ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের পর সেঞ্চুরি করেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে এড়াতে পারেননি বাংলাদেশ। ওয়ার্নারের ১৬৬ রানের সুবাদে ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ৩৮১ রান করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে মুশফিকের অপরাজিত ১০২ রানে ভর করে ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩৩৩ রান করে বাংলাদেশ। ফলে ৪৮ রানে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) নটিংহামের ট্রেন্ট ব্রিজে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। ব্যাট হাতে নেমে সর্তকতার সাথে খেলতে থাকেন অসি দুই ওপেনার ফিঞ্চ ও ওয়ার্নার। প্রথম ৪ ওভারে বিনা উইকেটে ১৮ রান করেন তারা। পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ছক্কা মেরে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেন ফিঞ্চ।
ওই ওভারের শেষ বলে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেট শিকারের সুযোগ তৈরি করেছিলেন মাশরাফি। মাশরাফির অফ-স্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্নার। ক্যাচটি তালুবন্দি করতে পারেননি পয়েন্টে থাকা সাব্বির। ফলে ১০ রানে জীবন পান ওয়ার্নার।
জীবন পেয়ে আর পেছন ফিরে তাকাননি ওয়ার্নার। অধিনায়ককে নিয়ে রানের চাকা ঘুড়িয়েছেন তিনি। ১৭তম ওভারেই শতরান পেয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। জীবন পেয়ে এবারের আসরে তৃতীয় হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নিয়েছেন ওয়ার্নার। হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন ফিঞ্চও। শেষ ১১ ইনিংসে অষ্টম হাফ-সেঞ্চুরি করলেন ফিঞ্চ।
পাঁচ বোলার ব্যবহার করেও অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেটের পতন ঘটাতে পারেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। অবশেষে ইনিংসের ২১তম ওভারে প্রথমবারের মত আক্রমণে এসে উইকেট তুলে নেন সৌম্য সরকার। ওভারের পঞ্চম বলে শর্ট থার্ড-ম্যান রুবেলের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজ ঘরে ফেরেন ৫টি চার ও ২টি ছক্কায় ৫১ বলে ৫৩ রান করা ফিঞ্চ।
দলীয় ১২১ রানে ফিঞ্চ ফিরে যাবার পর উইকেটে আসেন উসমান খাজা। ওয়ার্নারকে নিয়ে বড় জুটি গড়েন খাজা। ব্যক্তিগতভাবে ৩৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৬তম ও এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা পান ওয়ার্নার। ১১০ বলে সেঞ্চুরির পর আরও মারমুখী হয়ে ওঠেন ওয়ার্নার। ফলে নিজের মুখোমুখি হওয়া ১৩৯তম বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ষষ্ঠবারের মত দেড়শ রান করেন ওয়ার্নার। তার এমন ব্যাটিং দৃঢ়তায় ৪৩ ওভারেই ৩শ’র কাছাকাছি পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া।
এ অবস্থায় দলের স্কোরকে আরও বড় করার চেষ্টা করেন ওয়ার্নার। হাফ-সেঞ্চুরি তুলে অন্যপ্রান্তে তাকে যথার্থ সহযোগিতা দেন খাজা। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ১৬৬ রানে সৌম্যর দ্বিতীয় শিকার ওয়ার্নার। সৌম্যর স্লোয়ার বলকে আপার কাট করতে গিয়ে শর্ট থার্ড ম্যানে রুবেলের হাতে ক্যাচ দেন ওয়ার্নার। আউট হওয়ার আগে ১৪৭ বলের ইনিংসে ১৪টি চার ও ৫টি ছক্কা মারেন ওয়ার্নার।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও গড়েন ওয়ার্নার ও খাজা। বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোন উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার আগের সর্বোচ্চ রান ছিল ১৭০। ২০১১ সালে ঢাকায় দ্বিপক্ষীয় সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে দ্বিতীয় উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ১৭০ রানের জুটি গড়েন শেন ওয়াটসন ও রিকি পন্টিং।
৪৫তম ওভারের দ্বিতীয় বলে দলীয় ৩১৩ রানে থামেন ওয়ার্নার। তার বিদায়ে উইকেটে গিয়ে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ২টি চার ও ৩টি ছক্কায় অস্ট্রেলিয়াকে রানের চূড়ায় বসানোর পথ তৈরি করেন ম্যাক্সওয়েল। তার ব্যাটিং ঝড়ে সাড়ে ৩শ রানের কোটা অতিক্রম করে অসিরা। তবে রান আউটের ফাঁদে ফেলে ম্যাক্সওয়েলকে ১০ বলে ৩২ রানের বেশি করতে দেননি রুবেল হোসেন।
সৌম্যর করা ৪৭তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ম্যাক্সওয়েল ও পঞ্চম বলে আউট হন খাজা। ১০টি চারে ৭২ বলে ৮৯ রান করে আউট হন খাজা। এটি ছিল সৌম্যর তৃতীয় উইকেট। পরের ওভারের প্রথম বলে আবারও উইকেট পতন হয় অস্ট্রেলিয়ার। সাবেক অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথকে ১ রানের বেশি করতে দেননি বাংলাদেশের বাঁ-হাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। লেগ-বিফোর হন স্মিথ।
শেষ দিকে মার্কাস স্টয়িনিসের ১১ বলে অপরাজিত ১৭ ও উইকেটরক্ষক অ্যালেক্স ক্যারির ৮ বলে অপরাজিত ১১ রানের সুবাদে ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ৩৮১ রানের সংগ্রহ পায় অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ও নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ অস্ট্রেলিয়ার। সৌম্য তার ক্যারিয়ার সেরা ৮ ওভারে ৫৮ রানে ৩ উইকেট শিকার করেন। এছাড়া ৯ ওভারে ৬৯ রানে ১ উইকেট নেন মোস্তাফিজ।
