চলমান ওয়ানডে বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় হারের লজ্জা পেল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৮ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ।
অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহিমের ৬৬, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অপরাজিত ৪১ ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের ৪০ রানের উপর ভর করে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৪৫ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। জবাবে ড্যারিল মিচেলের অনবদ্য ৮৯ ও অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের ৭৮ রানের সুবাদে ৪৩ বল বাকী রেখে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে নিউজিল্যান্ড।
শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) চেন্নাইয়ে এমএ চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামে টস জিতে বাংলাদেশকে প্রথমে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। একটি করে পরিবর্তন এনে একাদশ সাজায় বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড।
মাহেদি হাসানের জায়গায় বাংলাদেশ একাদশে ফিরেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। আর উইল ইয়ংয়ের পরিবর্তে দীর্ঘদিন পর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামেন নিউজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসন।
ইনিংসের প্রথম বলেই বড়সড় ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের পেসার ট্রেন্ট বোল্টের লেগ সাইডের ডেলিভারিতে ছক্কার আশায় ফ্লিক শটে ডিপ ফাইন লেগে ম্যাট হেনরির দারুন ক্যাচে বিদায় নেন ওপেনার লিটন দাস। এ নিয়ে ওয়ানডেতে ১২বার ও পাঁচবার প্রথম বলে শূন্যতে আউট হলেন লিটন।
বিশ্বকাপের মঞ্চে ষষ্ঠ ও দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম বলেই আউট হওয়ার লজ্জার রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন লিটন। লিটনের বিদায়ে তিন নম্বরে মাঠে নামেন মেহেদি হাসান মিরাজ। আরেক ওপেনার তানজিদ হাসানকে সাথে দলের রানের চাকা সচল করেন মিরাজ। এতে প্রথম বলে উইকেট হারানোর ধাক্কা কাটিয়ে ৭ ওভারে ৩৮ রান পেয়ে যায় বাংলাদেশ।
অষ্টম ওভারে তানজিদকে শিকার করে জুটি ভাঙেন পেসার লুকি ফার্গুসন। স্কয়ার লেগে ডেভন কনওয়েকে ক্যাচ দিয়ে থামেন ৪টি চারে ১৬ রান করা তানজিদ। ৮ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মত সর্বোচ্চ ১৬ রান করলেন তানজিদ। মিরাজের সাথে ৪৮ বলে ৪০ রান যোগ করেন তরুণ এ ব্যাটার।
তানজিদের মত ৪টি বাউন্ডারিতে ভালোভাবে ইনিংস শুরু করেও বেশি দূর যেতে পারেনি মিরাজ। ১২তম ওভারে ফার্গুসনের শর্ট বলে ঠিকঠাক পুল শট খেলতে না পারায় ডিপ ফাইন লেগে হেনরিকে ক্যাচ দেন ৪৬ বলে ৩০ রান করা মিরাজ। পরের ওভারে প্রথমবারের মত আক্রমনে এসেই শান্তকে তুলে নেন নিউজিল্যান্ডের অকেশনাল স্পিনার গ্লেন ফিলিপস। ১টি চারে ৭ রান করেন শান্ত।
৫৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়েছিল টাইগাররা। সেটিই সবচেয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কম রানে ৪ উইকেট হারানোর রেকর্ড বাংলাদেশের।
চাপে পড়া বাংলাদেশকে লড়াইয়ে ফেরাতে জুটি বাঁধেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। উইকেটে দ্রুত সেট হয়ে ২১তম ওভারে বাংলাদেশের রান ১শতে নেন তারা। তিন অংকে পা দেয়ার পর টাইগারদের রান তোলার গতি কমলেও, ২৮তম ওভারে ওয়ানডেতে ৪৮তম হাফ-সেঞ্চুরি করেন মুশি। বিশ্বকাপে নবম অর্ধশতক করতে ৫২ বল খেলেন তিনি।
মুশফিকের হাফ-সেঞ্চুরির পর মারমুখী হয়ে উঠেন সাবধানে খেলতে থাকা সাকিব। স্পিনার রাচিন রবীন্দ্রর করা ২৯তম ওভারে ১টি করে চার-ছক্কা মারেন তিনি। ৩০তম ওভারের চতুর্থ বলে আরও ১টি ছক্কা হাঁকান সাকিব। ফার্গুসনের পরের বলে আবারও ছক্কা মারতে গিয়ে আকাশে বল তুলে দিলে উইকেটরক্ষ টম লাথামের হাতে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন সাকিব।
৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪০ রান করেন টাইগার অধিনায়ক। এই ইনিংস খেলার পথে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় সনাথ জয়সুরিয়া, বিরাট কোহলি ও ক্রিস গেইলকে টপকে ১২০১ রান নিয়ে ষষ্ঠস্থানে উঠেছেন সাকিব।
