষ্ঠিত ম্যাচে টস জিতে প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর আলী। টস জিতে বোলিং নেওয়ার কারণটা এভাবে ব্যাখা করেন আকবর, ‘দিনের শুরুতে উইকেটের ময়েশ্চার কাজে লাগাতেই এমন সিদ্বান্ত।’
বল হাতে বাংলাদেশের হয়ে বোলিং শুরু করেন দুই উদ্বোধনী পেসার শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব। প্রথম ছয় ওভারে ভারতের দুই ওপেনারকে রানই করতে দেননি শরিফুল ও সাকিব। মাত্র ৮ রান তুলতে পারেন ভারতের দুই ওপেনার যশবী জয়সওয়াল ও দিব্যানাশ সাক্সেনা।
সাকিব ৩ ওভারে ১ ও শরিফুল ৩ ওভারে ৭ রান দেন। দুই উদ্বোধনী বোলার সাফল্য এনে দিতে না পারায় সপ্তম ওভারে অভিষেকের হাতে বল তুলে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর। বল হাতে নিয়েই চতুর্থ ডেলিভারিতে সাফল্যের স্বাদ নেন অভিষেক। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে মাহমুদুল হাসান জয়কে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ১৭ বলে ২ রান করা সাক্সেনা।
দলীয় ৯ রানে প্রথম উইকেট পতনের পর আরেক ওপেনার জয়সওয়াল ও তিন নম্বরে নামা তিলক ভারমার ব্যাটিং দৃঢ়তায় শুরুর ধাক্কা সামলে শতরানের গন্ডি পেরোয় ভারত। তবে তাদেরকে দ্রুত রান তুলতে দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। ২৯ ওভারে যখন ভারতের দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটে তখন রান ১০৩। জয়সওয়াল ও ভারমার জমে যাওয়া জুটিতে ভাঙন ধরান সাকিব। ৬৫ বলে ৩টি চারে ৩৮ রান করে আউট হন ভারমা। দ্বিতীয় উইকেটে ১৩৪ বল মোকাবেলা করে ৯৪ রান যোগ করেন তারা।
ভারমার আউটে ক্রিজে যান অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গ । উইকেটের সাথে সেট হওয়ার আগেই তাকে বিদায় দেন এ আসরে বাংলাদেশের পক্ষে হ্যাটট্রিক করা রকিবুল হাসান। ৭ রান করেন গার্গ। এতে ১১৪ রানে তৃতীয় উইকেট হারায় ভারত।
সতীর্থরা এক প্রান্ত দিয়ে পতনের তালিকায় নাম তুললেও অন্যপ্রান্ত দিয়ে সতর্কতার সাথে রান তোলার কাজটি সাড়ছিলেন সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা জয়সওয়াল। ৮৯ বলে হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি। হাফ-সেঞ্চুরির পর মারমুখী হয়ে উঠে তাই পরের ৩২ বলে ৩৮ রান যোগ করে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরির পথে ছিলেন জয়সওয়াল।
তবে ব্যক্তিগত ৮৮ রানে থামতে হয় জয়সওয়ালকে। শরিফুলের ১৩০ কিলোমিটার গতি বাউন্সার কিভাবে মারবেন সেই দোটানায় ভুগে শর্ট মিড উইকেটে তানজিদ হাসানকে ক্যাচ দেন জয়সওয়াল। ১২১ বল খেলে ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় নিজের দায়িত্ববান ইনিংসটি সাজান জয়সওয়াল।
জয়সওয়ালকে বিদায় করার পরের ডেলিভারিতে সিদ্বেশ বীরকে লেগ বিফোর ফাঁদ ফেলেন শরিফুল। ফলে শূন্য হাতে ফিরতে হয় ভিরকে।
জয়সওয়ালের আউটটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতের জন্য। কারণ ২১ রানে শেষ ৬ উইকেটের পতন হয় ভারতের। বীরের পর থেকে আর কোন ব্যাটসম্যানই দু’অংকের কোটা স্পর্শ করতে পারেনি। এর মধ্যে উইকেটরক্ষক ধ্রুব জুরেলের উইকেটও ছিল। ৩৮ বলে ১টি চারে ২২ রান করে রান আউট হন তিনি।
ভারতকে ৪৭ দশমিক ২ ওভারে গুটিয়ে প্রধান ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশের পেসার অভিষেক। ৪০ রানে ৩ উইকেট নেন তিনি। শরিফুল-সাকিব ২টি করে উইকেট নেন। ১টি উইকেট নিয়েছেন রকিবুল।
১৭৮ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারেই ১৩ রান তুলে নেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার ইমন ও তানজিদ হাসান। তানজিদের ব্যাট থেকে আসে ২টি চার। এরপর দেখেশুনে এগোতে থাকেন ইমন ও তানজিদ। ফলে পরের ৭ ওভারে ৩১ রান উঠাতে পারেন তারা।