৩৮৩ রানের বিশাল লক্ষ্যে খেলতে নেমে চতুর্থ ওভারেই উইকেট হারায় বাংলাদেশ। তামিম ইকবালের সাথে ভুল বুঝাবুঝিতে রান আউটের ফাঁদে পড়েন বল হাতে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে সফল বোলার সৌম্য। ২টি চারে নিজ ঢঙ্গে ইনিংস শুরু করে ১০ রানে থেমে যান তিনি।
শুরুতে সৌম্যকে হারানোর ক্ষত ভোলার জন্য খুব বেশি সময় নেননি তামিম ও তিন নম্বরে নামা সাকিব আল হাসান। তবে আস্কিং রেটের তুলনায় বেশ ধীর গতির ছিলেন তারা। তাদের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ১৮তম ওভারের চতুর্থ বলে দলের স্কোর একশ পেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু এরপরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সাকিব-তামিম।
অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়াম পেসার স্টোয়িনিসের একটি স্লো ডেলিভারি বুঝতে না পেরে মিড-অফে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ৪টি চারে ৪১ বলে ৪১ রান করা সাকিব। ফলে এবারে আসরে তার রান সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪২৫। এতে বিশ্বকাপের এক আসরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে চার শতাধিক রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব।
দলীয় ১০২ রানে সাকিব ফিরে যাবার পর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪৭ ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চতুর্থ হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন তামিম। হাফ-সেঞ্চুরির পর নিজের ইনিংসটি বড় করছিলেন তামিম। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেননি। ২৫তম ওভারের প্রথম ডেলিভারিতে অস্ট্রেলিয়ার বাঁ-হাতি পেসার মিচেল স্টার্কের বলে বোল্ড হন এ আসরে নিজের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান করা তামিম। ৬টি চারে ৭৪ বলে ৬২ রান করেন তিনি।
তামিমের বিদায়ে উইকেটে যান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অপরাজিত ৯৪ রান করা লিটন দাস। ৩টি চারে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিলেও বড় ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হন। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনার এডাম জাম্পার বলে লেগ বিফোর হবার আগে ১৭ বলে ২০ রান করেন লিটন। ২৯ দশমিক ২ ওভারে দলীয় ১৭৫ রানে চতুর্থ ব্যাটসমান হিসেবে আউট হন লিটন। এ সময় জয়ের জন্য ১২৪ বলে ২০৭ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের।
এ অবস্থায় দলের হাল ধরেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুউল্লাহ রিয়াদ। সাবলীলভাবেই রানের চাকা ঘুড়িয়েছেন তারা। তবে সেটি আক্সিং রেট থেকে বেশ কমই ছিল। ৩১ থেকে ৪০ ওভারে ৬৮ রান যোগ করেন তারা। এ ১০ ওভারের মাঝেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৫তম ও এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান মুশফিক। ৫৪ বলে অর্ধশতক পূর্ণ করেন।
তবে দলের প্রয়োজনীয়তা ছিল ধরাছোয়ার বাইরে। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন দাঁড়ায় ১৩৩ রান। অর্থাৎ ওভারপ্রতি প্রায় ১৫ রান করে। তারপরও শেষ চেষ্টায় ছিলেন পঞ্চম উইকেটে ৮৩ বলে ১০০ রান করা মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ।
জুটিতে ১০০ রান আসার পরই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২১ ও এবারের বিশ্বকাপে প্রথম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন মাহমুদউল্লাহ। ৪১ বলে হাফ-সেঞ্চুরি করেন তিনি। ৬৮ বলের জুটিতে ১০০ রান আসার পর মারমুখী হয়ে ওঠেন মাহমুদউল্লাহ। ২টি চার ও ১টি ছক্কায় রান তোলার গতি বাড়ান তিনি।
তবে ৪৬তম ওভারের তৃতীয় বলে পুল করে ডিপ স্কয়ার লেগে কামিন্সকে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন মাহমুদুউল্লাহ। ৫টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৫০ বেেল ৬৯ রান করে অস্ট্রেলিয়ার পেসার নাথান কলটার নাইল বলে আউট হন তিনি। পঞ্চম উইকেটে মুশফিকের সাথে ৯৭ বলে ১২৭ রান যোগ করেন মাহমুদউল্লাহ।
মাহমুদুউল্লাহকে বিদায় দেওয়ার পরের ডেলিভারিতে সাত নম্বরে নামা সাব্বির রহমানকে বোল্ড করেন নাইল। মোসাদ্দেকের ইনজুরিতে এবারের আসরে প্রথম খেলতে নেমেই শূন্য হাতে ফিরলেন সাব্বির। তাই দলীয় ৩০২ রানেই পঞ্চম ও ষষ্ঠ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। তখন ম্যাচের ২৬ বল বাকি। রান দরকার ৮০। যা নাগালের বাইরেই ছিল। আক্সিং রেট তখন ২০ ছুইঁছুইঁ।
শেষ ২৬ বলে বাংলাদেশের অর্জন ছিল মুশফিকের সেঞ্চুরি। ৯৫ বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরির স্বাদ পান মুশফিক। শেষ পর্যন্ত ৯৭ বলে ৯টি চার ও ১টি ছক্কায় ১০২ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি । আর ৮ উইকেটে ৩৩৩ রান করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বিপক্ষে এ জয়ে ৬ খেলা শেষে ১০ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে উঠলো অস্ট্রেলিয়া। অন্যদিকে সমান সংখ্যক ম্যাচে ৫ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চমস্থানেই থাকলো বাংলাদেশ।