ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশনের বিষয়টি বছর দশেক আগেই ‘এক্সপায়ার’ করে গেছে বলে মনে করেন তামিম ইকবাল। তার সাফ কথা, ‘আধুনিক ক্রিকেটে এটা অত গুরুত্বপূর্ণ হলে তো ম্যাথু হেইডেন-জাস্টিন ল্যাঙ্গার এমন সফল জুটি হতো না, ওরা দুজনেই বাঁহাতি।’
বোঝাপড়া, খেলার স্টাইল আর ফর্ম—তামিমের কাছে সফল উদ্বোধনী জুটির রেসিপি এটাই। তাতে ত্রিদেশীয় সিরিজ তো বটেই, বিশ্বকাপে তার সম্ভাব্য উদ্বোধনী সঙ্গীর রেসেও লিটন কুমার দাশকে পেছনে ফেলে এখন অনেকটা এগিয়ে সৌম্য সরকার।
আবু জায়েদের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্তি যদি হয়ে থাকে চরম হেনস্তার, তাতে সৌম্যরটা পরম সৌভাগ্য। জানা গেছে, বিশ্বকাপের সম্ভাব্য দীর্ঘ তালিকায় নামই ছিল না এ বাঁহাতির। পরে অনেক যুক্তির জোরে মূল স্কোয়াডে রাখা গেছে সৌম্যকে। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে তিনশোর্ধ্ব ইনিংস খেলতে লিটনের মতো সৌম্যকেও দরকার। মাহমুদ উল্লাহর বোলিং করা নিয়ে সংশয়ের ফাঁকতালে ভদ্রগোছের মিডিয়াম পেস বোলিংও তাঁর পক্ষে গেছে।
তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রান করতে না পারলে আবু জায়েদের মতো ‘সাইড লাইনড’ই হয়তো হয়ে পড়তেন সৌম্য। কিন্তু সে ম্যাচে ফিফটি করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা প্রত্যাশিত স্টাইলে ব্যাটিং করেছেন সৌম্য, যা তামিমের ভূমিকার সঙ্গে দারুণভাবে ‘ম্যাচ’ও করে গেছে।
তামিম নিজেই প্রশংসায় ভাসিয়েছেন উদ্বোধনী পার্টনারকে, ‘সব সময়ই বলি, ও (সৌম্য) যে ধরনের ব্যাটিং করে, তা আমার ওপর থেকে চাপ অনেকটা সরিয়ে নেয়। সত্যি বলতে আমার ইনিংসটায় আমার নিজের চেয়ে ওর সাহায্য ছিল বেশি।’ দল চায় অযথা ঝুঁকি না নিয়ে তামিম যেন যতটা সময় সম্ভব উইকেটে টিকে থাকেন। তিনি উইকেটে টিকে থাকলে তাঁর রানের সঙ্গে বাড়ে দলের সংগ্রহও। আবার তামিমের ধীরস্থির শুরুর মাঝেও স্কোরবোর্ড সচল রাখার কাজটা করতে হয় তাঁর সঙ্গীকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে যা করে গেছেন সৌম্য।
যে কারণে ব্যক্তিগত ৫ রানে অনেকগুলো ডট বল খেললেও দলীয় ইনিংসের গতি বাড়ানো নিয়ে ভাবতে হয়নি তামিমকে। ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে পার্টনারশিপের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মধ্যে ব্যাটিংয়ের উদ্বোধনী জুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে সৌম্য রান করায় আপাতত এ নিয়ে দুর্ভাবনা থেকে মুক্তি মিলেছে টিম ম্যানেজমেন্টের।
মারকাটারি আর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটিংয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা তামিমের ব্যাটিং স্টাইলে পরিবর্তন নতুন নয়। যিনি একসময় বোলার উসকে দিলেই তেড়েফুঁড়ে মারতে যেতেন, সেই তিনি এখন শত প্রলোভনেও ফাঁদে পা দেন না। ধীরে শুরু করা নিয়ে যে যা খুশি বলুক, তামিম নিজের গেম প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারলেই খুশি, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আমার ইনিংসের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো যে লড়াই ছেড়ে আসিনি।
যখন আটকে ছিলাম, তখন একটা বাজে শট খেলে উইকেট দিয়ে চলে আসতে পারতাম। ফিরে বলতাম যে আজ হচ্ছিল না। এটা করা সবচেয়ে সহজ, লড়াই করে পড়ে থাকা কঠিন। এটা নিয়ে হয়তো দশটা কথা বলবে লোকে, কিন্তু দিনশেষে আপনি ঠিকই দলে অবদান রাখতে পারবেন। এই শিক্ষাটা আমি পেয়েছিলাম জেমি সিডন্সের কাছ থেকে। তিনি সব সময়ই একটা কথা বলতেন যে, ‘যেদিন ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক হবে না, সেদিন দুটি ব্যাপার করতে পারো। উইকেট ছুড়ে দিয়ে ড্রেসিংরুমে এসে আমাদের সঙ্গে বসে থাকতে পারো অথবা উইকেটে লড়াই করতে পারো।’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান এখন সে রকম দিনে লড়াইয়ে ঝাঁপ দেন—এর চেয়ে স্বস্তির খবর আর কী হতে পারে!
গতকাল বাংলাদেশ দলের অনুশীলন ছিল ওয়াইএমসিএ গ্রাউন্ডে। ঐচ্ছিক হলেও আগের দিনের ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায় পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই গিয়েছিলেন সেখানে। তামিমও সেন্টার উইকেটে নক করে খুশি, ‘এখানকার প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটি তো অত ভালো না। তবে এখানকার উইকেটটা খুব ভালো দেখে অবাকই হয়েছি। যতক্ষণ ব্যাটিং করেছি, ভালো হয়েছে। অন্যরাও নিশ্চয়ই একই কথা বলবে।
আজকের এই প্রস্তুতিটা আমার জন্য খুব দরকার ছিল।’ অবশ্য প্র্যাকটিসে, ম্যাচে ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক হয়েছে কি না, সেটা তামিমের অভিব্যক্তি দেখলেই বোঝা যায়। ডাবলিনের মেঘ কেটে গতকাল সকাল থেকেই গ্রীষ্মের সূর্য ওঠার মতোই তাই উজ্জ্বল তামিম ইকবাল।
মন ভালো বলেই কিনা, আরেকটি সেঞ্চুরি হাতছাড়া করা নিয়ে আক্ষেপে হতাশার ভার নেই, ‘একটু আফসোস তো হয়ই। ফিফটি প্লাস ১৮ ইনিংসে সেঞ্চুরি করতে পারিনি। এর মধ্যে ১৫ বারই হয়তো নিজের দোষে আউট হয়েছি। এমন কিছু করতে গেছি, যা করার দরকার ছিল না। আবার দুর্ভাগ্যও কাজ করেছে। সব শেষ ইনিংসে (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে) ঠিক শটই খেলেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বল গিয়ে পড়ল ফিল্ডারের হাতে। এসব ক্ষেত্রে অতটা আফসোস থাকে না। সেদিন সেঞ্চুরির চেয়ে আমার বেশি আফসোস ছিল ম্যাচ শেষ করে না আসতে পারার জন্য।’
তবু দল তো জিতেছে দাপটে। নিজেরও ভূমিকা আছে তাতে। আবার উদ্বোধনী সঙ্গী হিসেবে সৌম্যর নৈপুণ্যও ভরসা দিচ্ছে তামিম ইকবালকে।