প্রথম ৮ ওভারে তিন বোলার ব্যবহার করেও বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি ভাঙতে না পারায় ভারতের অধিনায়ক গার্গ নবম ওভারে লেগ-স্পিনার রবি বিশনোইকে আক্রমণে আনেন। দ্বিতীয় বলেই বিশনোইর উপর চড়াও হন তানজিদ। স্লগ সুইপে মিড-উইকেট দিয়ে ছক্কা মারেন তানজিদ। তবে পঞ্চম বলে বিশনোইকে উইকেট দেন তানজিদ। ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ২৫ বলে ১৭ রান করেন তানজিদ।
দলীয় ৫০ রানে প্রথম উইকেট পতনের পর জুটি বাঁধেন ইমন ও তিন নম্বরে নামা মাহমুদুল হাসান জয়। বড় জুটির চেষ্টায় ছিলেন তারা। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি এ জুটি। সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করা জয়কে নিজের দ্বিতীয় শিকার বানান বিশনোই। ৮ রান করেন জয়। জয়ের পর ওপেনার ইমনকেও হারায় বাংলাদেশ। তবে আউট হননি তিনি। পায়ে চোট পেয়ে আহত অবসর হয়ে মাঠ ছাড়েন ইমন। তখন তার নামের পাশে ছিলো ৪২ বলে ২৫ রান। এতে উইকেটে যান নতুন দুই ব্যাটসম্যান তৌহিদ হৃদয় ও শাহাদাত হোসেন।
নতুন দুই ব্যাটসম্যানকে উইকেটে থাকতে দেননি বিশনোই। হৃদয় শূন্য ও শাহাদাত ১ রান করে আউট হন। ফলে মাত্র ৩ রানের ব্যবধানে জয়-হৃদয়-শাহাদাতকে হারিয়ে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। ৫০ রানের সূচনার পর ৬৫ রানে ৪ উইকেট নেই বাংলাদেশের।
এ অবস্থায় দলের হাল ধরেন অধিনায়ক আকবর আলী ও শামিম হোসেন। বিশনোইর ঘূর্ণিতে পথ হারানো বাংলাদেশকে লড়াইয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেন আকবর ও শামিম। ২০ রানের জুটি গড়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন তারা। কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্ন করেন ভারতের বাঁ-হাতি পেসার সুশান্ত মিশ্র। ৭ রান করা শামিমকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান মিশ্র। এরপর অভিষেক দাস ৫ রান করে মিশ্রর শিকার হন। এমন অবস্থায় ১০২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে আবারও চাপে পড়ে বাংলাদেশ।
অভিষেকের বিদায়ে উইকেটে আসেন আহত অবসর নেওয়া ইমন। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করে অধিনায়কের সাথে বড় জুটি গড়ার চেষ্টা করেন ইমন। তাতে সফল হন দু’জনে। সপ্তম উইকেটে ৪১ রানের জুটি গড়েন বিচ্ছিন্ন হন আকবর ও ইমন। হাফ-সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়ে ৪৭ রানে থামেন ইমন। ৭টি চারে ৭৯ বল মোকাবেলা করে নিজের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসটি সাজান ইমন।
ইমন যখন ফিরেন তখন হাতে ৩ উইকেট নিয়ে জয়ের জন্য ৩৪ রান প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। বল ছিল ১০৮টি। ম্যাচের লাগাম অনেকটাই ভারতের পক্ষে ছিল। কিন্তু টেল-এন্ডার রকিবুলকে নিয়ে সতর্কতার সাথে পথ চলতে শুরু করেন অধিনায়ক আকবর। কোন প্রকার ঝুঁকি না নিয়ে উইকেটে টিকে থাকার চেষ্টা করেন আকবর ও রকিবুল। ইমনের ফিরে যাওয়ার টানা তিন ওভার কোন রানই নেননি তারা।
শেষমেষ ৩৬তম ওভারে ৪ রান তোলেন আকবর-রকিবুল। এরপর ৪১ ওভার শেষে অবিচ্ছিন্ন থেকে দলের স্কোর ১৬৩ রানে নিয়ে যান তারা। জয়ের জন্য ১৫ রান প্রয়োজন বাংলাদেশের। এ অবস্থায় নেমে আসে বৃষ্টি। বন্ধ হয়ে যায় খেলা। বৃষ্টিতে নতুনভাবে ম্যাচ জয়ের টার্গেট পায় বাংলাদেশ।
তা হলো- ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। অর্থাৎ, ৩০ বলে ৭ রান। এ কাজটুকু সাড়তে ৭ বল লাগে আকবর ও রকিবুলের। ২৩ বল বাকি রেখেই বিশ্ব জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ।
ম্যাচ সেরা বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর আলী। টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন যশবী জয়সওয়াল (ভারত)।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত : ১৭৭/১০, ৪৭.২ ওভার (জয়সওয়াল ৮৮, ভারমা ৩৮, অভিষেক ৩/৪০)
বাংলাদেশ : (টার্গেট- ১৭০ রান) : ১৭০/৭, ৪২.১ ওভার (আকবর ৪৩*, ইমন ৪৭, বিশনোই ৪/৩০)
ফল : ৩ উইকেটে জয়ী বাংলাদেশ।