পঞ্চম উইকেটে মুশফিকের সাথে ১০৮ বলে ৯৬ রান যোগ করেন সাকিব। বিশ্বকাপে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮বার হাফ-সেঞ্চুরির জুটি গড়লেন সাকিব-মুশফিক। এছাড়াও জুটিতে রানের দিক দিয়ে বিশ্বকাপে ১৯ ইনিংসে ৯৭২ রান নিয়ে দ্বিতীয়স্থানে উঠলেন তারা। ২০ ইনিংসে ১২২০ রান নিয়ে সবার উপরে অস্ট্রেলিয়ার এডাম গিলক্রিস্ট ও ম্যাথু হেইডেন।
সাকিব ফেরার পর মুশফিকের বিদায় নিশ্চিত করেন হেনরি। তার নিচু হওয়া বলে বোল্ড হবার আগে ৬টি চার ও ২টি ছক্কায় ৭৫ বলে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৬৬ রান করেন মুশফিক। মুশফিকের আউটের পর তাওহিদ হৃদয়কে হারিয়ে আবারও চাপে পড়ে বাংলাদেশ। বোল্টের ডেলিভারিতে এক্সট্রা কাভারে স্যান্টনারকে ক্যাচ দিয়ে ১৩ রানে ফিরেন হৃদয়। এ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ডের ষষ্ঠ বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ১০৭তম ম্যাচে ২শ শিকার পূর্ণ করেন বোল্ট।
হৃদয়ের আউটে ক্রিজে এসে ২টি ছক্কায় ১৯ বলে ১৭ রান করে আউট হন তাসকিন আহমেদ। মোস্তাফিজুর রহমান ৪ রানে আউট হলে ৪৮তম ওভারের শেষ বলে ২২৫ রানে নবম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। তখনও ক্রিজে টিকে ছিলেন আট নম্বরে নামা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
৪৯তম ওভারে বোল্টকে ও শেষ ওভারে মিচেলকে ১টি করে ছক্কা মেরে বাংলাদেশকে লড়াই করার মত পূঁজি এনে দেন মাহমুদউল্লাহ। ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৪৫ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।
তাসকিন-মোস্তাফিজ ও শরিফুল ইসলামের সাথে তিন উইকেটে ৭৪ বল মোকাবেলা করে ৬৫ রান যোগ করেন মাহমুদউল্লাহ। ২টি করে চার-ছক্কায় ৪৯ বলে ৪১ রানে অপরাজিত থাকেন অভিজ্ঞ ব্যাটার। ২ রানে অপরাজিত থাকেন শরিফুল ইসলাম।
নিউজিল্যান্ডের ফার্গুসন ৪৯ রানে ৩টি, বোল্ট ৪৫ ও হেনরি ৫৮ রানে ২টি করে এবং স্যান্টনার-ফিলিপস ১টি করে উইকেট নেন।
জয়ের জন্য ২৪৬ রানের টার্গেট দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে শুরুতেই চেপে ধরে বাংলাদেশের বোলাররা। তৃতীয় ওভারের শুরুতেই মোস্তাফিজের বলে দু’টি চার মারা রবীন্দ্র (৯) চতুর্থ ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন।
রবীন্দ্র ফেরার পর ২৬ বলে কোন চার-ছক্কা পায়নি নিউজিল্যান্ডের ব্যাটাররা। এরমধ্যে মোস্তাফিজের করা সপ্তম ওভারের দ্বিতীয় বলে কনওয়ের ক্যাচ ফেলেন মিরাজ। তখন ৪ রানে ছিলেন কনওয়ে।
পাওয়ার প্লের শেষ দিকে রানের গতি বাড়িয়ে ১০ ওভারে নিউজিল্যান্ডের স্কোর ১ উইকেট ৩৭-এ নেন কনওয়ে ও উইলিয়ামসন।
১৯তম ওভারে সাকিবের বলে তাসকিনের হাতে জীবন পান ২৭ রানে থাকা উইলিয়ামসন। একবার করে জীবন পেয়ে দ্বিতীয় উইকেটে ১০৫ বলে ৮০ রান যোগ করেন কনওয়ে ও উইলিয়ামসন। ৩টি চারে ৪৫ রান করা কনওয়েকে লেগ বিফোর আউট করে বাংলাদেশকে ব্রেক থ্রু এনে দেন সাকিব।
দলীয় ৯২ রানে কনওয়ে ফেরার পর নিউজিল্যান্ডের জয়ের পথ তৈরি করেন উইলিয়ামসন ও ড্যারিল মিচেল। ২৯তম ওভারে ওয়ানডেতে ৪৩তম হাফ-সেঞ্চুরি করেন মার্চের পর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফেরা উইলিয়ামসন। ৩৭তম ওভারে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে চতুর্থ অর্ধশতকের দেখা পান মিচেল।
উইলিয়ামসন-মিচেলের জোড়া হাফ-সেঞ্চুরিতে ৩৮ ওভারে ২ উইকেটে ১৯৮ রান পেয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। ৩৮তম ওভারে শান্তর থ্রোতে আঙ্গুলে ব্যথা পেলে পরের ওভারে আহত অবসর নেন উইলিয়ামসন। মিচেলের সাথে ১০৯ বলে অবিচ্ছিন্ন ১০৮ রান যোগ করেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক। ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় ১০৭ বলে ৭৮ রান করেন উইলিয়ামসন।
এরপর মিচেল ও ফিলিপস ১৬ বলে ২৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে ৪৩তম ওভারেই নিউজিল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করেন। ৬টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৬৭ বলে ৮৯ রানে অপরাজিত থাকেন মিচেল। ১৬ রানে অপরাজিত থাকেন ফিলিপস। বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর-সাকিব ১টি করে উইকেট নেন।